নিজস্ব প্রতিবেদক: অগ্রণী ব্যাংককে সকল সূচকে এগিয়ে নেয়ার মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিকে স্থিতিশীল ও আরও শক্তিশালী করার লক্ষ্যে ২০২২ সালের আগস্টে মো. মুরশেদুল কবীরকে ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহীর দায়িত্ব দেয় সরকার। কিন্তু সরকারের উন্নয়নমুখী লক্ষ্যের বিপরীতে গিয়ে ব্যাংক পরিচালনা করছেন তিনি। তাঁর অব্যাংকারসুলভ আচরণের কারণে ইতোমধ্যে ব্যাংকটির সকল কার্যক্রমে স্থবিরতা নেমে এসেছে, যার সরাসরি প্রভাব পড়ছে বৈশ্বিক পরিস্থিতির কারণে চাপে থাকা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে।
গত এক বছরের দায়ীত্ব পালনকালে কোনও লক্ষ্যই পূরণ করতে পারেননি মুরশেদুল কবীর। বরং তাঁর অসহযোগিতার কারণে দেশের স্বনামধন্য অনেকগুলো ব্যবসায়িক গ্রুপ অগ্রণী ব্যাংক ছেড়ে গেছে, যাদের ব্যাংকিং লেনদেনের ইতিহাস পরিচ্ছন্ন।
এছাড়া, সমস্যাগ্রস্ত গ্রাহকদের যথাযথ পরিচর্যার অভাবে সেগুলো আরও খারাপ অবস্থায় গিয়ে ঝুঁকি বাড়াচ্ছে ব্যাংকের।
এসব কারণে খেলাপি ঋণ আদায়ে বাংলাদেশ ব্যাংক যে লক্ষ্য বেধে দিয়েছিল তার ধারে-কাছেও নেই মুরশেদুল কবীর। পাশাপাশি অন্য সকল সূচকেও দিন দিন পিছিয়ে যাচ্ছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকটি। যে কারণে গত ২৭ সেপ্টেম্বর অগ্রণী ব্যাংকের বর্তমান পরিস্থিতিতে হতাশা ব্যক্ত করে উন্নতির নির্দেশ দিয়েছেন গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। পর্যবেক্ষকদের সাথে সভায় এই নির্দেশ দেন তিনি।
বর্তমানে ব্যাংক খাতের সবচেয়ে বড় সংকট হিসেবে চিহ্নিত খেলাপি ঋণ আদায়ের পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করলেই মুরশেদুল কবীরের ব্যর্থতা স্পষ্ট হয়। বর্তমানে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১৫ হাজার কোটি টাকার বেশি যা দেশের ব্যাংক খাতের মোট খেলাপির ১০ শতাংশ; অন্যদিকে ব্যাংকটির বিতরণকৃত ঋণের ২২ শতাংশ।
চলতি বছরের জুনের মধ্যে ৭শ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ আদায়ের লক্ষ্য বেধে দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু তিনি আদায় করতে সক্ষম হয়েছেন মাত্র ২২৩ কোটি টাকা। এছাড়া খেলাপি কমিয়ে ১৪ হাজার কোটির মধ্যে নামিয়ে আনার নির্দেশনা থাকলেও সেখানেও ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন মুরশেদুল কবীর।
গত বছরও লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারেননি অগ্রণী এমডি। গত বছরের ডিসেম্বর শেষে শীর্ষ খেলাপি থেকে ৩শ কোটি টাকা আদায়ের লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে আদায় করেছেন মাত্র ৯৭ কোটি টাকা। অন্যান্য খেলাপি থেকে ৭শ কোটি টাকা আদায়ের লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে আদায় হয়েছে ২৬০ কোটি টাকা। অবলোপনকৃত ঋণ থেকে আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পেরেছেন মাত্র ২১ দশমিক ৭৩ শতাংশ।
এছাড়া ব্যাংকটির আমানতও ধরে রাখতে পারেননি এমডি। আমানতের হিসেবে লাখ কোটি টাকার ক্লাবের তৃতীয় ব্যাংক ছিল অগ্রণী। কিন্তু মুরশেদুল কবীরের অসহযোগিতার কারণে অনেকেই আমানত তুলে নিয়েছেন। যে কারণে বর্তমানে ৯৭ হাজার কোটি টাকায় নেমেছে ব্যাংকটির আমানত।
অগ্রণী ব্যাংকের এমন পতনের কারণ অনুসন্ধানে ব্যাংকটির মাথায়ই ‘পচন’ ধরার ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। ব্যাংকের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শাখাগুলোকে ঋণ দিতে অনুৎসাহিত করেন মুরশেদুল কবীর। কেউ ঋণ প্রস্তাবনা নিয়ে গেলে তাকে ফিরিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, ‘তোমরা তো মাস শেষে নিয়মিত বেতন পাচ্ছ। তাহলে ঋণ দিতে চাচ্ছ কেন? বণ্ডে বিনিয়োগ থেকে আমাদের যে মুনাফা আসে তা দিয়েই সবার বেতন হয়ে যায়। তাই শুধু শুধু ঝুঁকি নেওয়ার কারণ নেই।’
ব্যাংক কর্তকর্তারা জানান, বাণিজ্যিক ব্যাংকের দায়িত্বই হচ্ছে মানুষের কাছ থেকে আমানত নিয়ে সেটা বিনিয়োগ করার মাধ্যমে মুনাফা করা। এতে দেশের অর্থনীতিও যেমন শক্তিশালী হয়, তেমনি ব্যাংকও ব্যবসা করতে পারে। এখন বিনিয়োগ করতে না পারলেও আমানতকারীদের ঠিকই মাসে মাসে মুনাফা দিতে হবে। এতে শাখাগুলো শিগগিরই লোকসানে চলে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
মুরশেদুল কবীরের বক্তব্যের মিল পাওয়া যায় সাব-অর্ডিন্যান্ট বন্ডে ব্যাংকটির বিনিয়োগের হিসাব বিশ্লেষণেই। বর্তমানে ৩০টি ব্যাংকের বন্ডে ৬ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ রয়েছে অগ্রণীর, যেগুলোর ইস্যু ম্যানেজার স্টান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক ও সিটি ক্যাপিটাল। এখান থেকে বছরে গড়ে ৫শ কোটি টাকা মুনাফা পায় ব্যাংকটি। অন্যদিকে নিজেদের ১১ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারির বেতন বাবদ বছরে খরচ যায় ৪৫৬ কোটি টাকা।
নেতিবাচক ব্যাংকিং কার্যক্রমের বিষয়ে বক্তব্য জানতে মো. মুরশেদুল কবীরের কার্যালয়ে দুইদিন গেলেও তিনি সাক্ষাৎ প্রদান করেননি। প্রথম দিন ব্যাংকের মিটিং এর কথা বলে সাক্ষাৎ প্রদান না করলেও তাঁর দপ্তরের কর্মকর্তাদের কাছ থেকে জানা যায়, ভেতরে বাইরের লোকজন বসে আড্ডা দিচ্ছেন।
দ্বিতীয় দিন তাঁর কার্যালয়ে গেলে জানানো হয়, এমডি নামাজে গেছে। নামাজ থেকে ফেরার পথে প্রতিবেদকের সাথে সাক্ষাৎ হলে তিনি দৌঁড়ে নিজের অফিস কক্ষে ঢুকে যান। এরপর অনেক্ষণ অপেক্ষা করলেও আর সাক্ষাৎ দেননি।
ব্যাংকটির চেয়ারম্যান ড. জায়েদ বখতের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বর্তমানে অগ্রণী ব্যাংকের বন্ডের আয়ের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ার বিষয়টি স্বীকার করেন।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।