জুমবাংলা ডেস্ক: এ এক অদ্ভূত রেল স্টেশন। টন টন সোনা পাচার, গুপ্তচরবৃত্তি, গ্রেফতারি থেকে শুরু করে নাৎসিদের কোপ এড়াতে হাজার হাজার ইহুদির দেশত্যাগ— দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কালের বহু ঘটনারই সাক্ষী ছিল কানফ্র্যাঙ্ক আন্তর্জতিক রেলওয়ে স্টেশন। যদিও আজ আর সে স্টেশনের অস্তিত্ব নেই। ৪৩ বছর বন্ধ থাকার পর তা বিলাসী হোটেলের রূপ নিয়েছে।
চলতি বছরের জানুয়ারিতে স্পেনের অ্যারাগন উপত্যকায় দ্বার খুলেছে কানফ্র্যাঙ্ক। সেই সত্তরের দশক থেকেই যা বন্ধ হয়ে পড়েছিল। বছর কয়েক ধরে সংস্কারের পর এ বার নতুন চেহারায় ধরা দিয়েছে এটি। ট্রেনযাত্রীদের বদলে সেখানে পর্যটকের ভিড় জমছে।
১৯২৮ সালে কানফ্র্যাঙ্ক স্টেশনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয়েছিল। সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন তৎকালীন স্পেনের সম্রাট সপ্তম ফার্দিনান্দ এবং ফরাসি প্রজাতন্ত্রের প্রেসিডেন্ট গ্যাস্তোঁ দুম্যাগ। স্টেশনটি স্পেনের এলাকাভুক্ত হলেও ফ্রান্সের সীমান্তঘেঁষা। ফলে দুই রাষ্ট্রপ্রধানই ওই অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন।
দশকের পর দশক বন্ধ থাকার পর কানফ্র্যাঙ্কের ভোলবদলের প্রচেষ্টা শুরু করে স্পেনের বার্সেলো হোটেল গ্রুপ। অবশ্যই তাতে কানফ্র্যাঙ্ক প্রশাসনও জড়িয়েছিলেন। দীর্ঘ দিন বন্ধ হয়ে পড়ে থাকার পর এর রূপান্তরিত চেহারায় স্থানীয় বাসিন্দাদের উৎসাহ চোখে পড়ার মতো ছিল বলে জানিয়েছেন কানফ্র্যাঙ্কের মেয়র ফার্নান্দো স্যাঞ্চেজ় মোরালেস।
কানফ্র্যাঙ্কের টানে পর্যটকদের পাশাপাশি স্পেনে পা রাখছেন ইতিহাসের গন্ধবিলাসীরাও। আমেরিকার সংবাদমাধ্যম ‘সিএনএন’-কে মোরালেস বলেন, ‘কানফ্র্যাঙ্ক স্টেশনের পুনরুজ্জীবনে আমরা সন্তুষ্ট।’
সত্তরের দশকে প্রায় ধ্বংসাবশেষে পরিণত বলেও কানফ্র্যাঙ্কের সৌন্দর্যে তখন নাকি চোখ ফেরানো যেত না। সেই রূপের টানে চিত্রগ্রাহকেরা ওখানে ঘুরে বেড়াতেন। স্পেনীয় স্থাপত্যবিদ ফার্নান্দো রামিরেজ় দি দমপিয়েরের চিন্তন ধরা পড়েছিল এর নকশায়। ইউরোপীয় রেলের ইতিহাসের আগ্রহী তাঁর সমস্ত শিল্পসত্তা দিয়ে এর নকশা করেছিলেন।
অনেকের মতে, কানফ্র্যাঙ্কের পরিত্যক্ত ধ্বংসপ্রায় ভূতুড়ে চেহারাই তাদের কাছে আকর্ষণীয় মনে হত। তবে আজকাল অভিজাত কানফ্র্যাঙ্ককে চেনাই দায়। ৪টি স্যুইট-সহ ১০০টি ঘর। সঙ্গে সুইমিং পুল, ওয়েলনেস এরিয়া এবং ৩টি রেস্তরাঁ।
কানফ্র্যাঙ্কের সুইমিং পুলে নামতে গেলে আবার ১৫ পাউন্ড করে গাঁটের কড়ি গুনতে হবে। ভারতীয় মুদ্রায় যা প্রায় দেড় হাজার টাকা।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় অবশ্য কানফ্র্যাঙ্কের চেহারায় এই মসৃণতা ছিল না। তবে হতাশা এবং আশার আলো, দুই-ই দেখেছে কানফ্র্যাঙ্ক।
র্যামন হাভিয়ের ক্যাম্পো ফ্রেইল নামে এক সাংবাদিক ‘সিএনএন’-কে বলেন, ‘‘দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের গোড়ার দিকে ১৯৪০ থেকে ’৪২ পর্যন্ত হাজার হাজার ইহুদি এই স্টেশন দিয়েই দেশ ছেড়ে লিসবন এবং আমেরিকায় পালিয়েছিলেন। ’’
র্যামনের দাবি, জার্মানির একনায়ক হিটলারের ভয়ে ভিটেমাটিছাড়াদের দলে ছিলেন মার্ক্স আর্নস্ট এবং মার্ক শাগালের মতো বিশ্বখ্যাত চিত্রশিল্পী অথবা ফরাসি বংশোদ্ভূত আমেরিকার গায়িকা-অভিনেত্রী জোসেফিন বেকার। সবেরই সাক্ষী থেকেছে কানফ্র্যাঙ্ক স্টেশন।
মিত্রশক্তির হয়ে নাৎসি বিরোধী ফরাসিদের দলে যোগ দিতে গিয়ে এই স্টেশন দিয়ে পাড়ি দিয়েছেন অসংখ্য গুপ্তচর। ২০১৭ সালে সংবাদমাধ্যমে এমনই দাবি করেছিলেন মোরালেস। তিনি বলেছিলেন, ‘মিত্রশক্তির নেতৃত্বও গুপ্তচরদের নেটওয়ার্ক কাজে লাগিয়ে এ স্টেশনের মাধ্যমে নানা তথ্য ফ্রান্স এবং স্পেনে পৌঁছে দিতেন।’
যদিও ১৯৪২-এ নাৎসিদের দখলে চলে যায় কানফ্র্যাঙ্ক পুরসভা। ১৯৪৪-এর জুন পর্যন্ত এই রাশ ছিল নাৎসিদের হাতে। সে সময় এই স্টেশন দিয়ে পালানো কঠিন হয়ে পড়ে। বহু গ্রেফতারিও সাক্ষী থেকেছে স্টেশনটি।
বস্তুত, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কানফ্র্যাঙ্কই ছিল একমাত্র স্পেনীয় পুরসভা, যা দখল করেছিলেন নাৎসিরা। ওই আমলে পর্তুগালের লিসবনে পালানোর সময় ৩০০ জনকে গ্রেফতার করেছিলেন তাঁরা। ধৃতদের স্পেন জুড়ে নানান জেলে পোড়া হয়েছিল।
কানফ্র্যাঙ্ককে ঘিরে টান টন সোনা পাচারের জল্পনাও রয়েছে। মোরালেসের দাবি, ‘সে সময় এই স্টেশন দিয়ে সোনা এবং দামি ধাতুর পাচার নিয়ন্ত্রণ করতেন জার্মানরা। এমনকি, ফ্রান্সের পতাকা নিচু করে রাখতেন তারা।’
র্যামনের দাবি, কানফ্র্যাঙ্ক দিয়ে নাৎসিদের সোনা পাচারের জল্পনা দিনের পর দিন বেড়েছে বই কমেনি। তবে ২০০০ সালে সেই জল্পনাকে সত্যি বলে জানায় প্রশাসন।
র্যামনের কথায়, ‘১৯৪২ থেকে ১৯৪৪ সাল পর্যন্ত এখান দিয়ে ৮৬ টন সোনা পাচার করেছিলেন নাৎসিরা। এমনই প্রমাণ পেয়েছিলেন স্থানীয় এক বাসচালক।’
র্যামন আরও বলেন, ‘ইউরোপীয় এবং আমেরিকার আর্কাইভ থেকে আবার প্রমাণ মিলেছে, এই এলাকা দিয়ে ১০০ টনের বেশি সোনা পাচার হয়েছিল।’
যদি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ের সে সব অন্ধকার দিন আজ অতীত। আজকাল কানফ্র্যাঙ্কের এই হোটেলের টানে সেখান পা রাখছেন পর্যটকেরা। তাদের মধ্যে রয়েছেন উত্তর আয়ারল্যন্ডের বেলফাস্টের বাসিন্দা তথা স্থাপত্যবিদ টমাস ও’হেয়ার।
কানফ্র্যাঙ্কের হোটেলের দরজা খোলার আগেই সংস্কারকাজের সময় এর সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়েছিলেন টমাস। হোটেলের দরজা খোলার পর আবার সেখানে গিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘এর বহিরঙ্গ চোখ ধাঁধানো। এমন একটা ধারণা হয়, যেন অন্য কোনো যুগে পৌঁছে গিয়েছি।’
সূত্র: আনন্দবাজার
চোখের ধাঁধা: বনের ছবিটিতে লুকিয়ে আছে একটি বাঘ, চ্যালেঞ্জ রইল খুঁজে বের করার
Own the headlines. Follow now- Zoom Bangla Google News, Twitter(X), Facebook, Telegram and Subscribe to Our Youtube Channel