গোলাম কিবরিয়া : অনলাইন নিউজ পোর্টালগুলোর সংবাদের বিশ্বাসযোগ্যতা, গ্রহণযোগ্যতা কিংবা সম্পাদকীয় নীতিমালা বা পরিমিতিবোধ নিয়ে নানা কথা হচ্ছে৷ এর একটি প্রধান কারণ, প্রযুক্তির সহজলভ্যতা এবং সহজে ব্যবহারযোগ্যতায় গজিয়ে উঠছে ‘অনলাইন গণমাধ্যম’৷
লেখা যায় এবং সেটি অনলাইনে পোস্ট করা যায়, ন্যূনতম এমন একটি ডিভাইস থাকলেই এখন যে কেউ বনে যেতে পারেন অনলাইন নিউজ পোর্টালের মালিক-সম্পাদক-রিপোর্টারসহ সবকিছুই৷
প্রশ্ন হচ্ছে, এসব ভূঁইফোড় পোর্টালের গ্রহণযোগ্যতা কতোটা? এটা লাখ টাকার প্রশ্ন বটে! তার পাশাপাশি আরেকটি প্রশ্নও স্বাভাবিকভাবেই উঠে আসে, তথাকথিত ‘খ্যাতিমান’ পোর্টালগুলো কি দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিচ্ছে?
সম্প্রতি ফেসবুকের টাইমলাইন সয়লাব হয়ে গেল একটি নিউজে৷ প্রায় সবগুলো লিংকেরই শিরোনাম একই ধরনের, ‘আবারো ভাইরাল প্রভার ভিডিও৷’ ভার্চুয়াল জগতে কমবেশি বিচরণ আছে এমন কারোই বিস্মরণ হওয়ার কথা নয়, কয়েক বছর আগে অভিনেত্রী সাদিয়া জাহান প্রভার একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছিলো৷ এর ফলে চূড়ান্ত হেনস্তার শিকার হতে হয়েছে তাকে৷ তবে আশার কথা হচ্ছে, বাংলাদেশের মতো একটি রক্ষণশীল দেশেও তিনি আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছেন৷ নতুন করে অভিনয়ে ক্যারিয়ার শুরু করেছেন৷ এমন পরিস্থিতিতে যেখানে অনেকেই চাপ সইতে না পেরে হারিয়ে যান, এমনকি আত্মহননের পথও বেছে নেন, সেখানে প্রভার এই সাহসিকতাকে অবশ্যই সাধুবাদ জানাতে হয়৷
এখন ফিরে আসা যাক তাকে নিয়ে সাম্প্রতিক সংবাদ শিরোনামটির প্রসঙ্গে৷ যে ভিডিওটি কেন্দ্র করে দেশের কয়েকশত নিউজ পোর্টাল ‘নিউজ’ করে বসলো, তার ভেতর সারবস্তু কতোটা? হ্যা, সংবাদটি অবশ্যই মিথ্যা, ভুয়া বা ফেইক নয়৷ প্রভা ইন্সটাগ্রামে একটি কয়েক সেকেন্ডের ভিডিও প্রকাশ করেছেন৷ সেখানে তিনি কাউকে উদ্দেশ করে লাভ সাইন দেখিয়েছেন৷ এবং হয়তো সেই ভিডিওটি তার লাখো ভক্ত বা ফলোয়ার দেখেছেনও৷ কিন্তু যেভাবে ইঙ্গিতপূর্ণ শিরোনামে সংবাদটি পরিবেশন করা হলো, তাতে এসব সংবাদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক৷
এ ধরনের সংবাদ যখন অখ্যাত বা এমন খবর প্রকাশের জন্য বিশেষভাবে পরিচিত অনলাইনগুলোতে প্রকাশিত হয়, তখন এ নিয়ে বিশেষ আলোচনার অবকাশ থাকে না৷ কারণ গণমাধ্যমের পাঠক বা দর্শক নিজেরাই নির্ধারণ করে নেন, কোথায় কী কন্টেন্ট পাওয়া যাবে, কোনটা বিশ্বাসযোগ্য কোনটি নয়৷ ফেসবুকের নিউজফিডে উল্লেখিত শিরোনামগুলো দেখে একাডেমিক ইন্টারেস্টে একটু সার্চ করে দেখলাম, কারা এই নিউজটি কাছাকাছি শিরোনামে করেছে! আর সেই অনুসন্ধানের ফলেই আবারো আমাদের অনলাইন নিউজ পোর্টালগুলো নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন জাগলো৷
আগ্রহী পাঠকেরা নিজ উদ্যোগে এই কাজটি আবার করে দেখতে পারেন৷ বিভিন্ন দৈনিকের অনলাইন পেইজ, টেলিভিশনের অনলাইন পোর্টাল কিংবা স্বনামধন্য অনলাইন গণমাধ্যম- কেউই পিছিয়ে নেই৷ অর্থাৎ যে শব্দগুলো পাঠককে সুড়সুড়ি দেবে, যেটি দেখলে মানুষ তাদের লিংকে ক্লিক করার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়বে, সেটিই যেন একটি খবরের সংবাদমূল্য নির্ধারণের একমাত্র মাপকাঠি৷ তাহলে ভালো-মন্দ, গ্রহণযোগ্য-অগ্রহণযোগ্য বা রুচিশীল-কুরুচীপূর্ণের মধ্যে তফাৎ কী থকাল?
এখন আসা যাক এই সংবাদটির ফলোআপ প্রসঙ্গে৷ নিঃসন্দেহে এধরনের সংবাদ প্রকাশের পর অভিনেত্রী সাদিয়া জাহান প্রভা নতুন করে হেনস্তার শিকার হয়েছেন৷ আর সে কারণেই তিনি রোববার দুপুরে নিজের ফেসবুক পেইজে একটি স্টেটাস দিয়েছেন৷
এতে তিনি বলেছেন, ‘আপনাদের সঙ্গে গত প্রায় এক যুগেরও বেশি সময় ধরে একসঙ্গে কাজ করছি৷ আমার জীবনের নানান চড়াই উৎরাইয়ের ঘটনায় আপনারা পাশে ছিলেন৷ অন্য সবার মতো আপনারাও আমার কাজে সহযোগিতা করছেন৷কিন্তু ইদানিং খেয়াল করছি আমার অজান্তে আমাকে ঘিরে কিছু অনলাইন ও প্রিন্ট পত্রিকা অপ্রয়োজনীয় ও অনাকাঙ্ক্ষিত নানা ধরনের সংবাদ প্রকাশ করছে৷ আমি অবাক হয়ে লক্ষ্য করছি, সে সব সংবাদের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হচ্ছে আমার অভিনীত নাটকের বিভিন্ন দৃশ্য৷ এসব সংবাদের শিরোনাম ও ভাষা খুবই আপত্তিকর!এটা কি সাংবাদিকতার কোনো নীতিমালায় আছে যে, যাকে নিয়ে সংবাদ পরিবেশন করছেন তার সঙ্গে যোগাযোগ না করে সংবাদ প্রকাশ করা যায়? প্রভা মানেই কি আপনাদের নিউজের কাটতি, ভিউ আর রিডার? একজন শিল্পীর প্রতি, শিল্পের প্রতি কিংবা দেশের প্রতি কি দায়বদ্ধতা নেই?’
প্রভার এই ফেসবুক স্টেটাসটি নিয়েও সংবাদ হয়েছে৷ সেটি হতেই পারে, একজন সেলিব্রিটির ফেসবুক স্টেটাস, ইন্সটাগ্রামে গোস্ট করা ছবি বা টুইট নিয়ে সংবাদ হওয়া দোষের কিছু নয়৷ কিন্তু একটু ভাবুন তো এই স্টেটাস নিয়ে পরিবেশিত সংবাদের শিরোনাম কী হতে পারে? যে ধরনের শিরোনামে এই স্টেটাসটির সংবাদ পরিবেশন করা হয়েছে, তার কয়েকটি উল্লেখ করছি, ‘অবশেষে সেই ভিডিও নিয়ে মুখ খুললেন প্রভা’, ‘ভিডিও নিয়ে যা বললেন প্রভা’, ‘সেই গোপন ভিডিও নিয়ে মুখ খুললেন প্রভা’ ইত্যাদি৷
এ প্রসঙ্গে বহুবার শোন নাসিরুদ্দিন হোজ্জার সেই পুরোন গল্পটি আবার মনে পড়ে গেল:
হোজ্জার বাড়িতে এক বন্ধু এসেছেন বেড়াতে৷ সন্ধ্যায় প্রতিবেশীদের সঙ্গে পরিচয় করাতে নিয়ে যাওয়ার সময় হোজ্জা নিজের একটি ভাল পোশাক ধার দিলেন৷ প্রথম বাড়িতে হোজ্জাকে বন্ধুকে পরিচয় করিয়ে দেবার সময় এও জানালেন-এঁর গায়ে যে পোশাকটি দেখছেন, তা আসলে আমার৷
সেখান থেকে বেরিয়ে বন্ধু মহা ক্ষ্যাপা৷ কী দরকার ছিল ওটা বলে আমাকে অপমান করার? হোজ্জা ক্ষমা চাইলেন৷
দ্বিতীয় বাড়িতে গিয়ে বললেন, এঁর গায়ে যে পোশাকটি দেখছেন, তা আসলে এঁরই৷ এবার তো বন্ধু আরো ক্ষ্যাপলেন৷ পোশাকটি নিয়ে তুমি কিছু না বলাই ভালো৷
তৃতীয় বাড়িতে গিয়ে তাই হোজ্জা বললেন, ইনি আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু আর এঁর গায়ে যে পোশাকটি দেখছেন, সে সম্পর্কে কিছু না বলাই ভালো!
এ ক্ষেত্রেও ফলোআপ রিপোর্টের নামে প্রভার ফেসবুক স্টেটাসটি যে ধরনের শিরোনামে পরিবেশিত হলো, তাতে আবারো পাঠককে সুড়সুড়ি দেয়ার সব আয়োজনই করা হয়েছে৷
আরেকটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন৷ ফেসবুকে যেসব আইডি থেকে এই নিউজগুলো শেয়ার করা হয়েছে, তার নিচে কমেন্টগুলো দেখেও আমাদের পাঠক, দর্শক, সমাজের স্বরূপ কিছুটা বোঝা যায়৷ এই মন্তব্যগুলোর এক একটা এতই অশ্লীল যে সেগুলো এখানে উল্লেখ করার উপায় নেই৷ একজন নারীকে কতোভাবে হেনস্তা করা যায় তার উদাহরণ মেলে এসব মন্তব্যের প্রতিটি অক্ষরে৷
একটি ভয়ানক ঘটনার মুখোমুখি হয়ে, সেই ট্রমা কাটিয়ে একজন নারী যখন ঘুরে দাঁড়িয়েছে, তখন আমরা সবাই মিলে বার বার ঝাঁপিয়ে পড়ছি তাকে আবারো ভার্চুয়ালি হেনস্তা করতে৷ যে কোনো উসিলায় তার সেই খারাপ সময়টিকে আবারো সামনে নিয়ে আসার, দুঃস্বপ্নের মতো সেই দুঃসময়টি যেন সে ভুলে না যান, দগদগে ঘায়ের মতো সেটি যেন সারা জীবন বয়ে বেড়াতে হয়, তার সব আয়োজন সাজিয়ে বসেছি আমরা৷
প্রভার এই ঘটনাটি উল্লেখ করা হলো শুধু উদাহরণ হিসেবেই৷ আমাদের বেশিরভাগ অনলাইন নিউজ পোর্টালগুলো লাইক/হিটের মোহ থেকে বের হতে পারছে না৷ যে কোনো মূল্যেই বেশি পাঠক, বেশি শেয়ার তাদের কাম্য৷ এই যদি হয় অনলাইন গণমাধ্যমের সাংবাদিকতার নীতিমালার মূলমন্ত্র, তাহলে সেগুলো সত্যিকারের সংবাদমাধ্যম কবে হয়ে উঠবে সেটি কোটি টাকার প্রশ্ন৷
সূত্র/ ডয়চে ভেলে
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।