আন্তর্জাতিক ডেস্ক: তুন করোনাভাইরাস বা কোভিড নাইনটিন আক্রান্ত প্রথম ব্যক্তিটি কে? তাকে বলা হয় ‘পেশেন্ট জিরো’ – এবং নিংসন্দেহে তিনিই চলমান এই করোনাভাইরাস সংক্রমণের উৎস। খবর বিবিসি বাংলার।
কিন্তু কে তিনি – চীনের কর্তৃপক্ষ আর বিশেষজ্ঞরা এ নিয়ে একমত নন। তাকে চিহ্নিত করতে অনুসন্ধান এখনো চলছে।
আরো একটা প্রশ্ন : এটা জানার কি আদৌ কোন প্রয়োজন আছে? বিজ্ঞানীরা বলেন, হ্যাঁ আছে।
পেশেন্ট জিরো-কে খুঁজে বের করা প্রয়োজনীয় কেন?
যে কোন একটা বিশেষ ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণজনিত রোগে আক্রান্ত প্রথম ব্যক্তিটিকে বলা হয় ‘পেশেন্ট জিরো।’
তাকে চিহ্নিত করা জরুরি এই জন্য যে – তাহলে কেন, কিভাবে এবং কোথায় এই সংক্রমণের সূচনা হয়েছিল, তা জানা সহজ হবে।
সংক্রমণের হাত থেকে মানুষকে রক্ষা করা এবং ভবিষ্যতে এর প্রাদুর্ভাব ঠেকানো দু-কারণেই পেশেন্ট জিরোকে চিহ্নিত করা জরুরি।
করোনাভাইরাসের পেশেন্ট জিরো কে তা কি আমরা জানি? এক কথায় এর উত্তর হচ্ছে – না, জানি না।
চীনের কর্তৃপক্ষ বলছে, সেখানে প্রথম করোনাভাইরাস কেস ধরা পড়ে ৩১শে ডিসেম্বর, এবং চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহরের একটি সামুদ্রিক খাবার ও পশুপাখীর বাজারের সাথে এর প্রথম সংক্রমণগুলোর সম্পর্ক আছে।
চীনে যে ৭৫ হাজারেরও বেশি লোকের দেহে এ সংক্রমণ ঘটেছে – তার ৮২ শতাংশই নিবন্ধিত হয়েছে এই হুবেই অঞ্চল থেকে। এ তথ্য জনস হপকিন্স ইউনিভার্সিটির।
কিন্তু চীনা গবেষকদের এক জরিপ যা ল্যান্সেট সাময়িকীতে প্রকাশিত হয় – তাতে বলা হয় কোভিড নাইনটিন ভাইরাসে সংক্রমণ চিহ্নিত হয় একজন লোকের দেহে ২০১৯ সালের পহেলা ডিসেম্বর। এবং, সেই ব্যক্তিটির সাথে উহান শহরের ওই বাজারের কোন সম্পর্ক ছিল না।
ওই জরিপের অন্যতম প্রণেতা এবং উহানের জিনইন্টান হাসপাতালের ডাক্তার উ ওয়েনজুয়ান বলেন, প্রথম রোগীটি ছিলেন একজন বয়স্ক পুরুষ যিনি আলঝেইমার্স ডিজিজ-এ আক্রান্ত ছিলেন। তিনি যেখানে থাকতেন সেখান থেকে ওই বাজারে যেতে চার-পাঁচবার বাস বদলাতে হয়। তা ছাড়া তিনি অসুস্থ থাকায় বাড়ি থেকেও বেরুতেন না।
তবে এটা ঠিক যে প্রথম দিকে যে ৪১ জন সংক্রমণের কারণে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন – তার মধ্যে ২৭ জনই উহানের সেই বাজারের সংস্পর্শে এসেছিলেন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা মনে করে, খুব সম্ভবত প্রথম একটি জীবিত প্রাণী থেকে মানুষে সংক্রমণ ঘটেছিল, এবং তার পর সেই মানুষটি থেকে অন্য মানুষে সংক্রমণ ঘটে।
একজন লোক থেকে কি এত বড় আকারে রোগ ছড়াতে পারে?
ইবোলা রোগের ভাইরাস প্রথম চিহ্নিত হয়েছিল ১৯৭৬ সালে, কিন্তু ২০১৪ থেকে ২০১৬ সালে পশ্চিম আফ্রিকায় যে ইবোলার প্রাদুর্ভাব হয় – সেটাই ছিল সবচেয়ে বড় আকারের।
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার হিসেব অনুযায়ী এতে মারা যায় ১১ হাজারের বেশি লোক, আর সংক্রমিত হয়েছিল ২৮ হাজার।
দু বছর ধরে চলা এ সংক্রমণে আক্রান্ত লোক পাওয়া গিয়েছিল ১০টি দেশে। এর মধ্যে আফ্রিকান দেশ ছাড়াও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, স্পেন, যুক্তরাজ্য এবং ইটালিও আছে।
বিজ্ঞানীরা নানা পরীক্ষা ও অনুসন্ধানের মাধ্যমে নিশ্চিত হয়েছেন যে এর উৎস ছিল গিনির মেলিয়ান্দো গ্রামের দু’বছর বয়সের একটি শিশু।
বিজ্ঞানীরা বলেন, খুব সম্ভবত বাদুড়ের ঝাঁক বাস করে এমন একটি গাছের কোটরে ঢুকে খেলতে গিয়েই সে সংক্রমিত হয়েছিল।
ঐতিহাসিক পেশেন্ট জিরো – টাইফয়েড মেরি।
আমেরিকার নিউ ইয়র্ক শহরে ১৯০৬ সালের টাইফয়েড জ্বরের প্রকোপের পেশেন্ট জিরো ছিলেন মেরি ম্যালন নামে এক মহিলা।
আয়ারল্যান্ড থেকে যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসী হওয়া মেরি বিভিন্ন বড়লোকের বাড়িতে রাঁধুনী হিসেবে কাজ করতেন।
যে বাড়িতেই মেরি কাজ করেছেন সে বাড়ির লোকেরাই টাইফয়েডে আক্রান্ত হচ্ছিল।
কিন্তু মেরি ছিলেন এমন একজন ‘সুস্থ’ জীবাণু বাহক – যার নিজের দেহে কোন রোগের লক্ষণ দেখা যায়নি, কিন্তু তার সংস্পর্শে আসা অন্তত ১০০ লোককে তিনি সংক্রমিত করছিলেন।
তাই মেরিকে বলা যায় প্রথম ‘সুপার স্প্রেডার’দের একজন।
নিউ ইয়র্কের সেই টাইফয়েড মহামারীতে আক্রান্ত প্রতি ১০ জনের একজন মারা গিয়েছিলেন।
সব বিজ্ঞানী অবশ্য এমন লোকদের চিহ্নিত করতে চান না
মাত্র একজন লোক যদিও বা একটা মহামারীর জন্ম দিতে পারে – কিন্তু তাকে চিহ্নিত করার পক্ষে নন অনেক বিজ্ঞানীই।
কারণ তাতে ওই রোগ নিয়ে মিথ্যে তথ্য ছড়াতে পারে এবং সেই লোকটিও ভিকটিমে পরিণত হতে পারে।
এর সবচেয়ে বিখ্যাত উদাহরণ হলেন কানাডিয়ান গেটান ডুগাস – যাকে ভুলবশতঃ এইডস মহামারীর উৎস বা ‘পেশেন্ট জিরো’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল।
তিনি ছিলেন সমকামী এবং বিমানের ফ্লাইট এ্যাটেনডেন্ট হিসেবে কাজ করতেন। ১৯৮০র দশকে তাকে আমেরিকায় এইচআইভি ছড়ানোর জন্য দায়ী করা হয়।
কিন্তু সেটা ছিল ভুল। তিন দশক পরে – ২০১৬ সালের এক জরিপে – বিজ্ঞানীর বলেন, মি. ডুগাস এইডসের পেশেন্ট জিরো হতে পারেন না, এবং এই ভাইরাস আসলে ১৯৭০এর দশকের শুরুতে ক্যারিবিয়ান অঞ্চল থেকে যুক্তরাষ্ট্রে ঢুকেছিল।
তবে ‘পেশেন্ট জিরো’ কথাটার জন্ম হয়েছিল ১৯৮০র দশকে যুক্তরাষ্ট্রে এইচআইভি রোগের বিস্তার নিয়ে গবেষণার সময়ই।
যুক্তরাষ্ট্রের সিডিসি নামের গবেষণাকেন্দ্রের গবেষকরা ক্যালিফোর্নিয়ার বাইরে থেকে আসা কোন এক রোগীকে বোঝাতে আউটসাইড শব্দটির প্রথম অক্ষর ‘ও’ ব্যবহার করেছিলেন।
অন্য গবেষকরা ভেবেছিলেন এই ‘ও’ অক্ষর দিয়ে শূন্য বা জিরো বোঝানো হয়েছে – কারণ ইংরেজিতে জিরোকে অনেক সময় ‘ও’ বলা হয়।
এভাবেই পেশেন্ট ‘ও’ কথাটা পরিণত হয় পেশেন্ট জিরো-তে ।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।