ফারুক তাহের, চট্টগ্রাম: চীনের সাংহাই শহরের আদলে বন্দরনগরী চট্টগ্রামকে ‘ওয়ান সিটি টু টাউন’ মডেলে গড়ে তুলতে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণ করেছে সরকার।
দেশের প্রথম এই সুড়ঙ্গপথের নামকরণ করা হয়েছে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল’।
চীনের সবচেয়ে বড় ও জনবহুল নগরী সাংহাই পরিচিত ‘ওয়ান সিটি টু টাউন’ হিসেবে। দেশটির এই শিল্প ও বাণিজ্য কেন্দ্রকে দুই ভাগে ভাগ করেছে চ্যাং জিয়াং নদীর উপনদী হুয়াংপু, নেদীতে নির্মিত টানেল যুক্ত করেছে দুই পাড়কে। সাংহাই সমুদ্রবন্দর বর্তমান বিশ্বের ব্যস্ততম সমুদ্রবন্দর, সবচেয়ে বড় সমুদ্রবন্দরগুলোরও একটি। আর সাংহাইয়ের মতো ভৌগোলিক অবস্থা বন্দরনগরী চট্টগ্রাম এবং কর্ণফুলী নদীর ওপারের আনোয়ারা উপজেলার।
ধারণা করা হচ্ছে, স্বপ্নের এই টানেল চালু হলে কর্ণফুলী নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠবে সাংহাইয়ের মতো ওয়ান সিটি টু টাউন। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা কক্সবাজার ও দক্ষিণ চট্টগ্রামগামী গাড়িগুলোকে আর বন্দরনগরীতে ঢুকতে হবে না। চট্টগ্রাম সিটি আউটার রিং রোড হয়ে টানেলের মাধ্যমে দ্রুত সময়ের মধ্যে গস্তব্যে পৌঁছাতে পারবে। ফলে চট্টগ্রাম নগরে যানবাহনের চাপ কমে যাবে। টানেলকে ঘিরে চট্টগ্রাম-কক্সবাজারের পর্যটনশিল্পের আরও বিকাশ ঘটবে। দেশিয় পর্যটকের পাশাপাশি বিদেশি পর্যটক বাড়বে এবং এতে রাজস্ব আয় বৃদ্ধি পাবে।
এ ছাড়া কক্সবাজারের মহেশখালীর মাতারবাড়ী এলাকায় দেশের প্রথম গভীর সমুদ্রবন্দর হচ্ছে। বাঁশখালীতে হচ্ছে কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র। মহেশখালীতে হয়েছে এলএনজি স্টেশন। আনোয়ারায় হচ্ছে বৃহৎ অর্থনৈতিক অঞ্চল। এসব মেগা প্রজেক্টের সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক ভূমিকা রাখবে বঙ্গবন্ধু টানেল।
চট্টগ্রাম বিমানবন্দর এলাকা থেকে কর্ণফুলী নদীর দুই কিলোমিটার ভাটির দিকে নেভি কলেজের কাছ দিয়ে প্রবেশমুখ এবং বের হওয়া যাবে
আনোয়ারা উপজেলার বৈরাগ ইউনিয়নের সিইউএফএল সার কারখানার কাছ দিয়ে।
২০০৮ সালে সংসদ নির্বাচনের আগে চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানে নির্বাচনি সমাবেশে এই টানেল নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়লাভ করে ক্ষমতায় আসার পর এই টানেল নির্মাণের উদ্যোগ নেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
তারই ধারাবাহিকতায় ২০১৬ সালের ১৪ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং যৌথভাবে বঙ্গবন্ধু টানেলের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। প্রধানমন্ত্রী ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি প্রথম টানেল টিউব নির্মাণকাজের উদ্বোধন করেন।
২০১৫ সালের নভেম্বরে অনুমোদন পায় প্রকল্পটি। শুরুতে এর ব্যয় ধরা হয়েছিল ৮ হাজার ৪৪৬ দশমিক ৬৪ কোটি টাকা। পরবর্তীতে তা বৃদ্ধি পেয়ে হয় ১০ হাজার ৩৭৪ দশমিক ৪২ কোটি টাকা হয়। এর মধ্যে চীনের এক্সিম ব্যাংক ২ শতাংশ সুদে ৫ হাজার ৯১৩ দশমিক ১৯ কোটি টাকা দিচ্ছে। বাকি টাকা দিচ্ছে বাংলাদেশ সরকার।
কঙ্গবন্ধু টানেলের দৈর্ঘ্য ৩ দশমিক ৩২ কিলোমিটার। এর মধ্যে টানেলের প্রতিটি টিউবের দৈর্ঘ্য ২ দশমিক ৪৫ কিলোমিটার এবং ব্যাস ১০ দশমিক ৮০ মিটার। প্রতিটি টিউবে দুটি করে মোট চারটি লেন রয়েছে। মূল টানেলের সঙ্গে পশ্চিম ও পূর্ব প্রান্তে ৫ দশমিক ৩৫ কিলোমিটার সংযুক্ত সড়ক থাকবে। আর রয়েছে ৭২৭ মিটার দীর্ঘ ওভারব্রিজ।
নদীর নিচ দিয়ে এই ধরনের টানেল দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম।
প্রকল্প এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, টানেলের পতেঙ্গা প্রান্তে টোল গেইট বা টোল বক্স নির্মাণও শেষ হয়েছে। টানেলের এপ্রোচ রোডও নির্মাণ করা হয়েছে। আর আনোয়ারা প্রান্তের এপ্রোচ রোডসহ ৭২৭ মিটার দীর্ঘ ওভারব্রিজের কাজও শেষ হয়েছে। এখন টানেলের ভেতরে লাইটিংয়ের ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
টানেলের প্রকল্প পরিচালক মো. হারুনুর রশিদ জানান, আমরা সময়মতো টানেলটি চালুর জন্য প্রয়োজনীয় এবং আনুষঙ্গিক কাজ শেষ করছি। টানেলের ৯৭.২ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে। ইতোমধ্যে আমরা অ্যাপ্রোচ রোড নির্মাণ করেছি। এখন টানেলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য নিরাপত্তা কাজ চলছে। প্রকল্পের বাকি কাজ নির্ধারিত সময়ের আগেই শেষ করার প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
বহুল প্রতীক্ষিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল আগামী সেপ্টেম্বরে যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হবে বলে সম্প্রতি জানিয়েছেন সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।