পটুয়াখালীর কলাপাড়া ১১ বছর আগেই বাংলাদেশে সর্বপ্রথম স্থাপিত হয় ‘পানি জাদুঘর’। কলাপাড়ার সবজির ভারখ্যাত নীলগঞ্জ ইউনিয়নের পাখিমারায় এ জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করা হয়। কুয়াকাটায় যেতে সড়কের ডান পাশেই এর অবস্থান। ভিন্নধারার বৈচিত্র্যে সাজানো এ জাদুঘরটি প্রতিষ্ঠার পর থেকে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার দর্শনার্থীর আনাগোনা রয়েছে। নদী ও পানি সম্পর্কিত নতুন কিছু জানার সুযোগ রয়েছে এখানে।
নদী ও পানি সম্পদ রক্ষায় সরকার ও নীতি নির্ধারকদের আরও উদ্যোগী করা। মানুষকে সচেতন করা এবং নদী ও পানি সম্পদ রক্ষার আন্দোলনকে শক্তিশালী করতে ‘পানি জাদুঘরের’ প্রতিষ্ঠা করা হয়। নদীমাতৃক বাংলাদেশের ইতিহাস ঐতিহ্যের প্রধান ধারক নদী ও পানি সম্পদ। দেশটিতে রয়েছে নদী ও পানির সঙ্গে মানুষের জীবন-জীবিকার অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কের ধারাবাহিকতা। কিন্তু জলবায়ুর দ্রুত পরিবর্তনজনিত কারণে নদী ভরাট হয়ে গেছে। মানুষের দখল দৌরাত্ম্যে নদী হারিয়ে গেছে।
জাদুঘরটির সামনে স্থান পেয়েছে নদীপথে অপরিকল্পিতভাবে বাঁধ দেওয়ায় পানির প্রবাহ থমকে পরিণত হওয়া বালুরচরের দৃশ্য। যেখানে শোভা পাচ্ছে নদীতে নৌকা চলাচলের পথ স্থায়ীভাবে রুদ্ধ হয়ে যাওয়ার দৃশ্যপট। বিশুদ্ধ পানি ব্যবহারের পরামর্শ রয়েছে জাদুঘরের মূল দরজায়। জাদুঘরে রাখা হয়েছে দেশের প্রধান মেঘনা, হালদা, গড়াই, বুড়িগঙ্গা, পায়রা, যমুনা, পদ্মা, তিস্তা, কীর্তনখোলা, আন্ধারমানিক নদী থেকে সংগৃহীত পানির নমুনা। মোট ৮৯টি নদীর পানির নমুনা রাখা হয়েছে। যেখানে ১১টি বহির্দেশের নদীর পানি। ৫৭টি আন্তঃদেশীয় নদী ও বাকিসব দেশের বিভিন্ন নদীর পানি রাখা হয়েছে।
নদীপথে চলা নৌকা। নদীর পানি ব্যবহারের দৃশ্যপট। নদীকেন্দ্রিক জীবন-জীবিকার বিভিন্ন উপকরণ- মাছ ধরার চাঁই, বিভিন্ন ধরনের জাল, ঝুড়ি, খাড়ই, কাঠের সামগ্রী শোভা পাচ্ছে। রয়েছে নদীপথে চলাচল করা বিভিন্ন ডিজাইনের নৌকার চলাচল। আঞ্চলিক নদীপথ ও তার ওপরে সরকারের চলমান ব্রিজ নির্মাণের দৃশ্যপটসহ সামাজিক ম্যাপ উপস্থাপিত রয়েছে। রয়েছে দেশ-বিদেশের নদীর পরিসংখ্যান। নদীপথের নিয়ন্ত্রক দেশের নামসমূহ। নদীর উৎসস্থল।
জাদুঘরের তথ্যভান্ডার থেকে জানা গেল, বাংলাদেশে ছোট-বড় প্রায় ৭০০ নদী রয়েছে। শত বছর আগে এর সংখ্যা ছিল দ্বিগুণ। নদীর সংখ্যা কমায় নদী তীরবর্তী মানুষের জীবন-জীবিকা, সংস্কৃতি, ইতিহাস-ঐতিহ্যেরও ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। বাঁধ, দখল-দূষণসহ নানা কারণে নদী হারিয়ে যাওয়ায় জীবন-জীবিকায় ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। বাংলাদেশের পানি সম্পদ ও নদীকে বাঁচাতে নাগরিক সমাজ, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠন নানা ঘোষণায় এর গুরুত্ব তুলে ধরেছেন। কিন্তু সরকারের উদ্যোগ রয়েছে সীমিত পরিসরে। এরই প্রেক্ষাপটে নদী ও পানি সম্পদ রক্ষায় উন্নত ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলার লক্ষ্যে পানি জাদুঘর গড়ে তোলা হয়েছে।
পানি জাদুঘরটি প্রতিষ্ঠার কারণে মানুষ নদীর প্রয়োজনীয়তা, নদী ভরাট হওয়ায় বিপর্যয়ক্ষেত্রসমূহের ভয়াবহতা দেখতে ও জানতে পারছেন। ফলে নদী ও পানি সম্পদ রক্ষায় সরকার ও নীতিনির্ধারক মহল আরও উদ্যোগী ভূমিকায় অবতীর্ণ হবেন। এ ছাড়া সাধারণ মানুষ সচেতন হচ্ছেন। এসব বাস্তবতা দৃশ্যমান করতেই এ জাদুঘর নির্মিত হয়েছে। পানি সম্পদ রক্ষার আন্দোলনকে আরও শক্তিশালী করছে এ জাদুঘরটি প্রতিষ্ঠার কারণে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের প্রফেসর ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, ‘নদী মরে গেলে বাংলাদেশ মরে যাবে। কারণ পানি ও নদীর জন্যই বেঁচে আছে বাংলাদেশ। অথচ মানুষই এই নদীগুলোকে মেরে ফেলছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘পানি জাদুঘরে মূলত এই বিষয়গুলো তুলে ধরা হয়েছে। নদীর কথা, পানির কথাকে উপজীব্য করে এই পানি জাদুঘর। এই জাদুঘর, মানুষকে, সরকারকে, নতুন প্রজন্মকে সচেতন করবে’। এই গুণী শিক্ষক ২০১৪ সালে জাদুঘরটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। উন্নয়ন সংস্থা একশন এইড বাংলাদেশ এটিা প্রতিষ্ঠা করেন। স্থানীয় সংস্থা উপকূলীয় জনকল্যাণ সংঘ তাদের নিজস্ব জমিতে এবং ঘরে এটি প্রতিষ্ঠা করেছেন।
বাঁধ, পরিবেশগত বিপর্যয়সহ নানা করণে নদী মরে গেছে, মরে যাচ্ছে। নদীর গতিপথ পরিবর্তন হচ্ছে দিনকে দিন। এর ফলে নদী পাড়ের মানুষের জীবন-জীবিকার ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়েছে। আমরা চাই নদীকে নদীর মত বাঁচতে দিতে। তাই এখনই উদ্যোগ নিতে হবে। সেজন্য সচেতন হতে হবে আমাদেরই। সে কারণেই এই পানি জাদুঘর। এমনসব লেখা শোভা পাচ্ছে জাদুঘরের অভ্যন্তরে।
উপকূলীয় জনকল্যাণ সংঘের সভাপতি জয়নাল আবেদীন জানান, মানুষ জীব-জন্তু কিংবা পশু-পাখির জাদুঘর দেখেছে। কিন্তু পানি জাদুঘরের নাম আগে কেউ শোনেনি। এর গুরুত্ব বোঝা তাদের মতো সাধারণ মানুষের জন্য খুবই জরুরি। তিনি এটি সংস্কারের দাবি জানান।
জাদুঘরটির তত্ত্বাবধায়ক লিপি মিত্র জানান, এখানে জনপ্রতি মাত্র ২০ টাকায় দর্শনার্থীরা এটি পরিদর্শন করতে পারেন। তবে বর্তমানে দর্শনার্থীর সংখ্যা অনেক কমে গেছে। এটি শোভা বর্ধনে প্রবেশপথসহ কিছু অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রয়োজন। প্রয়োজন একটু সংস্কারের। তিনি আরও জানান, কুয়াকাটা আসা পর্যটক যাদের প্রাইভেট কার রয়েছে তারাই এটি দেখার সুযোগ পান। বাসযোগে আসা পর্যটকদের সেই সুযোগ থাকে না। এজন্য এটি একটি মনোরম স্থানে স্থানান্তর করা দরকার বলে সে মতামত ব্যক্ত করেন।
পটুয়াখালীর জেলা প্রশাসক আবু হাসনাত মোহাম্মদ আরেফীন গত ৮ নভেম্বর জাদুঘরটি পরিদর্শনকালে পরিদর্শন বইতে লিখেছেন, ‘জাদুঘরটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। দেশের ইতিহাস ঐতিহ্যেও সঙ্গে নদীগুলোর সম্পর্ক নিপুণভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। জলাবায়ু পরিবর্তন, অবকাঠামো নির্মাণ ও দূষণের ফলে নদীগুলো কিভাবে ধ্বংস হচ্ছে তা তুলে ধরা হয়েছে।’
ব্যতিক্রমধর্মী পানি জাদুঘরটির সুবাদে শুধু স্থানীয় জনগোষ্ঠী ছাড়াও কুয়াকাটাগামী পর্যটক-দর্শনার্থী ক্ষণিকের জন্য থমকে দাঁড়ায়। ঘুরে-ফিরে দেখেন আগতরা জাদুঘরটির ভেতর-বাইরে। জানতে চাচ্ছেন কেনইবা পানি জাদুঘর। তবে এটি একটি জনসমাগম এলাকায় স্থানান্তর করার দাবি সকলের। কলাপাড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ভারপ্রাপ্ত) মো. ইয়াসীন সাদেক জানান, তিনি বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করবেন।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।