শিলু হোসেন : উত্তর তুরস্কের ঐতিহাসিক শহর সাফরানবোলু। কৃষ্ণসাগরের কাছাকাছি কারাবুক প্রদেশের এই শহরের নাম মহামূল্যবান ভেষজ জাফরান থেকে নেওয়া। পরিপাটি সাফরানবোলুতে সব ছাপিয়ে নজর কাড়ে কাঠের তৈরি শত শত অট্টালিকা, যেগুলো শহরের বিচিত্র গলিপথে আপনার চোখ আটকে দেবে। উজ্জ্বল সাদা পাথরের সম্মুখভাগ, লাল ত্রিকোণ ধার এবং বাদামি গরাদবিহীন জানালার দিকে তাকালে রূপকথার মতো মনে হয়। এসব অট্টালিকার বয়স ৩০০ বছরের বেশি।
সাফরানবোলুর বাসিন্দাদের পরিবেশ ও প্রতিবেশ জ্ঞান প্রশংসনীয়। পরিবেশের সঙ্গে ভারসাম্য রেখে চলার চেষ্টা করেন তাঁরা। গ্রীষ্মে এখানকার কোনো ভবনে ঢুকলেই ঠান্ডা হাওয়ায় প্রাণ জুড়িয়ে যায়। প্রথমে মনে হয়, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্র দিয়ে এই হাওয়া আসছে। আসলে তা নয়। এখানকার ভবনগুলো এমনভাবে তৈরি, ফ্যান বা এসি ছাড়াই গ্রীষ্মে শীতল এবং শীতকালে থাকে উষ্ণ।
সাফরানবোলু ছিল চীন ও পশ্চিমের মধ্যে প্রাচীন বাণিজ্য পথ সিল্ক রোড বরাবর কাফেলা থামার একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। শহরটি ক্রমবর্ধমান জাফরান বাণিজ্যের জন্য পরিচিত ছিল। ১৮ শতকে এটি গুরুত্বপূর্ণ অটোমান শহরে পরিণত হয়। এর পাথরের রাস্তাগুলোর মসজিদ, হাম্মাম এবং ঐতিহ্যবাহী তুর্কি অট্টালিকাগুলোকে কোনাক্লার (একবচন কনক) বলে।
সাফরানবোলুতে এখন দুই হাজারেরও বেশি অটোমান যুগের কনক বা অট্টালিকা রয়েছে। এর অনেকটাতে স্থানীয়দের বসবাস। অনেক ভবনকে রূপান্তর করা হয়েছে বুটিক হোটেল (পরিশীলিত ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান), রেস্তোরাঁ, ক্যাফে ও জাদুঘরে। ১৮ শতকে তৈরি এসব অট্টালিকার কারণে ১৯৯৪ সালে পুরো শহরকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট বা বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান ঘোষণা করে ইউনেস্কো। এসব অট্টালিকা শুধু দেখতেই সুন্দর না, টেকসই স্থাপত্য এবং সামাজিকভাবে দায়িত্বশীল ভবনের নকশার অনন্য উদাহরণ।
সাফরানবোলুর একটি হোটেল চামলিকা কোনাগি। এর বয়সও ৩০০ বছরের বেশি। পরে এটি হোটেলে রূপান্তর করা হয়। ভবনটির হলওয়ের দেয়াল সাদামাটা পাথরে তৈরি। এর ভেতরে ঢুকতেই শীতল বাতাস গায়ে লাগে। প্রশস্ত পাথরের হলওয়ে দিয়ে হাঁটলে বোঝা যায়, এই অট্টালিকায় গরমের দিনে কত দারুণভাবে বায়ু চলাচল করে। হোটেলের মালিক ওজলেম ওজেন বলেন, সাফরানবোলুর প্রতিটি ঘর গ্রীষ্মে শীতল এবং শীতকালে উষ্ণ রাখার উপযোগী নকশায় তৈরি করা হয়েছে।
সাফরানবোলুর রয়েছে অনন্য ভূসংস্থান ও জলবায়ু। এখানকার গ্রীষ্মকাল শান্তিদায়ক ও পরিচ্ছন্ন এবং শীতকাল ঠান্ডা ও তুষারময়। স্থানীয় স্থপতি ফাতিহ ডকমেসি সাফরানবোলুতে গত ২০ বছরে চামলিকা কোনাগিসহ ১০০টিরও বেশি কোনাক্লার পুনরুদ্ধার করেছেন। তিনি বলেন, আমাদের বাড়িগুলো স্থানীয় কাঠ ও পাথর দিয়ে তৈরি, যা পরিবেশের ক্ষতি না করেই ঋতুজুড়ে চমৎকারভাবে তাপনিরোধক করে।
কায়কামলার এভি হাউস মিউজিয়াম একটি পুরোনো কোনাক থেকে রূপান্তরিত জাদুঘর। লম্বা পাথরের দেয়াল, স্থানীয় কাঠের প্রচুর ব্যবহার এবং একটি বিস্তৃত বসার কক্ষসহ ভবনটি ছিল অটোমান পরিবেশসম্মত নকশার নিখুঁত উপস্থাপনা।
তুরস্কের রাজধানী আঙ্কারার কানকায়া বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগের প্রধান অধ্যাপক গুলসু উলুকাভাক হারপুটলুগিল বলেন, সাফরানবোলুর লোকেরা আশপাশের লোকদের কথা ভেবে বাড়ি তৈরি করেন। কেউ কারও ভবনের জন্য সূর্যের আলো কিংবা বাতাস থেকে বঞ্চিত হয় না। আঁটসাঁট রাস্তার ধারেও এমনভাবে বাড়ি তৈরি করা, যাতে কোনো প্রাণী বা গাড়ি চলাচল করতে পারে। এগুলো পরিবেশ ও স্থানীয় সম্প্রদায়ের প্রতি শ্রদ্ধাশীল মনোভাব প্রকাশ করে। সূত্র : বিবিসি।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।