রঞ্জু খন্দকার, গাইবান্ধা: প্রায় এক একর জমির ওপর একতলা স্কুল। ভবনের সামনে পতপত করে উড়ছে পতাকা। বাইরে থেকে মনে হবে, সব তো ঠিকই আছে। আসলে ঠিক নেই কিছুই।
কাছে গেলেই বোঝা যায়, স্কুলের যে প্রাণ– শিক্ষক ও শিক্ষার্থী, তা এই স্কুলে নেই বললেই চলে। ১৯৭৩ সালে প্রতিষ্ঠিত স্কুলটিতে এখন শিক্ষক আছেন একজন, আর শিক্ষার্থী মোটে ৮ জন। এ অবস্থা প্রায় ৭ বছর ধরে।
স্কুলের নাম তেকানী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এটি গাইবান্ধার পলাশবাড়ী উপজেলার তেকানী গ্রামে। গ্রামটি উপজেলা সদর থেকে করতোয়া নদী দিয়ে বিচ্ছিন্ন। এর তিনদিকে দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট উপজেলা।
বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষক নজরুল ইসলাম জানান, এ বছর এখানে শিশুশ্রেণিতে পাঁচজন, প্রথম শ্রেণিতে দু’জন ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে একজন ভর্তি হয়েছে। গত বছর বিদ্যালয়টিতে চারজন শিক্ষার্থী ছিল।
গত ২ জানুয়ারি পলাশবাড়ী সদর থেকে বিদ্যালয়টির উদ্দেশে মোটরসাইকেলে চড়ে রওনা দিই। এ সময় দেখা যায়, তেকানী গ্রামের পূর্বপাশ দিয়ে বয়ে গেছে ক্ষীণতোয়া করতোয়া। শীতের কারণে শীর্ণ নদীতে গুণটানা নৌকায় পারাপার চলছে। নৌপারাপার শেষে আবার মোটরবাইকে রওনা। এবার চরের বালুপথ পাড়ি দিয়ে কাঙ্ক্ষিত গন্তব্য।
পথে তেকানী বিদ্যালয় এবং এর শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্কে গ্রামের এক প্রবীণের মন্তব্য, ‘যে গোয়ালে আখল (রাখাল) নাই, সেখানে গরু থাকবে কীভাবে?’
বিদ্যালয়টিতে গিয়ে দেখা যায়, স্কুলভবনের সামনে বিরাট মাঠ। দুদিকে খেতে সবুজ সবজি ফলে আছে। আর দুদিকে লোকালয়। ভবনের সামনে পতাকা উড়ছে। মাঠে কয়েক কৃষক খেত থেকে তুলে আনা আলু প্রক্রিয়াজাত করছেন।
কথা হলো এই গ্রামেরই বাসিন্দা মারুফ বিল্লাহর সঙ্গে। তিনি বিদ্যালয়টির পরিচালনা কমিটির সদস্য। তিনি বললেন, তিনিও এই বিদ্যালয়েই প্রাথমিকের পাঠ নিয়েছেন। তখন এখানে দুই-আড়াইশ শিক্ষার্থী ছিল। তাদের কলকাকলিতে স্কুল মুখর ছিল। ২০১৩ সালে সরকারি হওয়ার পর নানা সংকটে এখানে শিক্ষাব্যবস্থায় ধস নামে।
বিদ্যালয়টির এক একর দশ শতাংশ জায়গা আবার পর্যাপ্ত শিক্ষক-শিক্ষার্থীর পদভারে প্রকম্পিত হোক, ফিরে পাক প্রাণ, মারুফ বললেন, তিনিসহ এলাকাবাসী এমনটাই চান।
ভবনে ঢুকে দেখা গেল, অফিসে আসবাব আছে, কিন্তু কোনো শিক্ষক নেই। দুটি শ্রেণিকক্ষ তালাবদ্ধ। একটি কক্ষে জনাচারেক শিক্ষার্থীকে পাঠদান করছেন একজন শিক্ষক। তিনি নিজেকে প্রধান শিক্ষক হিসেবে পরিচয় দিলেন।
প্রধান শিক্ষকের নামই নজরুল ইসলাম। তিনি বলেন, তিনি এখানে ২০১৮ সালে আসেন। তখনও বিদ্যালয়টিতে ১০ জনের বেশি শিক্ষার্থী ছিল না। তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত একজন শিক্ষার্থীও তিনি পাননি। তাই কক্ষগুলো তালাবদ্ধ থাকে। তিনি আসার পর ২০২০ সালে সরকার সারা দেশে শিক্ষক নিয়োগ দেয়। সেবার আবেদন করেও তিনি শিক্ষক পাননি। এবারও তিনি শিক্ষক চেয়েছেন।
এলাকার কয়েকজন জানান, বিদ্যালয়টি বেসরকারিভাবে প্রতিষ্ঠিত। তখন আশপাশের লোকজনই এখানে শিক্ষকতা করতেন। সরকারি হওয়ার পর আগের শিক্ষকেরা দু-এক বছরের ব্যবধানে অবসরে যান। তখন করতোয়া পার হয়ে অন্য শিক্ষকেরা এখানে আসতে চান না। আসলেও বদলি নিয়ে চলে যান। পাশের দিনাজপুর থেকে তো এখানে শিক্ষক দেওয়ারই নিয়ম নেই। ফলে আস্তেধীরে বিদ্যালয়টি বলতে গেলে শিক্ষকশূন্য হয়ে পড়ে।
একজন অভিভাবক বলেন, শিক্ষক না থাকলে তাঁরা এখানে ছাত্র দেবেন কেন? তাদের ছেলেমেয়ের কি ভবিষ্যৎ নেই?
জানতে চাইলে বিদ্যালয়টির পরিচালনা কমিটির সভাপতি আবদুল আজিজ জানান, তাঁরা এবারও শিক্ষক চেয়ে উপজেলা শিক্ষা অফিসে যোগাযোগ করেছেন। সেখান থেকে চলতি নিয়োগে তাদের শিক্ষক দেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। অন্তত তিনজন শিক্ষক হলেও বিদ্যালয়টি চলতে পারে।
বিদ্যালয়টি থেকে ফেরার পথে আবার চোখ চলে গেল এক একর বিস্তৃত খোলা মাঠে। সেখানে তখন চারজন বালক একটি ফুটবলের পেছনে দৌড়াচ্ছে। শ্রেণিকক্ষগুলো ফাঁকা পড়ে আছে। বাইরে পতাকা পতপত করে উড়ছে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।