জুমবাংলা ডেস্ক : ঝিনাইদহ-৪ (কালীগঞ্জ) আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনারকে হত্যার নেপথ্যে শুধু তাঁর বাল্যবন্ধু আখতারুজ্জামান শাহীনই নন, আরো কেউ আছে—এ ব্যাপারে তদন্ত শুরু হয়েছে। ঘটনার তদন্তে মূলত তিনটি কারণকে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছেন গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় বাংলাদেশ ও ভারতে এক নারীসহ চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাঁদের সবাইকে আদালতের মাধ্যমে বিভিন্ন মেয়াদে রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিরা হত্যার ঘটনার লোমহর্ষক বর্ণনা দিয়েছেন বলে জানান গোয়েন্দা কর্মকর্তারা।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা শাখা (ডিবি) সূত্রে জানা যায়, এমপি আনার হত্যাকাণ্ডে সরাসরি অংশ নেওয়া সবাই নিষিদ্ধ চরমপন্থী সংগঠন পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য। মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে তাঁদের হত্যাকাণ্ডে ব্যবহার করেন ঘটনার মূল পরিকল্পনাকারী আখতারুজ্জামান শাহীন। আলোচিত এই হত্যার পেছনে কোটি কোটি টাকার স্বার্থসংশ্লিষ্ট দ্বন্দ্ব রয়েছে বলে মনে করছেন তদন্তসংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা কর্মকর্তারা।
তাঁরা বলছেন, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের অনেক নেতার পাশাপাশি সংঘবদ্ধ চোরাকারবারি দলের শীর্ষ সন্ত্রাসীরাও এমপি আনার হত্যার নেপথ্যে কলকাঠি নাড়তে পারে বলে তথ্য পেয়ে যাচাই করছেন তাঁরা। তাদের তালিকা করে প্রত্যেককে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
ডিবি বলছে, তদন্তে এ পর্যন্ত যেসব তথ্য পাওয়া গেছে, সে অনুযায়ী তিনটি কারণে এমপি আনারকে খুন করা হতে পারে। এর মধ্যে রয়েছে আখতারুজ্জামানের সঙ্গে সোনা চোরাচালানসহ বিভিন্ন ব্যবসার আর্থিক লেনদেন নিয়ে বিরোধ, রাজনৈতিক মতাদর্শ নিয়ে বিরোধ এবং নিষিদ্ধ চরমপন্থী সংগঠনের অনেকের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের তথ্য জানা। এই তিনটি বিষয়কে মূল কারণ ধরে অন্যান্য কারণ জানার চেষ্টা করছেন গোয়েন্দা কর্মকর্তারা।
জানতে চাইলে ডিবি প্রধান পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, এমপি আনার হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে কী কী কারণ রয়েছে, তা জানার চেষ্টা করছেন তাঁরা। হত্যায় জড়িত অন্যদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে।
তিনি বলেন, খুনি ও পরিকল্পনাকারীদের আসল উদ্দেশ্য ছিল লাশ গুম করা। তদন্ত কর্মকর্তারা যাতে কোনো ডিভাইস খুঁজে না পান, আবার ভারতীয় পুলিশের নজরও যেন বাংলাদেশে না আসে, সে ব্যবস্থায় তৎপর ছিল তারা।
প্রাথমিক তদন্তে যা পেয়েছে ডিবি
ডিবি বলছে, ব্যাবসায়িক লেনদেনের কিছু বিষয় নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে এমপি আনার ও আক্তারুজ্জামানের মধ্যে আড়ালে দ্বন্দ্ব চলছিল। এ ছাড়া আমান উল্লাহ ওরফে শিমুল ভূঁইয়ার সঙ্গে মতাদর্শ নিয়ে বিরোধ ছিল এমপি আনারের। তাই উভয়ে আনারকে দেশের বাইরে নিয়ে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করেন।
ডিবির এক কর্মকর্তা বলেন, এ ঘটনায় গ্রেপ্তারকৃতরা এরই মধ্যে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন। তবে আক্তারুজ্জামানকে গ্রেপ্তার করতে পারলে হত্যাকাণ্ডের মোটিভ স্পষ্ট হবে। এ পর্যন্ত এমপি আনার ও শাহীনের বন্ধুরা তাঁদের মধ্যে কোটি কোটি টাকা লেনদেনের তথ্য দিয়েছেন। জিজ্ঞাসাবাদে শিমুলও একই তথ্য দেন।
এসব তথ্য জানিয়ে ডিবি কর্মকর্তারা বলছেন, তদন্তের প্রয়োজনে তাঁরা কলকাতায় গিয়ে এমপি আনারের বন্ধু গোপাল বিশ্বাসকেও জিজ্ঞাসাবাদ করবেন। হত্যাকাণ্ডে সরাসরি জড়িত অন্যদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে। এর মধ্যে জিহাদ কলকাতায় গ্রেপ্তার হয়েছেন।
ঢাকায় গ্রেপ্তার তিনজন ৮ দিনের রিমান্ডে
এমপি আনার হত্যার ঘটনায় গ্রেপ্তার তিন আসামিকে আট দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার অনুমতি পেয়েছে গোয়েন্দা পুলিশ। তাঁরা হলেন হত্যাকাণ্ডে সরাসরি অংশ নেওয়া নিষিদ্ধঘোষিত পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির আঞ্চলিক নেতা আমান উল্লাহ ওরফে শিমুল ভূঁইয়া, তাঁর সহযোগী ফয়সাল আলী ওরফে সাজিব এবং হত্যার পরিকল্পনাকারী আখতারুজ্জামানের বান্ধবী শিলাস্তি রহমান। এই তিনজনকে রাজধানীর শেরেবাংলানগর থানায় এমপি অনারের মেয়ে ডরিনের করা মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। গতকাল দুপুর আড়াইটার দিকে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে তিনজনকে হাজির করে ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন জানানো হয়। শুনানি শেষে তিন আসামির প্রত্যেককে আট দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি দেন আদালত। আদালতে পুলিশের সাধারণ নিবন্ধন কর্মকর্তা এসআই জালাল উদ্দিন এসব তথ্য দেন।
জিজ্ঞাসাবাদে শিলাস্তি যা বলেছেন
জিজ্ঞাসাবাদে শিলাস্তি রহমানের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের বরাতে ডিবি সূত্র জানায়, শাহীনকে তিনি আঙ্কেল ডাকেন বলে জানিয়েছেন। শিলাস্তির ভাষ্য অনুযায়ী, ঘুরে বেড়ানো এবং কেনাকাটা করে দেওয়ার কথা বলে শাহীন তাঁকে কলকাতা নিয়ে যান। শিলাস্তির দাবি, খুনের ঘটনার সময় তিনি ডুপ্লেক্স ফ্ল্যাটের ওপরে ছিলেন। তবে তদন্তে উঠে এসেছে, এমপি আনারকে যখন খুনিরা ওই ফ্ল্যাটে নিয়ে আসে, তখন দরজা খুলে দেন শিলাস্তি। পরে যখন ডুপ্লেক্স ফ্ল্যাটের নিচতলার কোণের একটি কক্ষ থেকে ব্লিচিং পাউডারের গন্ধ আসে, তখন তিনি বিষয়টি নিয়ে আমান ও অন্যদের জিজ্ঞাসা করেন। তাঁরা ফ্লোরের ময়লা পরিষ্কার করেছেন বলে জানান।
ডিবি বলছে, শিলাস্তির আচরণ রহস্যজনক। তাঁর গ্রামের বাড়ি টাঙ্গাইলের নাগরপুরে। ঢাকার উত্তরায় একটি ফ্ল্যাটে থাকতেন তিনি। এক বন্ধুর মাধ্যমে শাহীনের সঙ্গে তাঁর পরিচয়।
শিলাস্তি এই খুনের ঘটনা আগে থেকে জানতেন কি না, তা জানার জন্য তাঁকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে জানিয়ে গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, শিলাস্তি অনেক চতুর। এমপি আনার হত্যাকারীদের সঙ্গে ভারতে গেলেও এখন তিনি সব কিছু অস্বীকার করছেন।
সিসিটিভি ফুটেজে যা দেখা গেছে
ভারতীয় গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের উদ্ধার করা সিসিটিভির একটি ফুটেজে দেখা যায়, ১৩ মে দুপুরে ২টা ৫৩ মিনিটে সঞ্জিভা গার্ডেনসের ওই ফ্ল্যাটের সামনে হাজির হন তিন ব্যক্তি। এ সময় ভেতরে অবস্থান করা কেউ একজন দরজা খুলে দিলে জুতা খুলে একে একে ভেতরে প্রবেশ করেন তাঁরা। ছবিতে দেখা ওই তিন ব্যক্তির পরিচয় মিলেছে। তাঁদের একজন সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনার। অন্য দুজন ফয়সাল ও ঢাকায় গ্রেপ্তার আমান উল্লাহ।
আরেকটি সিসিটিভির ফুটেজে দেখা যায়, একই ফ্ল্যাট থেকে বের হচ্ছেন দুজন। তবে এবার তাঁদের সঙ্গে নেই সংসদ সদস্য আনার। দুজনের সঙ্গে পেস্ট কালারের একটি লাগেজ দেখা যায়। তাঁদের একজন আমান উল্লাহ এবং অন্যজন ভারতীয় পুলিশের হাতে সম্প্রতি গ্রেপ্তার জাহিদ। তাঁদের হাতে বেশ কয়েকটি শপিং ব্যাগও দেখা যায়। এরপর লিফটের সামনে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে নিচে নেমে আসেন তাঁরা।
কসাই জিহাদের মুখে মরদেহ টুকরা করার বর্ণনা
এমপি আনারকে হত্যায় অংশ নেওয়া জিহাদ নামের ব্যক্তি পেশায় একজন কসাই বলে তদন্তে উঠে এসেছে। তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদে ১২ দিনের রিমান্ড দিয়েছেন কলকাতার বারাসাতের আদালত। গতকাল সকাল ১১টার দিকে তাঁকে উত্তর চব্বিশ পরগনার বারাসাত আদালতে তোলা হয়। পুলিশ ১৪ দিনের রিমান্ড আবেদন জানালে আদালত ১২ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
ভারতের সিআইডির এক শীর্ষ কর্মকর্তা ডিবিকে জানান, আখতারুজ্জামান শাহীনের নির্দেশে ওই ফ্ল্যাটে জিহাদসহ আরো চারজন এমপি আনারকে শ্বাসরোধে খুন করেন। হত্যার পর প্রথমে মরদেহের শরীর থেকে চামড়া ছাড়িয়ে নেওয়া হয়। এরপর হাড় থেকে মাংস আলাদা করে ছোট ছোট করে টুকরা করা হয়, যাতে চেনা না যায়। এরপর টুকরাগুলো পলিথিনে ভরা হয়। পরে হাড়গুলোও ছোট ছোট টুকরা করা হয়। জিহাদের দেওয়া তথ্য তথ্যের বরাতে গোয়েন্দারা বলছেন, পলিথিনে ভরে হাড় ও মাংসের টুকরাগুলো বিভিন্নভাবে কলকাতার ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় ফেলে আসা হয়।
পশ্চিমবঙ্গ সিআইডি এরই মধ্যে পোলেরহাট থানার কৃষ্ণবাটি সেতুর কাছে বাগজোলা খালে তল্লাশি চালিয়েছে। খালটি নিউটাউন এলাকার ওই ফ্ল্যাটের সামনে দিয়ে বয়ে গেছে। তবে সেখানে কিছু পাওয়া যায়নি বলে সিআইডি জানিয়েছে।
ঢাকায় গ্রেপ্তার তিনজনকে ভারতীয় গোয়েন্দাদের জিজ্ঞাসাবাদ
ভারত থেকে আসা চার তদন্ত কর্মকর্তা গত বৃহস্পতিবার রাতে মিন্টো রোডের গোয়েন্দা কার্যালয়ে গ্রেপ্তার তিন সন্দেহভাজনের সঙ্গে কথা বলেছেন। পরে এ বিষয়ে ডিবি প্রধান হারুন অর রশীদ বলেন, ডিবি হেফাজতে থাকা সন্দেহভাজন ব্যক্তিরা ডিবির কাছে ঘটনার যে বর্ণনা দিয়েছিলেন, সেই একই বর্ণনা ভারতের তদন্ত কর্মকর্তাদের কাছেও দিয়েছেন।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।