শর্ত ভেঙে চীনের সিনোফার্মের টি.কার দাম প্রকাশ করার পর কার্যত ক্ষমা চাইতে হয়েছে বাংলাদেশকে। বাড়তি দামে টি.কা কিনতে হবে বলে যে আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল, তারও সমাধানের ইঙ্গিত মিলেছে। গতকাল শনিবার সন্ধ্যায় জানা গেছে, সিনোফার্ম প্রতি ডোজ টি.কা ১০ ডলার হিসাবেই বাংলাদেশকে দিতে রাজি হয়েছে। এদিকে চলতি জুন, জুলাই ও আগস্ট—এই তিন মাসে ৫০ লাখ ডোজ করে মোট দেড় কোটি ডোজ সিনোফার্মের টি.কা পাওয়ার আশা করছে বাংলাদেশ। তবে ঢাকায় চীনের মিশন উপপ্রধান হুয়ালং ইয়ান গতকাল সকালে এক ফেসবুক বার্তায় বলেছেন, গতকাল পর্যন্ত চীনা প্রতিষ্ঠান সিনোফার্মের সঙ্গে বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কোনো চুক্তি হয়নি।
ঢাকায় চীনের রাষ্ট্রদূত লি জিমিং গত মাসে কূটনৈতিক সংবাদদাতাদের সংগঠন ডিকাবের সঙ্গে এক ভার্চুয়াল অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, বাংলাদেশ সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করায় চীনের কাছ থেকে টি.কা কেনার দৌড়ে পিছিয়ে পড়েছে। এরপর গত ২৭ মে সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠক শেষে জানানো হয়েছিল, প্রতি ডোজ ১০ ডলার হিসাবে দেড় কোটি ডোজ সিনোফার্মের টি.কা কিনছে বাংলাদেশ। টি.কার দাম প্রকাশিত হওয়ার পর শ্রীলঙ্কাসহ কয়েকটি দেশে বিতর্ক সৃষ্টি হয়। কারণ ওই দেশগুলো চীনের কাছ থেকে ১০ ডলারের বেশি দামে প্রতি ডোজ টি.কা কিনছে। বিতর্কের মুখে শ্রীলঙ্কার সরকার বলেছিল, সিনোফার্ম ও চীন দূতাবাস তাদের জানিয়েছে যে বাংলাদেশের সঙ্গে ১০ ডলারে টি.কা বিক্রির কোনো চুক্তি তারা করেনি। গতকাল ঢাকায় চীনের মিশন উপপ্রধান হুয়ালং ইয়ানও জানিয়েছেন, টি.কা কেনার কোনো চুক্তি হয়নি। তিনি আরো জানান, বাণিজ্যিকভাবে টি.কা কেনার বিষয়ে চীন সরকারের সঙ্গে নয়, বরং সিনোফার্মের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের আলোচনা চলছে।
চীন গত মাসে বাংলাদেশকে উপহার হিসেবে পাঁচ লাখ ডোজ সিনোফার্মের টি.কা দিয়েছে। গত মাসের শেষের দিকে চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও স্টেট কাউন্সেলর ওয়াং ই পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেনের অনুরোধে বাংলাদেশকে আরো ছয় লাখ ডোজ সিনোফার্মের টি.কা দেওয়ার কথা বলেছিলেন। গতকাল ঢাকায় চীনের মিশন উপপ্রধান হুয়ালং ইয়ান জানান, আগামী ১৩ জুনের মধ্যে ওই ছয় লাখ ডোজ উপহারের টি.কা বাংলাদেশে পাঠানোর জন্য তৈরি হবে। তিনি বলেন, ‘১৩ জুনের মধ্যে উপহার হিসেবে ছয় লাখ ডোজ টি.কা হস্তান্তরের জন্য আমরা তৈরি রয়েছি। তবে বাংলাদেশ কখন তা নেবে, সেটা এখনো ঠিক হয়নি। আশা করছি আগামী কয়েক দিনের মধ্যে এ বিষয়গুলো চূড়ান্ত হয়ে যাবে।’
কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানায়, টি.কা কেনা নিয়ে আলোচনার বিষয়ে গোপনীয়তা রক্ষার শর্ত লঙ্ঘন করার পর পরিস্থিতি জটিল হয়েছিল। সরকার ঢাকায় চীনের রাষ্ট্রদূতকে ডেকে বিষয়টির জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছে। টি.কার দাম গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার বিষয়টি অনিচ্ছাকৃত—এমন ব্যাখ্যা দিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সিনোফার্মকে চিঠি পাঠিয়েছে।
এদিকে বাইডেন প্রশাসন গত বৃহস্পতিবার রাতে ঘোষণা দিয়েছে, চলতি জুন মাসের মধ্যেই তারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশকে আড়াই কোটি ডোজ টি.কা দেবে। ওই টি.কার ৭৫ শতাংশ কোভ্যাক্সের মাধ্যমে দেবে যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশসহ এশিয়ার ১৬টি দেশকে ৭০ লাখ ডোজ টি.কা সরবরাহের কথা বলেছে হোয়াইট হাউস।
ওয়াশিংটন ডিসিতে বাংলাদেশ দূতাবাস তার ফেসবুক পেজে গতকাল ছবিসহ বার্তায় বলেছে, কভিড-১৯ মোকাবেলায় বাংলাদেশের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন বিষয়ক দপ্তর ইউএসএআইডি ত্রাণ পাঠিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এম শহীদুল ইসলাম গতকাল সকালে ক্যালিফোর্নিয়ার ট্রাভিজ বিমান ঘাঁটিতে ত্রাণবাহী ওই সামরিক এয়ারক্রাফটকে বিদায় জানিয়েছেন। আগামী মঙ্গলবার যুক্তরাষ্ট্র থেকে আরেকটি এয়ারক্রাফট আসার কথা রয়েছে।
রাষ্ট্রদূত এম শহীদুল ইসলাম এক টুইট বার্তায় বলেছেন, বাংলাদেশের জন্য ইউএসআইডির ত্রাণ সহায়তার প্রথম চালানকে বিদায় জানাতে তিনি ট্রাভিজ বিমান ঘাঁটিতে গিয়েছিলেন। তিনি আরো লিখেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র সরকারের এই মানবিক সহায়তা কভিড-১৯ মহামারি মোকাবেলায় বাংলাদেশের সামর্থ্যকে ব্যাপকভাবে জোরদার করবে।’
ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসও জানিয়েছে, প্রাণ রক্ষাকারী সরঞ্জামের চালান বাংলাদেশের উদ্দেশে রওনা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিন বলেছেন, ‘বাংলাদেশের সঙ্গে আমাদের অংশীদারিকে আমি খুবই গুরুত্ব দিই। আমি আশা করি, এই সহায়তা আমাদের অত্যন্ত জোরালো ও ক্রমবর্ধমান সম্পর্কের প্রতীক হয়ে থাকবে।’
বিদেশ থেকে বাণিজ্যিকভাবে টি.কা কবে পাওয়া যাবে সে বিষয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট তারিখ জানা যায়নি। ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের কাছ থেকে বাণিজ্যিকভাবে টি.কা কেনার চুক্তি থাকলেও গত মাস থেকে সেই টি.কা সরবরাহ বন্ধ আছে। অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে ভারত নিজেই এখন বিদেশ থেকে টি.কা আমদানি এবং দেশে উৎপাদন বৃদ্ধির চেষ্টা করছে। রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্যিকভাবে টি.কা কেনার চুক্তির বিষয়টি এখনো চূড়ান্ত হয়নি। কভিড টি.কা পাঠাতে বাংলাদেশ যুক্তরাজ্যকেও অনুরোধ করেছিল। যুক্তরাজ্য বেসরকারি খাতের মাধ্যমে যোগাযোগের চেষ্টার পরামর্শ দিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে আগামী কয়েক মাস বাংলাদেশকে কোভ্যাক্সের আওতায় টি.কা সহায়তা এবং যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের টি.কা উপহারের ওপর নির্ভর করতে হবে।
এদিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা গত শুক্রবার সতর্ক করে বলেছে, চলতি জুন ও আগামী জুলাই মাসে কোভ্যাক্সের টি.কার ঘাটতি আছে। এ কারণে টি.কাদান কর্মসূচি বিঘ্নিত হবে। বিশ্বে বিশেষত নিম্ন আয়ের দেশগুলোতে টি.কার ন্যায্য সরবরাহ নিশ্চিত করতে কোভ্যাক্স গঠন করা হয়েছে। এরই মধ্যে বাংলাদেশসহ ১২৯টি দেশে কোভ্যাক্স আট কোটি ডোজ টি.কা সরবরাহ করেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কোভ্যাক্সের দায়িত্ব পালনকারী ব্রুস আইলওয়ার্ড জেনেভায় সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমাদের আরো ২০ কোটি ডোজ প্রয়োজন। উন্নত দেশগুলো এ পর্যন্ত ১৫ কোটি ডোজ দেওয়ার অঙ্গীকার করেছে। তবে এতে সংকট কাটবে না।’
আইলওয়ার্ড বলেন, ‘আমরা ডোজগুলো তাড়াতাড়ি না পেলে টি.কা দেওয়ার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হব। কারণ আমরা এখনো যথাযথ অবস্থায় নেই। আমাদের হাতে যথেষ্ট ডোজ নেই।’
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।