সকালের কুয়াশা ভেদ করে সূর্যের প্রথম আভা যখন পাহাড়ের চূড়ায় পড়ে, কিংবা বঙ্গোপসাগরের উত্তাল ঢেউ যখন পায়ের তলায় বালি কেড়ে নিয়ে যায় – সেই মুহূর্তের জন্যে কি দাম দেয়া যায়? মনে হয়, না। কিন্তু বাস্তবতা বলে ভিন্ন কথা। টাকার অংক, হোটেলের ভাড়া, গাড়ির খরচ – ভ্রমণের স্বপ্নকে যেন পিছুটান দিয়ে ধরে রাখে। কিন্তু জানেন কি? কম খরচে ঘোরার প্ল্যান বানানো কোন জটিল বিজ্ঞান নয়। শুধু দরকার একটু সচেতনতা, একটু গবেষণা আর নিজের দেশকে নতুন চোখে দেখার সাহস। বাংলাদেশের মাটি, তার মানুষ, তার অফুরান সৌন্দর্য – সবই অপেক্ষা করছে আপনার পদচারণার জন্য, আপনার পকেটকে অতিরিক্ত চাপ না দিয়েই। চলুন, জেনে নেওয়া যাক, কীভাবে বাজেটের মধ্যে বেড়িয়ে পড়া যায় অদেখার সন্ধানে।
সাশ্রয়ী ভ্রমণের দর্শন: টাকার চেয়ে অভিজ্ঞতাই মূলধন
কম খরচে ঘোরার প্ল্যান মানেই শুধু টাকা বাঁচানো নয়, এটা একটা জীবনদর্শন। এখানে অভিজ্ঞতাই সবচেয়ে বড় সম্পদ। জেট প্লেনের বদলে লোকাল বাসে চড়ে দেখতে পাবেন গ্রামীণ জীবনের রূপ, হোটেলের বদলে হোমস্টেতে থাকলে আন্তরিকতা পাবেন অকৃত্রিম, দামি রেস্টুরেন্টের বদলে রাস্তার পাশের দোকানে খেলে স্বাদ পাবেন স্থানীয় সংস্কৃতির। বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশনের (বাপকো) ২০২৩ সালের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশি পর্যটকদের একটি বড় অংশই এখন সচেতনভাবে বাজেট-ফ্রেন্ডলি ভ্রমণকে প্রাধান্য দিচ্ছেন, স্থানীয় অর্থনীতিতে যার ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে। সাশ্রয়ী ভ্রমণ গাইড হিসেবে প্রথমেই মাথায় রাখুন:
- অগ্রাধিকার নির্ধারণ: কোন জিনিসটা আপনার জন্য সবচেয়ে জরুরি? আরামদায়ক থাকার জায়গা, নানান রকম খাবার, নাকি বেশি বেশি জায়গা দেখা? সেই অনুযায়ী বাজেট বণ্টন করুন।
- অফ-সিজনের ম্যাজিক: পিক সিজনে (শীতকাল, বিশেষ করে ডিসেম্বর-জানুয়ারি) খরচ বেড়ে যায় দ্বিগুণ। বর্ষায় কক্সবাজার বা শরতে সাজেক ভ্যালি ভিন্ন রূপে দেখা, অথবা গ্রীষ্মে সেন্ট মার্টিনের শান্ত সমুদ্র উপভোগ করা – অভিজ্ঞতা যেমন অনন্য, খরচও অনেক কম।
- স্থানীয় হয়ে উঠুন: স্থানীয় পরিবহন ব্যবহার করা, স্থানীয় বাজারে খাবার কেনা, স্থানীয় মানুষজনের সাথে কথা বলা – এগুলো শুধু টাকা বাঁচায় না, ভ্রমণকে করে তোলে সমৃদ্ধ। যেমন: ঢাকা থেকে সিলেট যাওয়ার জন্য শ্যামলী বা গ্রিনলাইন এর এসি বাসের চেয়ে লোকাল ট্রেনে (যেমন উপবন এক্সপ্রেস) চড়লে খরচ অর্ধেকেরও কম, আর দেখা মিলবে সবুজের সমারোহ।
পরিবহণে সাশ্রয়ের জাদুকরী কৌশল: পথই যেখানে অভিযান
যাতায়াত খরচই ভ্রমণ বাজেটের বড় অংশ দখল করে। কম খরচে ঘোরার প্ল্যান সফল করতে পরিবহণে সাশ্রয় জরুরি।
- রেলওয়ে: বাজেট ভ্রমণের রথ: বাংলাদেশ রেলওয়ে বাজেট ট্রাভেলারদের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ। শুধু ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-সিলেট বা ঢাকা-খুলনা রুট নয়, কমলাপুর বা বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশন থেকে দেশের প্রায় সব প্রধান গন্তব্যেই ট্রেন পাওয়া যায়। শোভন চেয়ার বা শোভন শ্রেণিতে ভ্রমণ করলে এসি বাসের চেয়ে অনেক কম খরচে আরামদায়ক যাত্রা সম্ভব। অনলাইন বুকিং (এসবি টিকেট বা রেলওয়ে অফিসিয়াল অ্যাপ) আগে থেকে করলে সুবিধাজনক সিট পাওয়া যায়। বাংলাদেশ রেলওয়ে ওয়েবসাইট থেকে সময়সূচি ও ভাড়া জানা যাবে। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা: ঢাকা থেকে দিনভর ট্রেনে চড়ে নীলসাগর (মৌলভীবাজার) যাওয়া। জানালা ঘেঁষে চা বাগান আর পাহাড়ের দৃশ্য, সাথে স্থানীয় যাত্রীদের সাথে গল্প – অভিজ্ঞতা অমূল্য, খরচ মাত্র ৩০০-৪০০ টাকা (শোভন চেয়ার)!
- বাস যাত্রা: স্মার্ট চয়েস: এসি বাসের বদলে নন-এসি বা লোকাল বাসে চড়লে খরচ অনেক কমে। ঢাকার মহাখালী, সায়েদাবাদ, গাবতলী বা কমলাপুর বাস টার্মিনাল থেকে দেশের প্রায় সব জেলার জন্য বাস পাওয়া যায়। “শাটল” বা ডাইরেক্ট সার্ভিসের চেয়ে যেসব বাস মাঝপথে স্টপেজ নেয়, সেগুলো আরও সস্তা। তবে সময় বেশি লাগবে। টিপ: রাতে যাত্রা করলে এক রাতের হোটেল ভাড়া বাঁচবে। ঢাকা-কক্সবাজার নন-এসি বাস ভাড়া ৬০০-৮০০ টাকা, এসি বাস ১২০০-১৮০০ টাকা।
- নৌপথ: ধীরগতির সৌন্দর্য: দক্ষিণাঞ্চলের (খুলনা, বাগেরহাট, বরিশাল, পটুয়াখালী) ভ্রমণে লঞ্চই সবচেয়ে সাশ্রয়ী ও সৌন্দর্যময় মাধ্যম। ঢাকা (সদরঘাট/চাঁদনীঘাট) থেকে এসব গন্তব্যে সাধারণ কেবিন বা ডেকে ভ্রমণ করা যায়। ভোরের আলো ফোটার দৃশ্য বা সূর্যাস্তের লালিমা নদীর বুকে দেখা অন্যরকম অভিজ্ঞতা। ঢাকা-মোংলা/খুলনা লঞ্চ ভাড়া ডেকে ৩০০-৫০০ টাকা, কেবিন ৮০০-১৫০০ টাকা (শেয়ার্ড)।
- স্থানীয় পরিবহণ: অটো, সিএনজি, ভ্যান, ভটভটি: গন্তব্যে পৌঁছানোর পর চলাফেরার জন্য রিকশা, অটোরিকশা, সিএনজি বা স্থানীয় ভ্যান/ভটভটিই সাশ্রয়ী। দরদাম করে নেওয়া জরুরি। ভাড়া সম্পর্কে আগে থেকে ধারণা নিন (স্থানীয় বন্ধু বা হোটেল স্টাফের কাছ থেকে জিজ্ঞেস করুন)। অনেক জায়গায় শেয়ার্ড সিএনজি বা অটোতে চড়ে খরচ আরও কমানো যায়।
- হেঁটে হেঁটে দেখুন: ছোট শহর বা পর্যটন স্পট (যেমন: বগুড়ার মহাস্থানগড়, সিলেটের জাফলং, কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের কিছু অংশ) হেঁটে ঘুরে দেখা সবচেয়ে সাশ্রয়ী, স্বাস্থ্যকর এবং কোনো জায়গাকে গভীরভাবে জানার সবচেয়ে ভালো উপায়।
থাকা-খাওয়ায় সাশ্রয়: আরাম নয়, অভিজ্ঞতায় ভরো
থাকা ও খাওয়া – এই দুটোতেই বাজেট ফ্রেন্ডলি চয়েস আছে প্রচুর। সাশ্রয়ী ভ্রমণ গাইড হিসেবে এখানে কিছু টিপস:
বাজেট ফ্রেন্ডলি থাকার ব্যবস্থা:
- হোস্টেল/ডরমিটরি: পর্যটন স্পটগুলোতে (কক্সবাজার, সাজেক, সেন্ট মার্টিন, বান্দরবান) বাজেট হোস্টেল বা শেয়ার্ড ডরমিটরি (প্রায় ৩০০-৮০০ টাকা/রাত) পাওয়া যায়। এগুলো তরুণ ভ্রমণপিপাসু ও ব্যাকপ্যাকারদের জন্য আদর্শ।
- হোমস্টে: স্থানীয় পরিবারের সাথে থাকার অভিজ্ঞতা অতুলনীয়। খাবারের স্বাদ, সংস্কৃতির গভীরে যাওয়া – সবই সম্ভব। বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশন (বাপকো) কিছু হোমস্টে তালিকাভুক্ত করেছে, স্থানীয়ভাবে খোঁজ করলেও পাওয়া যায়। ভাড়া সাধারণত হোটেলের চেয়ে কম (৫০০-১৫০০ টাকা/রাত, খাবারসহ বা ছাড়া)। উদাহরণ: রাঙ্গামাটিতে চাকমা পরিবারের হোমস্টে, সিলেটে চা শ্রমিকের বাড়িতে থাকা।
- বাজেট হোটেল/গেস্ট হাউজ: শহর বা বড় বাজারে সাধারণ মানের ক্লিন হোটেল/গেস্ট হাউজ (৮০০-১৫০০ টাকা/রাত) পাওয়া যায়। অনলাইন বুকিং প্ল্যাটফর্ম (বুকার, হোটেল শাহরুক) বা ফোনে রুম দেখে বুক করাই ভালো।
- রিসোর্টের বেসিক রুম: অনেক রিসোর্টেই বাজেট ফ্রেন্ডলি ছোট বা বেসিক রুম (১৫০০-২৫০০ টাকা/রাত) থাকে, যা তাদের ডিলাক্স রুমের চেয়ে অনেক সস্তা।
- স্টেশনে রাত কাটানো (সতর্কতার সাথে): দূরপাল্লার ট্রেন বা বাসে রাতের যাত্রা করলে এক রাতের থাকার খরচ বাঁচে। তবে নিরাপত্তা ও আরামের দিকে খেয়াল রাখতে হবে।
- খাওয়াদাওয়ায় সাশ্রয়ী পথ:
- স্থানীয় রেস্টুরেন্ট/হোটেল: পর্যটন স্পটের দামি রেস্টুরেন্ট এড়িয়ে স্থানীয়দের প্রিয় খাবারের দোকানে খান। স্বাদও আসল, দামও কম। যেমন: চট্টগ্রামের ফরাসি গলির মোরগ পোলাও, সিলেটের আলমাছের ভর্তা, বগুড়ার দই।
- রাস্তার খাবার: সতর্কতা অবলম্বন করে নিরাপদ মনে হয় এমন জায়গার রাস্তার খাবার (ফুচকা, চটপটি, ঝালমুড়ি, সমুচা, সিঙাড়া, জিলাপি) স্বাদ নেওয়া যায় কম খরচে। টিপ: যেখানে স্থানীয়রা ভিড় করছে, সেখানে খাওয়া নিরাপদ।
- স্থানীয় বাজার থেকে রান্না: হোস্টেলে কিচেন ফ্যাসিলিটি থাকলে বা হোমস্টেতে অনুমতি পেলে স্থানীয় বাজার থেকে তাজা মাছ, শাকসবজি, মসলা কিনে নিজেরা রান্না করে খাওয়া যায় সবচেয়ে সাশ্রয়ী উপায়ে। অভিজ্ঞতাও মজাদার!
- পানি ও স্ন্যাকস: বাইরে থেকে বোতলজাত পানি কিনতে খরচ হয়। বড় বোতল কিনে রিফিল করানো বা ফিল্টার পানি ব্যবহার করলে সাশ্রয় হয়। নিজের সাথে বিস্কুট, কেক, ফলমূল রাখুন ক্ষুধা মেটানোর জন্য।
বিনামূল্যে বা কম খরচে যা কিছু উপভোগ করবেন
কম খরচে ঘোরার প্ল্যান মানে শুধু খরচ কমানো নয়, বিনামূল্যে বা নামমাত্র খরচে উপভোগ করার সুযোগ খোঁজা।
- প্রাকৃতিক সৌন্দর্য: সমুদ্র সৈকতে সূর্যোদয়/সূর্যাস্ত দেখা, পাহাড়ের চূড়ায় কুয়াশা ভেদ করে সূর্যের আলো দেখা, নদীর তীরে বসে থাকা – এসবের জন্য কোন টিকিট লাগে না। কক্সবাজার, কুয়াকাটা, পতেঙ্গা, সেন্ট মার্টিনের সমুদ্র; সাজেক, বান্দরবান, রাঙ্গামাটির পাহাড়; লালাখাল, রাতারগুল, টাঙ্গুয়ার হাওর – প্রকৃতির এই অফার ফ্রি!
- পাবলিক পার্ক ও উদ্যান: বিভাগীয় ও জেলা শহরগুলোর পাবলিক পার্ক (ঢাকার রমনা পার্ক, বোটানিক্যাল গার্ডেন; চট্টগ্রামের ফয়েজ লেক; খুলনার শিববাড়ি পার্ক) নামমাত্র প্রবেশমূল্যে (১০-৩০ টাকা) প্রকৃতির মাঝে সময় কাটানোর সুযোগ দেয়।
- স্থানীয় বাজার ও লোকজীবন: কোন টিকিট ছাড়াই স্থানীয় বাজার ঘুরে দেখা (যেমন: ঢাকার নিউ মার্কেট, চকবাজার; সিলেটের আলুটিলা রাস্তার বাজার; কক্সবাজারের হিমছড়ি ফিশ মার্কেট) স্থানীয় সংস্কৃতি ও জীবনযাপনকে কাছ থেকে দেখার শ্রেষ্ঠ উপায়।
- বিনামূল্যে প্রবেশ (কিছু ক্ষেত্রে): অনেক ঐতিহাসিক স্থান বা মন্দিরে (যেমন: ঢাকার তারা মসজিদের বাইরের নকশা, পুরান ঢাকার নবাব বাড়ির বাইরের অংশ, পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহারের আশেপাশের এলাকা, কান্তজীর মন্দিরের স্থাপত্যশৈলী বাইরে থেকে দেখা, চট্টগ্রামের বাটালি হিলে কিছু ভিউ পয়েন্ট) বাইরে থেকে দর্শন বা নামমাত্র খরচে প্রবেশ করা যায়। গবেষণা করে দেখুন।
- সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান: স্থানীয় উৎসব, মেলা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান (যেগুলোতে টিকিট লাগে না) অংশ নেওয়া। যেমন: বৈসাবি উৎসব (পার্বত্য চট্টগ্রাম), পহেলা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রা, বিভিন্ন মাজার বা মন্দিরের বার্ষিক উৎসব।
ঋতু ও গন্তব্য ভিত্তিক সাশ্রয়ী প্ল্যান
সাশ্রয়ী ভ্রমণ গাইড হিসেবে ঋতু বুঝে গন্তব্য বাছাই করলে অভিজ্ঞতা যেমন ভালো হয়, খরচও কমে।
- গ্রীষ্মকাল (মার্চ-জুন):
- গন্তব্য: পার্বত্য জেলা (বান্দরবান – নীলগিরি, নীলাচল; রাঙ্গামাটি – কাপ্তাই লেক, শুভলং ঝর্ণা; খাগড়াছড়ি), সাজেক ভ্যালি। উচ্চতায় তাপমাত্রা তুলনামূলক কম থাকে।
- সাশ্রয় টিপ: হোস্টেল বা বেসিক হোমস্টে বেছে নিন। রাতের বাসে চড়ে যাওয়া-আসা করে একদিনের থাকা বাঁচান। স্থানীয় গাইডের সাথে গ্রুপ ট্যুরে যোগ দিন খরচ ভাগাভাগি করতে।
- বর্ষাকাল (জুলাই-সেপ্টেম্বর):
- গন্তব্য: সিলেট (রাতারগুল সুন্দরবন, জাফলং, বিছানাকান্দি, লালাখাল, মাধবকুণ্ড জলপ্রপাত – তখন প্রবল থাকে), হাওর অঞ্চল (কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোণা, সুনামগঞ্জ – যদিও যাতায়াত কষ্টকর হতে পারে), চা বাগান (সিলেট, মৌলভীবাজার – সবুজের রাজ্য)।
- সাশ্রয় টিপ: বর্ষায় পর্যটক কম থাকে, তাই হোটেল ভাড়া কম পাবেন। ট্রেনে ভ্রমণ আরামদায়ক। রেইনকোট ওয়াটারপ্রুফ ব্যাগ সঙ্গে রাখুন।
- শরৎকাল (অক্টোবর-নভেম্বর):
- গন্তব্য: হাওর এলাকা (পানি কমে গেলে যাতায়াত সুবিধাজনক), সাজেক ভ্যালি (সবুজ ও স্বচ্ছ আকাশ), কক্সবাজার (ভিড় কম), মধুপুর গাজি (শালবনে হাঁটা)।
- সাশ্রয় টিপ: পিক সিজন শুরুর আগেই ভ্রমণ করুন। আবহাওয়া মনোরম হওয়ায় হাঁটাহাঁটি করে অনেক কিছু দেখা যাবে।
- শীতকাল (ডিসেম্বর-ফেব্রুয়ারি):
- গন্তব্য: সমুদ্র সৈকত (কক্সবাজার, কুয়াকাটা, সেন্ট মার্টিন – দিনে গরম, রাতে ঠান্ডা), সাজেক (কুয়াশার রাজ্য), সুন্দরবন (ভ্রমণের আদর্শ সময়)।
- সাশ্রয় টিপ: ডিসেম্বর-জানুয়ারি পিক সিজন, সবচেয়ে দামি। সম্ভব হলে নভেম্বরের শেষ বা ফেব্রুয়ারির শুরুতে ভ্রমণ করুন। বুকিং আগে থেকে নিশ্চিত করুন। সুন্দরবনে গ্রুপ ট্যুরে যোগ দিন খরচ কমাতে।
জেনে রাখুন (FAQs)
কম খরচে ঘোরার প্ল্যান নিয়ে কিছু কমন প্রশ্নের উত্তর:
প্রশ্ন: একেবারে কম খরচে বাংলাদেশে ঘুরতে গেলে দিনে কত টাকা বাজেট রাখা উচিত?
- উত্তর: এটি নির্ভর করে আপনার ভ্রমণ স্টাইলের উপর। খুব বেসিক ব্যাকপ্যাকার হিসেবে (হোস্টেল ডরম/বেসিক রুম, স্থানীয় বাস/ট্রেন, রাস্তার খাবার/সাধারণ রেস্টুরেন্ট, বিনামূল্যে/কম টিকিটের স্থান দেখে) ৮০০-১৫০০ টাকা/দিনে ম্যানেজ করা সম্ভব। আরাম একটু বেশি চাইলে (প্রাইভেট রুম, নন-এসি কিন্তু ডাইরেক্ট বাস, স্থানীয় রেস্টুরেন্টে ভালো খাবার, কিছু টিকিটেড জায়গা) ১৫০০-২৫০০ টাকা/দিন বাজেট রাখতে পারেন। খরচের বড় অংশই যায় যাতায়াত ও থাকায়।
প্রশ্ন: সাশ্রয়ী ভ্রমণের জন্য কোন অ্যাপ বা ওয়েবসাইট ব্যবহার করা ভালো?
- উত্তর: পরিবহনের জন্য এসব টিকিট (ট্রেন), গ্রীনলাইন, শ্যামলী, এনা ইত্যাদি কোম্পানির অফিসিয়াল অ্যাপ/ওয়েবসাইট বা পাথাও (বাস বুকিং)। থাকার জন্য বুকার ডট কম, হোটেল শাহরুক, এয়ারবিএনবি (হোমস্টে)। গুগল ম্যাপস অপরিহার্য রুট প্লানিং ও লোকাল ট্রান্সপোর্ট ধারণার জন্য। বাংলাদেশ রেলওয়ে ওয়েবসাইট (https://www.railway.gov.bd/) এবং বিআরটিসি ওয়েবসাইট (ঢাকা লোকাল বাসের জন্য) সহায়ক। স্থানীয় ভ্রমণ ব্লগ বা ফেসবুক গ্রুপ থেকে আপডেটেড তথ্য ও পরামর্শ পেতে পারেন।
প্রশ্ন: নিরাপদ ও সস্তায় রাত কাটানোর উপায় কী? বিশেষ করে একা ভ্রমণকারীদের জন্য?
- উত্তর: রিকমেন্ডেড হোস্টেল/হোমস্টে/গেস্ট হাউজ বেছে নিন (অনলাইন রিভিউ চেক করুন)। মহিলা ভ্রমণকারীরা লেডিজ ডরম বা নারী-পরিচালিত হোমস্টে খুঁজুন (অনেক জায়গায় আছে)। রাতের পরিবহন এড়িয়ে চলুন। ট্রেনে রাত কাটানো নিরাপদ ও সাশ্রয়ী বিকল্প, তবে মূল্যবান জিনিসপত্র সতর্কতার সাথে রাখুন। স্থানীয় পর্যটন তথ্য কেন্দ্র বা থানায় জায়গার নিরাপত্তা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতে পারেন। কখনোই অপরিচিত বা অস্বচ্ছল জায়গায় রাত কাটাবেন না।
প্রশ্ন: বর্ষাকালে সাশ্রয়ী ভ্রমণ কি ভালো ধারণা? কী কী সতর্কতা নেব?
- উত্তর: হ্যাঁ, বর্ষায় ভ্রমণ অনন্য অভিজ্ঞতা (সবুজের সমারোহ, জলপ্রপাতের প্রাণবন্ত রূপ) দিতে পারে এবং খরচ কম থাকে (হোটেল ভাড়া কম, ভিড় কম)। তবে সতর্কতা: রাস্তাঘাট ও নৌপথের অবস্থা আগে থেকে জেনে নিন (স্থানীয় সূত্র)। ভূমিধস প্রবণ এলাকা এড়িয়ে চলুন (বিশেষ করে পার্বত্য অঞ্চলে)। ওয়াটারপ্রুফ ব্যাগ, রেইনকোট/ছাতা, এক্সট্রা পোশাক, পানি নিরোধক জুতো অবশ্যই রাখুন। মশা ও পোকামাকড় থেকে সুরক্ষা নিন। ভ্রমণ বীমা করার কথা বিবেচনা করুন।
- প্রশ্ন: পরিবার নিয়ে কম খরচে ঘুরতে চাইলে বিশেষ পরিকল্পনা কী দরকার?
- উত্তর: পরিবারের জন্য হোমস্টে বা রিসোর্টের ফ্যামিলি রুম/কটেজ বুকিং করা সুবিধাজনক (অনেক সময় শেয়ার করা যায়)। গ্রুপে প্যাকেজ ট্যুর খুঁজে দেখতে পারেন (খরচ কমাতে পারে)। খাবারের ক্ষেত্রে নিজেরা কিছু স্ন্যাক্স/জলখাবার সঙ্গে রাখুন এবং শিশুদের জন্য নিরাপদ স্থানীয় খাবার খুঁজুন। গন্তব্য বাছাইয়ে শিশু ও বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্যদের সুবিধা-অসুবিধা মাথায় রাখুন (যেমন: খুব বেশি হাঁটাহাঁটি বা রুক্ষ পথ আছে কিনা)। ছোট ছোট জায়গায় ভাগ করে ভ্রমণ করুন, একসাথে অনেক দূর যাওয়ার চেষ্টা করবেন না।
ভ্রমণ মানে শুধু টাকা খরচ করা নয়, ভ্রমণ মানে নিজেকে খুঁজে পাওয়া, নতুনকে জানা, আর প্রাণ ভরে উপভোগ করা। এই সাশ্রয়ী ভ্রমণ গাইড প্রমাণ করে, কম খরচে ঘোরার প্ল্যান করাটা শুধু সম্ভবই নয়, বরং অনেক বেশি সমৃদ্ধ ও সত্যিকারের অভিজ্ঞতাময় হতে পারে। সচেতন পছন্দ, স্থানীয় পদ্ধতিকে গ্রহণ করা, আর প্রকৃতির মাঝে ডুবে থাকার মানসিকতা – এই তিন নিয়েই আপনি পাড়ি দিতে পারেন বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে। আপনার পকেটের অবস্থা যাই হোক, দম ফেলার জন্য, নতুন কিছু দেখার জন্য, নিজেকে রিচার্জ করার জন্য অপেক্ষা করছে দেশের কোণে কোণে ছড়িয়ে থাকা অজস্র সৌন্দর্য। তাহলে আর দেরি কেন? আপনার পরবর্তী অ্যাডভেঞ্চারের জন্য প্ল্যান শুরু করে দিন আজই – জুতো বেঁধে, ব্যাগ গুছিয়ে, খুলে রাখুন অভিজ্ঞতার খাতা। বাংলাদেশই আপনার সেরা গন্তব্য!
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।