রঞ্জু খন্দকার, গাইবান্ধা থেকে: গাইবান্ধা জেলা শহরের পুরানবাজারের মাছপট্টিতে ঢুকলে প্রায় দিনই পরিচিত এক দৃশ্যের দেখা মেলে। বটি হাতে একমনে মাছ কুটে চলেছেন এক নারী। মাথার বেশির ভাগ চুলে পাক ধরেছে। তোবড়ানো গালমুখ জানান দিচ্ছে বয়স ষাটের কোঠা পার হয়েছে আগেই।
এই বয়সেও প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত মাছ কুটে জীবিকা চালাতে হচ্ছে ওই নারীকে।
মাছ কুটে দিন চালানো এই নারীর নাম মিনা শুক্কুরি। বাড়ি কোথায়–জিজ্ঞেস করলে বলেন, ‘বাড়ি নাই, বাহে।’ তাহলে থাকেন কোথায়? জানালেন, একটা ভাড়া ঝুপড়ি ঘরে। শহরের ব্রিজরোডের কালিবাড়ি এলাকায়।
মিনার পাশেই মাছ নিয়ে বসেন আরেক ব্যক্তি। তিনি বলেন, একসময় মিনার বড় সংসার ছিল। মিনার বাবার অনেক জমি ছিল। সেগুলো দান করেছেন। স্বামী পল্লী চিকিৎসক ছিলেন। তিনি অল্প বয়সেই মারা গেছেন। কপালের ফেরে এখন মাছ কুটে সংসার চালাতে হচ্ছে মিনাকে।
স্বামী-সন্তানের সুখ বেশিদিন কপালে সয়নি মিনার। তিনি বলেন, তাঁর এক মেয়ে, দুই ছেলে। ছেলেমেয়েরা ছোট থাকতেই স্বামী মারা যান। ‘কত বছর আগে?’ জিজ্ঞেস করলে ঠিক করে বলতেও পারেন না মিনা। শুধু বললেন, তখন তাঁর দুই ছেলেই শিশু।
মিনার সংসারে বিপদেরা দল বেঁধে নামে স্বামী মারা যাওয়ার পরই। ছোট এক ছেলে মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে। তার চিকিৎসা করতে গিয়ে নিঃস্ব থেকে নিঃস্বতর হয়ে পড়েন মিনা।
মিনা বলেন, ছেলের চিকিৎসা করতে গিয়ে তাঁকে অনেক টাকা ঋণ নিতে হয়েছে। এর ঘানি টানতে হচ্ছে এখনো। মাছ কুটে দিনে যে টাকা পান, তার মধ্যে ৮০ টাকা দিতে হয় জায়গার ভাড়া। ঋণের কিস্তি দিতে হয় দিনে ৩০০ করে। আর যে কয় টাকা থাকে, তা দিয়ে মাস শেষে বাসা ভাড়া সাড়ে তিন শ আর খাই-খরচে শেষ হয়। একটা টাকাও হাতে থাকে না। এর মধ্যে অসুখ হলেই বিপদ ঘটে।
‘অবশ্য দিনে ১০-১৫ টাকার চা-পান খান তিনি’, হাসিমুখে জানালেন মিনা শুক্কুরি।
শুক্কুরি নামের রহস্য কী– জানতে চাই। বললেন, মাছ কাটার কাজ করার আগে তিনি গাইবান্ধার পুরান জেলখানায় রান্না করতেন। সেখানকার লোকেরাই তাঁকে এই পদবী দিয়েছে। পরে এই নামই পরিচিতি পেয়ে গেছে। এর মানে তিনি জানেন না।
‘বয়স্ক বা বিধবাভাতা পান কি না?’ মিনা জানালেন, তাঁর জাতীয় পরিচয়পত্র হারিয়ে গেছে, সে জন্য ভাতা হয় না। জাতীয় পরিচয়পত্রের জন্য মেয়র, কাউন্সিলরসহ অনেকের কাছে গেছেন। সবাই আশ্বাস দিলেও এখনো হয়নি।
মিনার সন্তানদের মধ্যে মেয়ে স্বামীর বাড়িতে সংসার করছে। এক ছেলে তো মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন। আরেক ছেলেও বিয়ে করে শ্বশুরবাড়িতে থাকে।
জীবনযুদ্ধে ক্লান্ত মিনা শুক্কুরি বললেন, এখন তবু মাছ কুটেই দিন চলছে তাঁর। শরীর যখন চলবে না, তখন কী করে দিন-অন্ন চলবে, কে জানে!
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।