রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ের উপসচিব কাজী তুহিন রসুলের বিরুদ্ধে কোটি টাকার আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। জার্মানির রাজধানী বার্লিনে বাংলাদেশ দূতাবাসে কাজ করার সময় তিনি এ জালিয়াতি করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। ২০১৯ থেকে ২০২৩, এ চার বছরে তিনি ৯২ লাখ ৪৫ হাজার ৫৫৩ টাকা আত্মসাৎ করেছেন। তিনি একজন প্রশাসন ক্যাডার কর্মকর্তা।
বাড়ি ভাড়ার পরিমাণ গোপন রেখে ভুয়া চুক্তিপত্র তৈরি করার মাধ্যমে প্রতারণা করেন তিনি। তাছাড়া দায়িত্ব পালনের চরম অবহেলা করা ও তথ্য সংরক্ষণে দুর্নীতিতে জড়িয়েছেন তিনি। বার্লিন দূতাবাসের কাউন্সিলর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন তিনি।
দূতাবাসের কনস্যুলারবিষয়ক টাস্কফোর্স এর অনুসন্ধানে এসব তথ্য সবার সামনে আসছে। সেখানে দেশের রাষ্ট্রদূত মোশারফ হোসেন ভূঁইয়ার গোপন চিঠি থেকে অনেক তথ্য বেরিয়ে আসছে। বিচারক কাজী গোলাম রসুলের মেয় তিনি। গোলাম রসুল মুজিব হত্যা মামলার রায়দানকারী বিচারকদের একজন।
দশ বছরের বেশি সময় ধরে বার্লিনে দায়িত্ব পালনের সময় দুর্নীতি ও অনিয়মে জড়িয়ে পড়েছেন তার মেয়ে। সঠিক দলিলপত্র বা রেজিস্টার ছাড়াই কনসুলার রিলেটেড আয় অধীনস্থ কর্মচারীর ব্যক্তি পর্যায়ে ব্যাংকে জমা রাখতেন। টাস্কর্ফোস জানিয়েছে যে, বিষয়টি জবাবদিহিতার অধীনে আনাটা দরকার।
পাসপোর্ট এর আবেদন গ্রহণ এবং সরবরাহ করার ক্ষেত্রে ডকুমেন্ট যাচাই-বাছাই করা হয়নি। বিভিন্ন ডকুমেন্ট সঠিকভাবে সংরক্ষণ করা হয়নি। যারা সেবা প্রত্যাশা করেন তাদের দুর্ভোগের পেছনে তিনি দায়ী। তার এসব দুর্নীতির বিষয়টি প্রকাশ্যে আসার পর ২০২৩ সালে বার্লিন থেকে তাকে ঢাকায় প্রত্যাহার করা হয়।
রাষ্ট্রদূতের লেখা চিঠির সূত্র ধরে অনুসন্ধানে জানা গেছে, কাজী তুহিন রসুল তার বসবাসকারী বাসার প্রোপার্টি ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিতে পরিবর্তন এবং বাসা ভাড়া প্রদানের জন্য নির্ধারিত ব্যাংক অ্যাকাউন্টের তথ্য পরিবর্তনের জন্য ২০২৩ সালের ১২ জুলাই একটি নোট দেন। রাষ্ট্রদূত সেই নোট অনুমোদনের পর বাড়ি ভাড়া বাবদ ৩৪০০ ইউরো প্রদানের অনুরোধসহ দূতাবাসের অ্যাকাউন্ট রক্ষণাবেক্ষণকারী স্থানীয় দয়েশে ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে চিঠি দেওয়া হয়।
পরে ওই ব্যাংক থেকে দূতাবাসকে জানানো হয় যে, দূতাবাসের চিঠিতে প্রদত্ত ব্যাংক অ্যাকাউন্টের বেনিফিশিয়ারি কোম্পানির সঙ্গে প্রকৃত বেনিফিশিয়ারির তথ্য মিলছে না। কাজী তুহিন রসুলের দেওয়া নোট এবং চিঠি অনুযায়ী ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বেনিফিশিয়ারির নাম হওয়ার কথা ZVK AEW কিন্তু তুহিন রসুলের দেওয়া নতুন ব্যাংক অ্যাকাউন্ট একটি ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্ট এবং যার বেনিফিশিয়ারির নাম তানভীর মাহমুদ। আর এই তানভীর মাহমুদ হলেন কাজী তুহিন রসুলের স্বামী।
এ ব্যাপারে সন্দেহ তৈরি হওয়ায় ব্যাংকের পক্ষ থেকে প্রোপার্টি ম্যানেজমেন্ট SOKA BAU কোম্পানির প্রতিনিধি মারসেলের সঙ্গে তাৎক্ষণিকভাবে যোগাযোগ করা হয় এবং ব্যাংক নিশ্চিত হয় যে, কাজী তুহিন রসুল SOKA BAU কোম্পানির নামে যে চিঠি এবং ডকুমেন্টস ব্যাংকে জমা দিয়েছেন তা ভুয়া এবং জাল। ২০২৩ সালের ৮ আগস্ট ব্যাংক কর্তৃপক্ষ দূতাবাসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করে এই জালিয়াতির বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে অবহিত করে।
কাজী তুহিন রসুলের এ ধরনের জালিয়াতিতে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ রীতিমতো বিস্ময় প্রকাশ করে জানায়, এ ধরনের জালিয়াতির ঘটনা তাদের ইতিহাসে নেই। SOKA BAU কোম্পানির পক্ষ থেকে দয়েশে ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে স্পষ্টভাবে জানানো হয়, ২০২৩ সালের ১২ জুলাই কাজী তুহিন রসুল কর্তৃক প্রদত্ত চিঠি সম্পূর্ণ মিথ্যা ও জাল। পরবর্তী সময়ে ওইসব জাল ডকুমেন্টস ব্যাংকের আর্থিক অপরাধ সংক্রান্ত বিভাগে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
কাজী তুহিন রসুল বার্লিনে যে বাসায় থাকতেন তার মাসিক ভাড়া ৩ হাজার ৪০০ ইউরো নয়। প্রোপার্টি ম্যানেজমেন্ট SOKA BAU কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশ দূতাবাসকে জানায়, ২০১৯ সালের নভেম্বর মাসে নির্ধারিত বাসা ভাড়ার পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৭৯৫ ইউরো, সিকিউরিটি ডিপোজিট ছিল ৪ হাজার ১৭০ ইউরো। এখানে কাজী তুহিন রসুল ভুয়া এবং জাল চুক্তিপত্রের মাধ্যমে ২০১৯ সালের অক্টোবর থেকে ২০২৩ সালের জুলাই মাস পর্যন্ত বাসা ভাড়া বাবদ ৩ হাজার ৪০০ ইউরো এবং সিকিউরিটি ডিপোজিট বাবদ ৮ হাজার ৯৮৫ ইউরো অবৈধভাবে ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে গ্রহণ করেন।
সরকারি বিধান অনুযায়ী এটা গুরুতর অপরাধ। কাজী তুহিন রসুল ৪৬ মাসে শুধু বাড়ি ভাড়া বাবদ ৭৯ হাজার ১৪৯ ইউরো সমপরিমাণ ৯২ লাখ ৪৫ হাজার ৫৫৩ টাকা আত্মসাৎ করেন। দুর্নীতিবাজ এই কর্মকর্তার জালিয়াতির পাশাপাশি বেআইনিভাবে SOKA BAU কোম্পানির সিল, লোগো ব্যবহার এবং জাল চুক্তিপত্র তৈরির কারণে বাসা ভাড়ার চুক্তিটি বাতিল করা হয়।
কাজী তুহিন রসুলের এই সীমাহীন জালিয়াতি ও আর্থিক অনিয়মের পাশাপাশি তার দাপ্তরিক কাজের ক্ষেত্রেও অনিয়মের যেন কোনো শেষ নেই। বার্লিনে বাংলাদেশ মিশনের কনস্যুলার বিভাগের টাস্কফোর্স-এর অনুসন্ধানে গুরুতর সব অনিয়মের তথ্য বেরিয়ে এসেছে। ১০ বছরেরও বেশি সময় ধরে কনস্যুলার বিভাগে কর্মরত কাজী তুহিন রসুল নিয়মিত অফিস করতেন না বলে টাস্কফোর্সের অনুসন্ধানে প্রমাণ মিলেছে।
রাষ্ট্রদূত তথা মিশন প্রধান এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন ছাড়া মিশনের সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সন্তানদের জন্য ৩৪টি কূটনৈতিক ও অফিসিয়াল পাসপোর্ট সাধারণ পাসপোর্টে পরিবর্তন করে হস্তান্তর করেছেন কাজী তুহিন রসুল। এ ব্যাপারে কোনো নথি বা অনুমোদনের কোনো ডকুমেন্টস খুঁজে পাওয়া যায়নি। এটা নিয়মের গুরুতর লঙ্ঘন।
তাকে কোন শাস্তি না দিয়ে বরং রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ে পদায়ন করা হয়। কাজী তুহিন তার বাবার পরিচয়কে ব্যবহার করে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের ঘনিষ্ঠ হয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় পর্যন্ত তার ভালো সম্পর্ক ছিল। এ কারণে তার শাস্তির মুখোমুখি হতে হয়নি। এমনকি দশ কাঠার সরকারি প্লট পর্যন্ত নিজের নামেই নিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছেন। সে বৈধভাবে এ প্লট পায় কিনা সে বিষয়ে জটিলতা রয়েছে।
সূত্র: আমার দেশ
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।