ওবায়দুল্লাহ রনি : উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের সঞ্চয় করার ক্ষমতা কমেছে। এর প্রভাব পড়েছে ব্যাংকের আমানত সংগ্রহে। অন্যদিকে ডলার সংকট মেটাতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে বিক্রির কারণে বাজার থেকে গত দুই বছরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে ঢুকেছে ২ লাখ কোটি টাকার বেশি। এতে ডলারের পাশাপাশি টাকারও সংকট তৈরি হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে বাজারে তারল্য জোগান ঠিক রাখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কম সুদ ও সহজ শর্তের ৪৬ হাজার কোটি টাকার পাঁচটি পুনঃঅর্থায়ন তহবিল গঠন করে। শূন্য দশমিক ৫০ থেকে ৩ শতাংশ সুদে এখান থেকে টাকা পাচ্ছে ব্যাংক। এত কম সুদ ও সহজ শর্তের পরও পুনঃঅর্থায়ন তহবিলের ঋণে তেমন সাড়া নেই। গত জুন পর্যন্ত এসব তহবিল থেকে বিতরণ হয়েছে মাত্র ১৬ হাজার ২৮৩ কোটি টাকা, যা মোট তহবিলের ৩৫ দশমিক ৪০ শতাংশ।
সংশ্লিষ্টরা জানান, আমানত নিয়ে ব্যাংকগুলোর তহবিল সংগ্রহ করতে এখন ৫ থেকে ৮ শতাংশ ব্যয় হচ্ছে। আর ৯ শতাংশ সুদের সীমা উঠে যাওয়ায় গ্রাহক পর্যায়ের ঋণে (ক্রেডিট কার্ড বাদে) সুদ নিচ্ছে ১১ শতাংশ পর্যন্ত। অথচ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এসব পুনঃঅর্থায়ন থেকে গ্রাহক পর্যায়ে ঋণের সুদহার ৪ থেকে ৭ শতাংশ।
জানা গেছে, পুনঃঅর্থায়ন তহবিলে কিছু শর্ত থাকায় অনেক ব্যাংক আগ্রহ দেখাচ্ছে না। তহবিল থেকে টাকা না নিয়ে কোনো কোনো ব্যাংক উচ্চ সুদে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং অন্য ব্যাংক থেকে কলমানিতে বড় অঙ্কের টাকা ধার করছে। গত বুধবার এক ব্যাংক আরেক ব্যাংক থেকে গড়ে ৬ দশমিক ৩০ থেকে ৭ দশমিক ৭২ শতাংশ সুদে ধার নেয় ৮ হাজার ৭৭১ কোটি টাকা। একই দিন সাড়ে ৬ থেকে সাড়ে ৮ শতাংশ সুদ কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নেয় ৮ হাজার ১১ কোটি টাকা। তহবিল সংকটের কারণে আটটি ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংকে বিধিবদ্ধ নগদ জমা বা সিআরআর সংরক্ষণ করতে পারছে না।
ব্যাংকাররা জানান, পুনঃঅর্থায়ন থেকে তহবিল নিতে অনেক ধরনের শর্ত মানতে হয়। আবার মেয়াদ শেষ হলেই ব্যাংক গ্রাহকের কাছ থেকে আদায় করতে না পারলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা কেটে নেয়। যে কারণে ব্যাংকগুলোর এ ধরনের তহবিলে আগ্রহ কম। নানা উপায়ে তারাই গ্রাহকদের নিরুৎসাহিত করে। আবার গ্রাহকদের মধ্যে যারা ভুয়া বা বেনামি ঋণ নেন, তাদের কাছে সুদহার মুখ্য নয়। যে করেই হোক, যোগসাজশ করে তারা টাকা বের করতে চান। পুনঃঅর্থায়ন তহবিলে নজরদারি থাকে অনেক বেশি। ফলে এখান থেকে ঋণ বিতরণে অনেক সতর্ক থাকতে হয় ব্যাংকারদের। আবার প্রকৃত ব্যবসায়ীদের এখনকার মূল সংকট ডলার। ডলারের অভাবে অনেকে কাঁচামাল আনতে পারছেন না। বিশেষ করে, ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাতের অনেক শিল্পকারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে অনেক গ্রাহক এখন ঋণই নিতে চাইছেন না।
বেসরকারি মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল বা ইডিএফ থেকে ঋণ দেওয়া হয় ডলারে। এর বিকল্প হিসেবে টাকায় রপ্তানি সহায়ক তহবিল করা হয়েছে। তবে এ সময়ে গ্রাহক পর্যায়ে ডলারের চাহিদা বেশি। আবার উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে বর্তমানে মানুষের প্রকৃত ক্রয়ক্ষমতা কমেছে। ফলে ব্যাংকগুলোও ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রেও আগের চেয়ে সতর্ক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালের আগস্ট থেকে এ পর্যন্ত রিজার্ভ থেকে ব্যাংকগুলোর কাছে ২ হাজার ২৫০ কোটি ডলার বিক্রির বিপরীতে ২ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা উঠে এসেছে। এদিকে গত জুন পর্যন্ত ব্যাংক খাতে আমানত বেড়েছে মাত্র ৮ দশমিক ৪৪ শতাংশ। সাম্প্রতিক কোনো বছরে এত কম প্রবৃদ্ধি হয়নি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সহকারী মুখপাত্র মো. সরোয়ার হোসেন বলেন, পুনঃঅর্থায়ন থেকে ঋণ নিতে ব্যাংক ও গ্রাহককে বিভিন্ন মানদণ্ড মানতে হয়। কেউ যদি নিয়ম পরিপালন না করেন, তাহলে ঋণ পাবেন না। এসব কারণে তহবিল সংকট থাকলেও হয়তো পুনঃঅর্থায়ন থেকে সেভাবে ঋণ বিতরণ হচ্ছে না।
ডলারের বিকল্প দুই তহবিলে সাড়া কম
আইএমএফের শর্ত মেনে রিজার্ভের হিসাব করতে গিয়ে বিভিন্ন তহবিলে জোগান দেওয়া অর্থ বাদ দিতে হচ্ছে। এ কারণে ডলারে গঠিত তহবিলের আকার কমাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ইডিএফের আকার ৭ বিলিয়ন থেকে কমিয়ে এরই মধ্যে ৪ দশমিক ১০ বিলিয়ন ডলারে নামানো হয়েছে। আর কারখানা সবুজায়নের জন্য গঠিত ২০০ মিলিয়ন ডলার এবং ২০০ মিলিয়ন ইউরোর গ্রিন ট্রান্সফরমেশন ফান্ডের (জিটিএফ) আকার কমানো হয়েছে। এর বিকল্প ১৫ হাজার কোটি টাকার কম সুদের দুটি পুনঃঅর্থায়ন তহবিল করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
ইডিএফের তুলনায় কম সুদে বিতরণের জন্য চলতি বছরের জানুয়ারিতে ১০ হাজার কোটি টাকার রপ্তানি সহায়ক তহবিল করা হয়। এ থেকে ব্যাংক দেড় শতাংশ সুদে অর্থ নিয়ে গ্রাহক পর্যায়ে ৪ শতাংশ সুদে বিতরণ করছে। গত জুন পর্যন্ত ইডিএফের বিকল্প এ তহবিল থেকে বিতরণ হয়েছে মাত্র ৩ হাজার ৮৮৬ কোটি টাকা বা ৩৮ দশমিক ৮৫ শতাংশ ঋণ। অথচ এখান ১০০ শতাংশ বিতরণের সুযোগ ছিল। জিটিএফের জন্য ডলারের বিকল্প ৫ হাজার কোটি টাকার তহবিল গঠন করা হয় গত বছরের ডিসেম্বরে। এখান থেকে ব্যাংকগুলো ১ শতাংশ সুদে অর্থ নিয়ে গ্রাহক পর্যায়ে বিতরণ করে সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ সুদে। এই তহবিল থেকে জুন পর্যন্ত বিতরণ হয়েছে মাত্র ১৬৫ কোটি টাকা বা ৩ দশমিক ৩০ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা বলেন, ব্যাংক ও গ্রাহকের এখন দরকার ডলারের তহবিল। তবে আইএমএফের পদ্ধতি অনুসারে রিজার্ভের হিসাবের কারণে ইডিএফ, জিটিএফের আকার কমিয়ে আনা হচ্ছে। ফলে কম সুদ ও সহজ শর্তের পরও তহবিল থেকে ঋণ নিতে তেমন আগ্রহ নেই।
পড়ে আছে সিএমএসএমই তহবিলের ১৪ হাজার কোটি টাকা
তহবিল সংকটের এ সময়ে কটেজ, মাইক্রো, ক্ষুদ্র ও মাঝারি (সিএমএসএমই) শিল্পে ঋণ দিতে অনীহা দেখায় ব্যাংক। যে কারণে গতবছরের জুলাইতে ২৫ হাজার কোটি টাকার একটি তহবিল গঠন করে বাংলাদেশ ব্যাংক। মাত্র ২ শতাংশ সুদে অর্থ নিয়ে গ্রাহক পর্যায়ে সর্বোচ্চ ৭ শতাংশ সুদে বিতরণ করবে। একজন উদ্যোক্তাকে পাঁচ বছর মেয়াদে ঋণ দেওয়া যাবে। বর্তমানে সিএমএসএমইতে ঋণ নিতে যেখানে ১১ শতাংশের বেশি সুদ গুনতে হয়। এত আকর্ষণীয় হওয়ার পরও এই তহবিল থেকে গত জুন পর্যন্ত এক বছরে বিতরণ হয়েছে মাত্র ১১ হাজার কোটি টাকা বা ৪৪ শতাংশ ঋণ। পড়ে আছে ১৪ হাজার কোটি টাকা।
খাদ্য নিরাপত্তা এবং গম, ভুট্টা চাষে ৪ শতাংশ সুদের তহবিলে সাড়া কম
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর হুমকির মুখে পড়ে বৈশ্বিক খাদ্য নিরাপত্তা এবং গম-ভুট্টার আমদানি। এ অবস্থায় গত বছরের আগস্টে গম ও ভুট্টা চাষের ১ হাজার কোটি টাকা এবং গত বছরের নভেম্বরে খাদ্য নিরাপত্তার জন্য ৫ হাজার কোটি টাকার তহবিল করে বাংলাদেশ ব্যাংক। দুটি তহবিল থেকেই ব্যাংকগুলো মাত্র দশমিক ৫০ শতাংশ সুদে অর্থ নিয়ে গ্রাহক পর্যায়ে ৪ শতাংশ সুদে বিতরণ করছে। গম-ভুট্টায় বিতরণ হয়েছে ১৫৬ কোটি টাকা, যা মাত্র ১৫ দশমিক ৫৯ শতাংশ। আর খাদ্য নিরাপত্তার জন্য গঠিত তহবিল থেকে বিতরণ হয়েছে ১ হাজার ১০০ কোটি টাকা বা ২২ শতাংশ। সূত্র : সমকাল
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।