মাসরুর আরেফিন: সহকর্মী মুজতবা শাহরিয়ারের আকস্মিক মৃত্যুর কারণে আজ সিটি ব্যাংক পরিবারের ৬,০০০ কর্মী পুরো স্তব্ধ, দেশের ব্যাংকপাড়া শোকে পাথর, আতংকে থমথমে। মুজতবা ছিল আমাদের মানব সম্পদ বিভাগে সিনিয়র ম্যানেজার অপারেশনস; ব্যাংকের এসএভিপিদের মধ্যে সবচেয়ে মেধাবী একজন। অবাক লাগে যে এই গত পরশুও (২৪ এপ্রিল) টানা দু ঘন্টা ব্যাংকের ভিডিও কনফারেন্স কলে ছিল সে; মাত্র পাঁচ দিন আগেও ব্যাংকে বাইরের কোম্পানি থেকে আসা আউটসোর্সড এমপ্লয়িদের (মানে ব্যাংকের পিয়ন, ক্লিনার, দারোয়ান, এদের) এ-বছরের বেতনের ইনক্রিমেন্ট সংক্রান্ত মেমোটা আমার জন্য বানিয়ে দিয়েছিল সে-ই। সেই ছেলের জ্বর আসছে যাচ্ছে গত সাত দিন ধরে, সেই জ্বর আবার এমন কিছু না—এমন কিছু না বলেই সে বাসায় বসে অফিসের কাজ করে যাচ্ছে স্বাভাবিক। তার পরিবারে বোন ও বোনের স্বামী দুজনেই বড় ডাক্তার। তারা আন্দাজ করলেন যে তার জ্বরের কারণ ইউরিন ইনফেকশন। তবু জ্বর আছে বলে এ-পরিস্থিতিতে আমরা সবাই যেটা করব, তা-ই করল সে—গত সাত দিনে দুটো Covid-19 টেস্ট করালো Covid-19-এর জন্য নির্দিষ্ট দুই হাসপাতালে গিয়ে। দুটো রিপোর্টই “নেগেটিভ” এসেছিল; আর এর মধ্যেই, আগে যেমন বলেছি, শাহরিয়ার অফিসের কাজ করে গেল বাসায় বসে, আমাদের বাকি সবার মতোই।
শেষমেশ জ্বর যাচ্ছে না বলে সেই সে নিজে নিজে কাল সকাল দশটায় গেল মুগদার Covid কেসের জন্য নির্দিষ্ট হাসপাতালটাতে। ডাক্তাররা তার সার্বিক লক্ষণ দেখে তাকে তৎক্ষণাৎ ভর্তি করে নিলেন। তারপর ওখান থেকেই সে দুপুরে স্বাভাবিক কথা বলল কলিগদের সঙ্গে, রাত দশটায় এক ঘন্টা কথা বলল তার স্ত্রীর সঙ্গে, বলল “ঘুমাতে যাচ্ছি”, তারপর—আমরা শুনছি—রাত একটার পর থেকে দ্রুত পরিস্থিতি খারাপ হতে লাগল তার, আইসিইউ-তে নেওয়া হলো তাকে এবং সে মারা গেল ভোর পাঁচটার কাছাকাছি কোনো এক সময়ে, আর আজ জোহরের নামাজের পরে তাকে দাফন করা হলো তালতলা গোরস্থানে, পরিবারের কাউকেই—তাদেরই নিরাপত্তার স্বার্থে—থাকতে দেওয়া হলো না পাশে, তারা কেউই একবারের জন্যও দেখতে পেল না মুজতবা শাহরিয়ারের মুখ।
আমরা শুনছি কাল সকাল ১০টায় সে মুগদার Covid হাসপাতালে গেলে তাকে যে Covid-19 টেস্টটা করা হয়, সেটা “পজিটিভ” এসেছে। আমরা নিশ্চিত করে জানি না। আমরা ফরমাল ডেথ সার্টিফিকেট-এর জন্য অপেক্ষা করছি এখন। ব্যাংক এমডি হিসাবে আমার কাছে মিডিয়ার ফোন আসছে তো আসছেই। আমি অফিশিয়ালি বলতে পারছি না মুজতবার এই অকাল মৃত্যু করোনা ভাইরাসের কারণে কিনা, যদিও বোঝা যাচ্ছে এটা তা-ই, এবং আমরা সবদিকে শুনছিও তাই। আর তা-ই যদি না হবে তো তাকে কাল ওই অসুখের জন্য নির্দিষ্ট করা হাসপাতাল তৎক্ষণাৎ ভর্তি করে নেবে কেন, আর আজ তারা এরকম সর্বোচ্চ সতর্কতার সঙ্গে Covid-19-এ মৃত মানুষের মতো করে তাকে ওই মমতাশুন্য দাফনই বা দেবে কেন? আর Covid ছাড়া কে হবে এমন ঘাতক যে এই চল্লিশ বছর বয়সের হাসিখুশি ছেলেটার জীবন কেড়ে নেবে এভাবে আকস্মিক, মাত্র এক রাতের মধ্যে, সাত দিনের সাধারণ এক না-ঘাবড়ানো-মতো জ্বরের শেষে?
এখানেই আমার ভয় যে আমরা পারব তো এই ভয়ঙ্কর ঘাতককে মোকাবিলা করতে? আমি ব্যক্তিগতভাবে দেখি না যে একমাত্র আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ছাড়া ওপরের দিকের আর কেউ এ বিষয়ে মাথা ঠাণ্ডা রেখে সেন্সিবলি কাজ করছেন, সেন্সিবলি কথা বলছেন। তো, উনি একা কী করে এই অবিশ্বাস্য নির্মম ঘাতককে ঠেকাবেন? আমাদের বাকি প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রস্তুতির কী দশা? ওপরের দিকের কাউকে তো “মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন” বলে তোষামোদ করে করে কথা বলা ছাড়া তাদের নিজেদের থেকে দায়িত্ব নিয়ে কিছু, ডিসাইসিভ কোনো কিছু, বলতে শুনি না। আর অন্যদিকে বাঙালি হিসাবে আমাদের সাধারণ মানুষদের স্বেচ্ছাচারী আচরণের যে কথা, তাতে পরে আসছি।
মুজতবা শাহরিয়ারকে হারিয়ে জানলাম (তার সঙ্গে আমার শেষ দেখা গত মাসের ২৪ বা ২৬ তারিখে; HR Operations মানে এমডি-র সঙ্গে কাজ থাকবেই, তাই আমার রুমে সে আসত প্রায়ই) যে, Covid-19 নামের অসুখটাকে হালকাভাবে নেবেন না, একদমই না। সে আসবে হয়তো সাধারণ জ্বরের বেশে, কিম্বা সাধারণ ডায়রিয়া বা ইউরিন ইনফেকশন বা গলা ব্যথা ইত্যাদি ইত্যাদির ঘাড়ে চেপে। আবার এটাও বুঝলাম যে, জলজ্যান্ত একটা ছেলে যদি এক দিনের মধ্যে এই ভাইরাসের ঝড়ে দিকচিহ্নহীন হয়ে যেতে পারে তো, ভয় পাবারও আসলে এখানে কিছু নেই। বাসায় সাপ এলে আমরা ভয় পাব, কিন্তু ধরেন ডাইনোসর এলো, তাহলে? জানি না। তবে বুঝতে পারছি যে, ভয় পাওয়াটা ভালো না হতে পারে, কিন্তু প্রস্তুতি নেওয়াটা অবশ্যই ভালো কিছু। Covid মোকাবিলার প্রস্তুতি নিন বারবার হাত ধুয়ে, বাইরে মাস্ক গ্লাভস ইত্যাদি পরে গিয়ে, লবণ মেশানো গরম পানি দিয়ে গড়গড়া করে, হাড়িতে গরম পানি নিয়ে তাতে আদা লেবু ইত্যাদি একটু মিশিয়ে মাথার চারপাশ তোয়ালে দিয়ে মুড়ে গরম ভাপ নিয়ে, যেন একদম সাফ হয়ে যায় গলা থেকে নিয়ে ফুসফুস পর্যন্ত, আর প্রস্তুতি নিন প্রচুর পানি পান করে (গরম পানি), লেবু তেঁতুল জাতীয় ফল আর বেশি বেশি শাকসবজি এসব খেয়ে, রেড মিট বাদ দিয়ে মাছ ভালোবেসে এবং গা ঘামিয়ে ব্যায়াম করে, যাতে ফুসফুস থাকে শক্তিশালী ও সচল। কাল সন্ধ্যার পর থেকে, আমার অনুমান, মুজতবা শাহরিয়ারকে ওই ভাইরাস তার ফুসফুসে গিয়েই আঘাত করেছিল এবং তাকে কাবু করে ফেলেছিল এক রাতের মাত্র ক’ঘণ্টার মধ্যেই।
সিটি ব্যাংক মুজতবা শাহরিয়ারের পরিবারের জন্য যা করার সব করবে, তার বেশিও করবে, কারণ এই ব্যাংকের বেসিক এক কালচারাল স্তম্ভই মানবিক বিবেচনা। কিন্তু আমরা কেউই শাহরিয়ারের বাচ্চা মেয়েটার কাছে তার বাবাকে ফিরিয়ে দিতে পারব না। তবে নতুন আরও মুজতবা শাহরিয়ার যেন আমাদেরকে না দেখতে হয় তাই আমরা অবশ্যই পারব সোশাল ডিসট্যান্সিং-এর নিয়মগুলো মেনে চলতে। আমি তো দেখি এখনও এদেশে মানুষ কথা বলছে মানুষের মুখের ওপরে ঠেলে উঠে এসে, গায়ের মধ্যে ঢুকে এসে, শরীরের ওপরে লাফিয়ে এসে। আজব আমরা!
আমাদের আজ থেকে মনে রাখা উচিত যে এটা এতখানিই দ্রুত চলা, এতখানিই অশান্ত, অস্থির ও মত্ত এক জীবননাশক ইনফেকশাস এজেন্ট যে, সে আপনাকে ধরলে পরে কোনো সময় না-ও দিতে পারে, আর তার রূপ ও চেহারা পরিবর্তনশীল এবং সে যথেষ্টই পাশব আর ক্ষিপ্র। পরশুদিনও যার সঙ্গে আমরা এক দুই মিনিট না, পুরো দু ঘণ্টা ভিডিও কল করলাম, এই ভাইরাস (ওটাই ধরে নিন হয়েছিল মুজতবা শাহরিয়ারের বেলায়, ওতেই তাহলে যদি কিছু সাবধান হন সবাই) তাকে চিরকালের মতো নিশ্চিহ্ন করে দিল মাত্র এক বেলার মধ্যেই! অতএব, একটু সাবধান, হে কারো-কোনো-কথা-না-মানা, গা-দুলিয়ে গা-ছেড়ে-চলা, সরকারের কথাকে থোড়াই কেয়ার করা, পৃথিবীর সব উপদেশকেই “ফালতু কথা” বলে উড়িয়ে দেওয়া আজন্ম মহাজ্ঞানী, আজন্ম লাগামছাড়া, বেসিক্যালি অবিনয়ী ও উদ্ধত বাঙালি।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।