ড. সৈয়দ আবদুল্লাহ আল মামুন চৌধুরী : সমাজকে ভেতর ও বাইরে থেকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা একজন সমাজকর্মীর অন্যতম কাজ। আমি যদিও কোনো সমাজবিজ্ঞানী নই, তবে দীর্ঘদিন সামাজিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত থেকে সমাজকে নিয়ে চিন্তার একটি দায়বোধ আমাকে সর্বদা তাড়িত করে। সেই দায়বোধ থেকেই আজকের এ আলোচনার অবতারণা।
আইডিয়াল স্কুলের গভর্নিং বডির একজন সদস্য তার নাতনিসদৃশ এক কিশোরীকে বিয়ে করে ভাইরাল হয়েছেন। সমাজের চোখে এ বিয়ে অসম ও অগ্রহণযোগ্য হলেও ধর্মীয় ও আইনের দৃষ্টিতে বাধা নেই। মেয়ে বালেগ, মেয়ে ইচ্ছুক, সুতরাং কারও কিছু বলার নেই। এ জুটির বক্তব্য : আমরা বিয়ে করেছি; অশ্লীলতা তো করিনি! এ পর্যন্ত ঠিক ছিল; কিন্তু গোল বেঁধেছে অন্যত্র।
তারা বিয়ে করেছেন এটি অশ্লীলতা নয়; তবে তারা পরিবারের অমতে বিয়ে করে সেই ঘটনাকে যেভাবে ‘হিরোইজম’ বলে প্রচারে নেমেছেন এবং তরুণ প্রজন্মকে ভুল বার্তা দিচ্ছেন, তা আমাদের সনাতন সমাজব্যবস্থার বিচারে অশ্লীলতাকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে।
তারা অসম প্রেম-অসম বিয়ে করেছেন সেটা ঠিক আছে; কিন্তু তারা যেভাবে পুরো বিষয়টিকে একটি ‘ভালো কাজ’ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে উদ্যোগী হয়ে উঠেছেন, বিভিন্ন মিডিয়ায় উপস্থিত হয়ে নিজেদের ‘আইডল’ হিসাবে প্রমাণের প্রাণান্ত চেষ্টা করছেন, তাতে চিন্তিত না হয়ে পারা যায় না। বিশেষ করে এ জুটির মেয়েটি যেসব লজিক দ্বারা নিজেকে ‘আইডল’ বানানোর চেষ্টা করছে, তা যদি একবার প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়, তাহলে তা আমাদের সনাতন সমাজব্যবস্থাকে তাসের ঘরের মতো ভেঙে ফেলবে। মেয়েটি তার বিভিন্ন বক্তব্যে তার পিতা-মাতার প্রতি যেরূপ অবজ্ঞা প্রদর্শন করেছে, তা চরম স্বার্থপরতা ভিন্ন কিছু নয়। মেয়েটি প্রশ্ন করেছে, আমার ভালো কি আমি দেখব না? গুড! ভালোর সংজ্ঞা কী? তুমি কে? কোথা থেকে তুমি এসেছ? কারা তোমাকে এত বড় করেছে? যে বাবা তোমাকে জন্ম দিল; যে মা তোমাকে গর্ভে ধারণ করল, তাদের কি কোনোই গুরুত্ব নেই? তাদের হেয় প্রতিপন্ন করে তুমি কোন মহত্ত্বের পরিচয় দিচ্ছ? বিয়ে মানে কি শুধু গাড়ি-বাড়ি-অর্থবিত্তের নিশ্চয়তা? একজন সার্থক প্রেমিক মানেই কি অর্থ-বিত্তশালী পুরুষ? অর্থ ও প্রাচুর্যই কি সব? বাবা-মা-ভাইবোন-আত্মীয়স্বজন, এরা কি কেউ নয়? তাদের প্রতি কি আমাদের কোনো দায় নেই? মেয়েটি যাকে ‘প্রেম’ ভাবছে, । মোস্তাক সাহেব যেটিকে ‘প্রেম’ বলছেন, সেটি প্রেম নয়, অর্থের বিনিময়ে ক্রয় করা ‘ভোগ’। তাদের আচার-আচরণে তা স্পষ্ট। এটি যদি প্রেম হতো, তাহলে তা বিয়েতেই সীমাবদ্ধ থাকত, এটিকে তারা প্রচার করার চেষ্টা করতেন না। মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে, তাদের নিজেদের মিডিয়ার সামনে উপস্থাপন করে ‘ভাইরাল’ হওয়ার চেষ্টার মধ্যে তাদের ‘ইনফেরিওরিটি কমপ্লেক্স কাজ করছে। এটি অপরাধকে ঢেকে দেওয়ার পরিকল্পিত প্রয়াস।
এ দম্পত্তি আসলে অসুস্থ সমাজের উপজাত। এরা মার্ক টোয়েনের ‘দ্য গিল্ডেড এজ’-এ উপস্থাপিত সমাজের এক স্যাটায়ার চরিত্র। এ দম্পতি একটি ভোগবাদী সমাজের দিকে আমাদের কিশোরী-তরুণীদের আহ্বান করছে। তারা আইডল হলে অবুঝ কিশোরী-তরুণীরা উচ্ছন্নে যাবে। এদের মনস্তাত্ত্বিক কাউন্সেলিং প্রয়োজন। এদের বোঝানো উচিত : বিয়ে করেছ ভালো কথা, সংসার করো; কিন্তু অন্যদের তোমাদের মতো হতে মোটিভেট করো না।
এদের এখনোই থামানো প্রয়োজন; না হলে এ দেশের হাজার হাজার উঠতি বয়সি কন্যার পিতামাতা অসহায় হয়ে পড়বেন; হাজার হাজার নিষ্পাপ কন্যা প্রলোভনে পড়ে বিত্তশালীদের ভোগের পাত্রী হয়ে সর্বস্বান্ত হবে। এ দম্পতির এরূপ অভিনব প্রচারণার নেপথ্যে কোনো আন্তর্জাতিক মাফিয়া চক্রের বড় পরিকল্পনার যোগসূত্র আছে কিনা ভেবে দেখা প্রয়োজন। কারণ, সমাজে এরূপ মূল্যবোধের চর্চা অবাধ হলে ভোগবাদী প্রলোভনের বিকাশ ঘটবে, তাতে ব্লাকমেইলিং, নারী পাচার, অবাধ যৌনতার ক্ষেত্র প্রস্তুত হওয়ার সমূহ আশঙ্কা রয়েছে। সমাজচিন্তকদের এসব নিয়ে ভাবার সময় এসেছে। মনে রাখতে হবে, কোনো কিছু ভাইরাল হয়ে যাওয়া মানেই ‘বৈধতা’ পাওয়া নয়।
পাশাপাশি জনাব মুশতাককে সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দায়িত্বশীল কার্যক্রম থেকে বিচ্ছিন্ন করা প্রয়োজন। কারণ, তিনি ইতোমধ্যেই সমাজকে ভুল বার্তা দিয়েছেন। তিনি একটি মহিলা কলেজের গভর্নিং বডির সদস্য হয়ে যেভাবে একটি কিশোরীর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করেছেন, তা নৈতিকতার বিচারে উত্তীর্ণ হবে কিনা তা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের ভেবে দেখা প্রয়োজন। এখানে তিনি রক্ষক হয়ে ভক্ষকের ভূমিকা পালন করেছেন। এতে প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে। তিনি ব্যক্তিজীবনে সুখী হোন এ কামনা করি, তবে সমাজকে ভুল বার্তা দেওয়ার জন্য তার জবাবদিহিতা প্রয়োজন; কেননা সমাজটা শুধু তার মতো ক্ষমতাবান বিত্তশালীদের নয়, সমাজটা আমাদের সবার। তিনি বিভিন্ন মিডিয়ায় এ সংক্রান্ত বক্তব্য দিয়ে এবং এ সংক্রান্ত বই লিখে ইতোমধ্যেই সমাজে ঝুঁকির আশঙ্কা সৃষ্টি করেছেন, অসংখ্য কন্যার পিতামাতার ঘুম হারাম করে দিয়েছেন। এর মাধ্যমে তিনি উঠতি বয়সি নারীদের ভোগের পাত্রী হতে (হয়তো না বুঝেই) প্রলুব্ধ করেছেন। তিনি আসলে সাহিত্যচর্চার আড়ালে তার অধিকারের সীমা লঙ্ঘন করেছেন। এটি প্রশ্রয়ের যোগ্য নয়।
আসলে মুশতাক-তিশার প্রেমসংক্রান্ত বিষয়ের প্রচারণাগুলো ইতিবাচক নয় মোটেই, এটি এক ধরনের বেহায়াপনা। এটি সনাতন বিবাহব্যবস্থার সুন্দর কাঠামোটিকে নিদারুণভাবে আঘাত করছে। এটিকে জবাবদিহির মধ্যে আনা উচিত। গণমাধ্যম এক্ষেত্রে জোরালো ভূমিকা নিতে পারে। এ অপসংস্কৃতিকে বিকশিত হওয়ার আগেই এর নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কে সমাজকে বার্তা দেওয়া জরুরি।
ড. সৈয়দ আবদুল্লাহ আল মামুন চৌধুরী : সমাজকর্মী; প্রফেসর ও সভাপতি, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।