জুমবাংলা ডেস্ক: একটি মাত্র পা-ই তার সম্বল। নেই দুই হাত। দুই পায়ের একটি নেই। সেই এক পায়ে ভর দিয়ে একে একে জীবনের কঠিন সিঁড়িগুলো টপকে চলেছে অদম্য সংগ্রামী তামান্না নূরা। দৈনিক কালের কন্ঠের প্রতিনিধি ফিরোজ গাজী-এর প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
পা দিয়ে লিখে এবার যশোর বোর্ড থেকে এইচএসসিতে বিজ্ঞান বিভাগে জিপিএ ৫ পেয়েছে সে। একের পর এক মেধা ও যোগ্যতার স্বাক্ষর রেখে চলছে অদম্য নূরা।
এর আগেও এক পা দিয়ে লিখে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী, জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট ও এসএসসিতে বিজ্ঞান বিভাগের পরীক্ষায় জিপিএ ৫ পেয়েছিল নূরা। ছবি আঁকায় প্রাতিষ্ঠানিক কোনো শিক্ষা না থাকলেও এক পায়ে খুব সুন্দর ছবিও আঁকে সে।
সুস্থ-সবল অন্য শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে একের পর এক সাফল্যের ধাপ অতিক্রম করে চলছে তামান্না। তবে নূরা সাফল্যের যাত্রায় যতই এগিয়ে চলছে, ততই তার ভবিষ্যৎ চিন্তায় অস্থির হয়ে পড়ছে তার বাবা-মা।
সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে তামান্নার বিষয়ে খোঁজখবর নেওয়া হয়েছে। সে অনুসারে যশোর জেলা প্রশাসক তমিজুল ইসলাম খানসহ কর্মকর্তারা তার বাড়িতে যায়। তখন তামান্না প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সরাসরি সাক্ষাৎ করার ইচ্ছার কথা জানায়। পাশাপাশি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার স্বপ্ন পূরণে প্রধানমন্ত্রীর সহযোগিতা কামনা করে সে।
তামান্নার দৈনন্দিন জীবনে নাওয়া-খাওয়ার প্রতিটি মুহূর্তই সংগ্রামের। এ অবস্থায় লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়া তামান্নার জন্য বাড়তি বোঝাই বটে। তবে এ পর্যন্ত পৌঁছার পেছনে রয়েছে তামান্নার অদম্য ইচ্ছার পাশাপাশি তার মা-বাবার আপ্রাণ চেষ্টা।
মেয়েটির লেখাপড়ার ইচ্ছা পূরণে সহযোগিতা করেছে তার বিদ্যালয় থেকে কলেজ কর্তৃপক্ষও। ক্লাসে তামান্নার সুবিধার জন্য বসার ব্যবস্থা অন্য শিক্ষার্থীদের থেকে ভিন্ন। শ্রেণিকক্ষে তার জন্য ব্ল্যাকবোর্ডের পাশেই বসানো আছে একটি চৌকি। তাতে বসে পা দিয়েই লিখতে ও পড়তে পারে তামান্না।
যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার বাঁকড়া গ্রামের রওশন আলী ও খাদিজা পারভীন শিল্পীর মেয়ে তামান্না। দুই বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে সে বড়। ছোট বোন মুমতাহিনা রোশনী পড়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে। ছোট ভাই মহিবুল্লাহ তাজ পড়ে প্রথম শ্রেণিতে। তামান্নার প্রতিবন্ধী জীবনের বড় সৌভাগ্য তার সচেতন মা-বাবা। বাবা রওশন আলী বিএসসি পাস। মা খাদিজা এসএসসি পাস। প্রতিবন্ধী মেয়ে জন্ম নেওয়ার খবর পেয়ে বিদেশের চাকরি ছেড়ে চলে আসেন বাবা রওশন, মেয়েকে যত্নের সঙ্গে বড় করে তোলার ইচ্ছায়।
উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি কোচিংয়ের জন্য তামান্নার পরিবার বর্তমানে যশোর শহরের মিশনপাড়া এলাকায় ভাড়া বাসায় বসবাস করছে।
আজ কথা হয় তামান্নার সঙ্গে। এইচএসসিতে জিপিএ-৫ পাওয়ায় খুশি তামান্না। এ পর্যন্ত পৌছানোর পেছনে তার বাবা-মা শিক্ষকদের অবদানের কথাও জানান তিনি। পাশাপাশি আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশীদের কথাও কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করেন তিনি।
তামান্না জানান, কয়েকদিন আগে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে তার ব্যাপারে খোঁজ খবর নেয়া হয়েছে। যশোরের জেলা প্রশাসকসহ কয়েকজন কর্মকর্তা তার বাড়িতে দেখা করেছেন। সেই সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার স্বপ্ন পূরণে প্রধানমন্ত্রীর সুদৃষ্টি ও সহযোগিতা কামনা করেন তিনি। পাশাপাশি তিনি প্রধানমন্ত্রীর সরাসরি সাক্ষাত কামনাও করেছে।
এইচএসসিতে তামান্না জিপিএ-৫ পাওয়ায় আনন্দে আপ্লুত তামান্নার বাবা রওশন আলী জানান, তামান্নার এসব সাফল্য তার সব কষ্ট ভুলিয়ে দিয়েছে। এরপর তামান্নার এ পর্যন্ত ওঠে আসার পেছনের গল্প শোনালেন তার বাবা। বিয়ের তিন মাস পর সৌদি আরব চলে যান তিনি। তখন তাঁদের অবস্থা ছিল মোটামুটি সচ্ছল। কিন্তু এমন সন্তান জন্মের খবরে রওশন দেশে ফিরে আসেন। এরপর আর বিদেশে যাননি।
এরপর স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে সিদ্ধান্ত নেন, যেভাবেই হোক ভালোভাবে বড় করে তুলবেন এই বুকের ধনকে। সামান্য কিছু জমি থেকে আসা আয়েই চলে তাঁর সংসার। একটি নন এমপিও মাদরাসায় চাকরি নেন। সেখান থেকে কোনো বেতন পান না। তাই ঠিকমতো সংসার চালানোই দায়। তাঁর সামর্থ্যে মধ্যে আগামীতে আর কতটুকুই করতে পারবেন তামান্নার জন্য এই চিন্তায় দিশাহারা রওশনও। মেয়ের জন্য মুখ ফুটে সহায়তা চাইতেও পারেন না এ শিক্ষক। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কী হবে তাও জানেন না। তবে সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে মেয়ের খোঁজ খবর নেয়ায় ভালো কিছু হওয়ার আশা করছেন তিনি।
তামান্নার মা খাদিজা পারভীন শিল্পী। কয়েকদিন আগে টিউমার অপারেশন হয়েছে। বর্তমানে হাসপাতালে ভর্তি। প্রায় সুস্থ হওয়ার পথে তিনি। তিনি জানালেন, তামান্নাকে নিয়ে তাদের সংগ্রামের গল্প। তামান্নাকে প্রথমে এলাকার একটি স্কুল ভর্তি নিতে চায়নি। তাতে তারা দমে যাননি। তামান্নাকে পায়ের আঙুলে পাটকাঠি ধরিয়ে কলম ধরায় অভ্যস্ত করেছেন। এরপর লেখার চর্চা করিয়েছেন। এলাকার অন্য স্কুলগুলো যখন তাকে ভর্তি করতে চায়নি।
তখন এগিয়ে আসে স্থানীয় আজমাইন এডাস স্কুল কর্তৃপক্ষ। তারা সানন্দে মেয়েটিকে ভর্তি করে নেয়। এরপর থেকে হুইল চেয়ারে করে তামান্নাকে স্কুলে আনা-নেওয়া করেন তার বাবা। এ কাজে কখনো কখনো তামান্নার স্কুলের শিক্ষক, শিক্ষার্থী অথবা প্রতিবেশীরাও সহায়তা করেছেন। আজমাইন স্কুলের পর তামান্না জোনাব আলী খান মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেয়। এরপর বাঁকড়া ডিগ্রি কলেজ থেকে উত্তীর্ণ হয় এইচএসসি পরীক্ষায়। তামান্নার এ পর্যন্ত পৌঁছার পেছনে শিক্ষকরাও সব ধরনের সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছেন বলে জানান মা খাদিজা পারভীন।
তামান্নার গ্রামের প্রতিবেশী ও শিক্ষক রফিকুল আলম বাবলু জানালেন, তামান্না শারীরিক প্রতিবন্ধী হলেও খুবই মেধাবী ছাত্রী। উপযুক্ত পরিচর্যা পেলে সে বোঝা না হয়ে সম্পদে পরিণত হবে।
এব্যাপারে বাঁকড়া ডিগ্রী কলেজের অধ্যক্ষ সামছুর রহমান বলেন, ‘তামান্না আমার প্রিয় ছাত্রী। তার জন্য কলেজে পড়াশুনা ফ্রি ছিল। সে অত্যান্ত মেধাবী। সরকারের সুদৃষ্টি ও যথাযত পরিচর্যা পেলে সে বোঝা না হয়ে সম্পদে পরিনত হবে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।