সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার হবিপুর ইউনিয়নের নববি গ্রামে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বাড়িঘরে সাম্প্রদায়িক হামলায় ক্ষুব্ধ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা। তাঁদের অনেকেই বারবার সাম্প্রদায়িক হামলাকে প্রশাসনের ব্যর্থতা হিসেবে দেখছেন। তবে সরকার ও প্রশাসনের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, হামলার সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে, কেউ ছাড় পাবে না। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফরের আগে এ ধরনের হামলায় বিব্রত সরকার।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রশাসনের এমন আশ্বাসে আস্থা রাখতে পারছে না ভুক্তভোগীরা। তাদের মতে, অতীতে সাম্প্রদায়িক হামলাগুলোর সঙ্গে জড়িতরা বেশির ভাগই পার পেয়ে গেছে। হামলার ঘটনাগুলোর বিচার তো দূরে থাক, কয়েক বছর পেরিয়ে গেলেও এখনো অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দাখিল হয়নি বেশির ভাগ মামলার। ফলে এসব হামলার পুনরাবৃত্তি বন্ধ হচ্ছে না।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফরের আগে এ ধরনের অনভিপ্রেত ঘটনায় আমরা সত্যি দুঃখিত। এ ঘটনায় দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হবে। জড়িত কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।’
ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘ফেসবুক স্ট্যাটাসের কথা বলা হয়েছে। এর সঙ্গে যে জড়িত তাকে আগেই গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর পরও কেন এভাবে অস্ত্রশস্ত্র, লাঠিসোঁটা নিয়ে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বাড়িঘর, মন্দিরে হামলা ও ভাঙচুর করা হলো। এ ঘটনায় নিন্দা জানানোর ভাষা আমার জানা নেই।’ তিনি গতকাল সচিবালয়ে নিজ দপ্তরে ব্রিফিংকালে এসব কথা বলেন। ব্রিফিংয়ের আগে ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন ভারতের হাইকমিশনার বিক্রম কুমার দোরাইস্বামী।
জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘শাল্লায় হামলার বিষয়টি আগে থেকেই আশঙ্কা করছিল সংখ্যালঘুরা। এর পরও সেখানে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে স্থানীয় প্রশাসন ব্যর্থ হয়েছে। সহস্রাধিক লোক জমায়েত হওয়ার আগেই ব্যবস্থা নেওয়ার দরকার ছিল। অতীতেও দেখা গেছে, স্থানীয় প্রশাসনের দুর্বল ভূমিকার কারণে এসব হামলার ঘটনা ঘটেছে। তবে এর দায় শেষমেশ আওয়ামী লীগ ও সরকারের ওপরই এসে বর্তায়। ফলে আমাদের দল ও সরকারের নেতাদেরও এ বিষয়ে আরো সতর্ক হওয়া দরকার।’
শাল্লায় হামলার ঘটনায় ক্ষুব্ধ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি সনজিত চন্দ্র দাস। তিনি বলেন, ‘সুনামগঞ্জের হিন্দুদের ওপর সাম্প্রদায়িক হামলার প্রতিবাদে স্থানীয় বাম ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীরা প্রতিবাদ জানিয়েছেন। কিন্তু জেলা ও উপজেলা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা কোনো প্রতিবাদ করেননি, যা আমাদের ভাবায়। একই সঙ্গে প্রশাসনের তীব্র নীরবতাও আমাদের বারবার ভাবায়। আমাদের শাল্লা থেকে জানানো হয়েছিল, সেখানে হামলা হতে পারে। প্রশাসন জেনেও কেন নীরব ছিল। আমরা কি ধরে নেব, এই প্রশাসনে সব সাম্প্রদায়িক লোকজন ঢুকে গেছে, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগে সব সাম্প্রদায়িক লোকজন ঢুকে গেছে। আওয়ামী লীগের কোনো নেতাকেও দেখলাম না এ বিষয়টি নিয়ে মুখ খুলতে। আওয়ামী লীগে কি একজনও অসাম্প্রদায়িক নেতা নেই, যিনি এই বিষয় নিয়ে মুখ খুলবেন?’ তিনি গতকাল বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে ছাত্রলীগের এক বিক্ষোভ সমাবেশে এসব কথা বলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেনের সঞ্চালনায় সমাবেশে সংগঠনটির কেন্দ্রীয় ও ঢাবি শাখার নেতারা বক্তব্য দেন। এর আগে শাল্লায় হামলার প্রতিবাদে মধুর ক্যান্টিন থেকে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের একটি বিক্ষোভ মিছিল ক্যাম্পাস প্রদক্ষিণ করে রাজু ভাস্কর্যে এসে শেষ হয়।
আ. লীগ ক্ষমতায় এলে সংখ্যালঘু নির্যাতন বাড়ে : ফখরুল
শাল্লায় হামলার ঘটনায় প্রতিবাদ জানিয়েছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি গতকাল গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে বলেন, ‘সরকারের পক্ষ থেকে বারবার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কথা বলা হলেও এ সরকারের আমলে সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণের মাত্রা সীমাহীন পর্যায়ে পৌঁছেছে। আওয়ামী লীগ সরকার যখনই ক্ষমতায় আসে সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে যায়। বেশ কয়েক বছর ধরে ক্ষমতাসীন দলের লোকদের দ্বারা সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা, বাড়িঘর ও দেবালয়ে অগ্নিসংযোগ, সম্পত্তি দখল ইত্যাদির হিড়িক চলছে। এরই ধারাবাহিকতায় সুনামগঞ্জের শাল্লায় নববি গ্রামে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বাড়িঘরে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা কোনো অশুভ উদ্দেশ্য নিয়ে সংঘটিত হয়েছে কি না তা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।’
ফখরুল বলেন, ‘এ ঘটনা এক অশনি সংকেত। এ দেশের জনগণ এখন ভয়ংকর দুঃসময়ের মধ্যে দিনাতিপাত করছে। ভয়াল পরিবেশের কারণে এ দেশে মানুষের ধর্মীয় স্বাধীনতা বিপন্ন হয়ে পড়েছে। সরকার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা করতে পারেনি এবং তাদের নিরাপত্তাও দিতে ব্যর্থ হয়েছে। আওয়ামী সরকার বিরোধী মত ও দলের নেতাকর্মীদের দমন ও নির্যাতনে ব্যস্ত থাকার কারণে সাধারণ মানুষের জানমালের নিরাপত্তার বিষয়ে সম্পূর্ণ উদাসীন থাকায় একের পর এক নিরীহ মানুষের ওপর হামলা, নির্যাতন ও জুলুম অব্যাহত রয়েছে।’
আমাদের দিরাই-শাল্লা (সুনামগঞ্জ) প্রতিনিধি জানান, গতকাল সকালে হামলার শিকার হিন্দু গ্রামটি ঘুরে দেখেন র্যাব মহাপরিচালক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন। তিনি হেলিকপ্টারে করে উপজেলার নোয়াগাঁও গ্রামের মাঠে অবতরণ করার পর হামলার শিকার ঘরবাড়ি পরিদর্শন করেন। শেষে নোয়াগাঁও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে গ্রামবাসী ও সাংবাদিকদের সামনে বক্তব্য দেন।
আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘গতকাল ছিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী, সারা দেশের মানুষের জন্য আনন্দের দিন। আর এই দিনে কিছু দুষ্কৃতকারী নিরীহ হিন্দু গ্রামে হামলা করে ভাঙচুর-লুটপাট করেছে। আমি এই উপজেলার সন্তান, আমার বাড়ির পাশে এমন ন্যক্কারজনক ঘটনা আমাকে লজ্জিত করেছে। ইসলামে উগ্রবাদ-সন্ত্রাসবাদের কোনো জায়গা নেই। যারা এ ঘটনা ঘটিয়েছে তারা শুধুই অপরাধী। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার কোনো অপরাধীকেই ছাড় দেয়নি, ওরাও পাবে না। প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জঙ্গিবাদ নির্মূল করেছে। বড় বড় উগ্রবাদী জঙ্গি সংগঠনকে প্রতিহত করেছে। এখানে হামলার সঙ্গে যারা জড়িত তারাও রেহাই পাবে না। এদেরও বিচার করা হবে।’
তিনি বলেন, ‘গত রাতেই র্যাবের পক্ষ থেকে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের মধ্যে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করা হয়েছে। জেলা প্রশাসনও আর্থিক সহযোগিতা করবে বলে আশ্বস্ত করেছে। মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হামলাকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য কঠোর নির্দেশনা দিয়েছেন। আপনারা ধৈর্য ধরুন। সব অপরাধীর বিচার হবে, আপনারা শুধু আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করুন। আপনারা আতঙ্কিত হবেন না, সরকার আপনাদের পাশে রয়েছে।’
মামুনুল হককে গ্রেপ্তার দাবি ওয়ার্কার্স পার্টির : শাল্লায় হামলার ঘটনায় উসকানিদাতা হিসেবে হেফাজতে ইসলামের নেতা মামুনুল হককে গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়েছে ওয়ার্কার্স পার্টি। গতকাল দলটির এক বিবৃতিতে বলা হয়, ওয়ার্কার্স পার্টির পলিটব্যুরো সুনামগঞ্জের একটি সংখ্যালঘুদের গ্রামে হেফাজতিদের আক্রমণ ভাঙচুর লুটপাটের ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে এবং এই আক্রমণের উসকানিদাতা হেফাজতি নেতা মামুনুল হকসহ সংশ্লিষ্টদের গ্রেপ্তারসহ তাঁদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছে।’
বিবৃতিতে বলা হয়, ‘মামুনুল হকের বিরুদ্ধে ওই গ্রামের এক যুবক ফেসবুকে কটূক্তি করায় তাকে পুলিশ গ্রেপ্তার করলেও দাঙ্গাকারী হেফাজতিদের বিরুদ্ধে পুলিশ এ যাবৎ কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। বরং পুলিশের বক্তব্যে হেফাজতিদের আক্রমণের সাফাই গাওয়া হয়েছে।’
বিচার হয়নি অতীতের হামলার : আমাদের ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রতিনিধি জানান, ২০১৬ সালের ৩০ অক্টোবর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে হিন্দুদের মন্দির এবং বাড়িঘরে হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তরা এখনো বিচার পায়নি। নাসিরনগরে হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত স্বাধীন দাস বলেন, ‘সে দিনের ঘটনা মনে হলে এখনো মনে আতঙ্ক কাজ করে। অবশ্য ভয়ভীতি কাটিয়ে এখন আমরা অনেকটা ভালো আছি। তবে এ ঘটনার দ্রুত বিচার না হলে হামলাকারীরা আরো সাহস পাবে।’
শঙ্কায় আছেন গৌর মন্দির ভাঙচুর মামলার বাদী নির্মল চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘কিছু দুষ্কৃতকারী সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করার চেষ্টা করায় ভুক্তভোগী হতে হয়েছে আমাদের। তবে আশায় ছিলাম এ হামলার বিচার হবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত বিচারের কোনো লক্ষণ দেখছি না।’
হিন্দু সম্প্রদায়ের রসরাজ দাস নামে এক যুবক ফেসবুক থেকে পবিত্র কাবা শরিফ নিয়ে ব্যঙ্গ করে পোস্ট দেওয়ার অভিযোগ তুলে ডাকা প্রতিবাদ সমাবেশ থেকে নাসিরনগর উপজেলা সদরের অন্তত ১০টি মন্দির ও শতাধিক হিন্দু বাড়িতে হামলার ঘটনা ঘটে। পরে ৪ ও ১৩ নভেম্বর আবারও কয়েকটি বাড়িতে হামলা হয়। হামলার ঘটনায় আটটি মামলা হলেও মাত্র একটিতে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। ওই মামলার ২২৮ আসামির সবাই এখন জামিনে আছে। পুলিশ বিভিন্ন মামলায় মোট ১২৫ জনকে গ্রেপ্তার করে। তবে মামলার আসামি দুই হাজারের বেশি।
কক্সবাজার থেকে আমাদের বিশেষ প্রতিনিধি জানান, প্রায় ৯ বছর আগে কক্সবাজারের রামুতে সংঘটিত সাম্প্রদায়িক হামলার ১৮টি মামলার এ যাবৎ কোনো কূলকিনারা হয়নি। নিষ্পত্তি তো দূরের কথা, একটি ছাড়া অন্য মামলাগুলোর সাক্ষ্যগ্রহণও শুরু হয়নি। মামলাগুলোয় আসামির সংখ্যা ১৫ হাজার। এর মধ্যে অভিযোগপত্রে ৯৮৪ জনকে আসামি করা হয়। মোট মামলার সংখ্যা ছিল ১৯টি। এর মধ্যে রামু থানায় দায়ের করা একটি মামলা আপসসূত্রে বিচারকাজ শেষ হওয়ায় চার্জশিটভুক্ত ৩৮ জন আসামির সবাই খালাস পেয়ে যায়। বাদ বাকি ১৮টি মামলা বর্তমানে বিচারাধীন। মামলাগুলোর কোনো আসামি বর্তমানে কারাগারে নেই।
প্রসঙ্গত, ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে ভয়াল এ হামলার ঘটনাটি ঘটেছিল। সেই রাতে রামুর ঐতিহ্যবাহী ১২টি বৌদ্ধবিহার ও বৌদ্ধপল্লীতে একযোগে অগ্নিসংযোগ ও হামলা চালিয়েছিল দুর্বৃত্তরা। পরের দিন উখিয়া ও টেকনাফেও আরো সাতটি বৌদ্ধবিহার পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। সূত্র: কালের কণ্ঠ
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।