মোঃ আজিজুল বাশার: প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসকে ইতোমধ্যে বৈশ্বিক মহামারী হিসেবে ঘোষণা করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। ভাইরাসটি সম্পূর্ণ নতুন ধরনের রোগ বিস্তারকারী জীবাণু, যার অস্থিত্ব আগে কখনও ছিল না। আমি পেশায় যেহেতু আইনজীবী সেহেতু এই ভাইরাসের বিস্তার ও রোধকল্পে কোনও বক্তব্য প্রদান না করে বরং এখানে কিছু আইনগত বিষয় তুলে ধরবো।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম মারফত ইতোমধ্যে আমরা জেনেছি যে, প্রায় প্রতি ১০০ বছরে তথা ১৭২০, ১৮২০, ১৯২০ এবং সর্বশেষ ২০২০ এ বৈশ্বিক মহামারী দেখা দিয়েছে। তন্মধ্যে ২০২০ ব্যতীত অন্য তিন সময়ে আমরা স্বাধীন দেশ ছিলাম না।
১৯২০ এর মহামারীর পূর্বে বিগত ১৮৯৭ সালে ব্রিটিশ-ভারত সরকার The Epidemic Diseases Act-1897 নামে আইন প্রণয়ন করে। এরপর উক্ত আইনের ২নং ধারার বিধান অনুসারে The Public Health (Emergency Provisions) Ordinance-1944, The Bangladesh Malaria Eradication Board (Repeal) Ordinance-1977 এবং The Prevention of Malaria (Special Provisions) Ordinance, 1978 নামে আইন প্রণয়ন করে। পরবর্তীতে বাংলাদেশ সরকারের ১০ম জাতীয় সংসদ উহার ২৩ তম অধিবেশনে সংক্রামক রোগ (প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল) আইন, ২০১৮ নামে আইন প্রণয়ন করে, যা বিগত ৩০ কার্তিক, ১৪২৫ মোতাবেক ১৪ নভেম্বর ২০১৮ তারিখে মাননীয় রাষ্ট্রপতির সম্মতি লাভ করে এবং ২০১৮ সালের ৬১ নাম্বার আইন হিসাবে গেজেটে প্রকাশিত হয়। আইনটিতে মোট ৩৫টি ধারা এবং একটি তফসিল রয়েছে। তফসিলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক প্রণীত নীতিমালা জাতীয় সংসদ কর্তৃক গৃহীত হয়।
বর্তমান মহামারী অবস্থায় সরকার কি করবে? জনগন কি করবে? তা মোটামুটি এই আইনে বলা আছে। আইনের ৯, ১০, ১১, ১২, ১৩, ১৪, ১৫, ১৬, ১৭, ১৮, ১৯, ২০, ২১, ২২, ২৩ ধারায় সরকারের করণীয় কি তা বলা আছে এবং সরকারের এতদিনের কার্যক্রমে সেসব কাজের প্রতিফলন রয়েছে। যেমন- বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিধি-বিধানের অনুসরণ, সংক্রামক রোগের তথ্য প্রদানে আইইডিসিআর ও স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয়ের প্রতিদিনের সংবাদ ব্রিফিং, সংক্রমিত এলাকা ঘোষণা ও প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ, নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষা, পরিদর্শন, সংক্রমিত স্থান বা স্থাপনা জীবাণুমুক্তকরণ, মৃতদেহের সৎকার ইত্যাদি।
তবে, সরকারের এসব কাজে সাফল্যের হার নেহাতই নগন্য। কোভিড-১৯ এ সারাবিশ্ব নাকাল তবে অন্যদের প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা আশাব্যঞ্জক। কিন্তু, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এ হার সন্তোষজনক নয়।
প্রথমত, বাংলাদেশের জনগনকে বোঝাতে ব্যর্থ হওয়া এ রোগের ক্ষতির ভয়াবহতা সম্পর্কে। এছাড়াও, এ ভাইরাসের বাহক শনাক্তকরনে ব্যর্থতাও অন্যতম। কিন্তু দেশের সরকারের পাশাপাশি জনগনের দায় ও দায়িত্ব রয়েছে বৈকি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নীতিমালা অনুসারে এ রোগের প্রাদুর্ভাব রোধ করতে জনসমাগম এড়িয়ে চলতে নির্দেশনা রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যেও এবং অবশিষ্ট সকল মুসলিম দেশ মসজিদে জামাত আয়োজনে সাময়িক নিষেধাজ্ঞা প্রদান করেছে।
এমনকি সৌদি আরবসহ অন্যান্য আরব দেশসমূহ আসন্ন ঈদুল ফিতরের জামাতের আয়োজনে ফতোয়া জানতে চেয়েছে। সেখানে বাংলাদেশের মানুষেরা আমরা রয়েছি রাস্তায় দাঁড়িয়ে আড্ডা দিতে, প্রয়োজন না থাকলেও বাজারে যেতে এবং এক কাঠি সরেস হিসাবে এদেশেরই এক জেলার মানুষ মুখে মাস্ক পরিধান করে দেশীয় অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে মারামারি করতে এবং প্রতিপক্ষের একজনের পা থেকে গোড়ালিসহ কেটে নিয়ে জয় বাংলা স্লোগান দিতে, যা কিনা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। যদি, তাই হয় তবে একাধিক অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। সেই আহত ব্যক্তি ইতোমধ্যে মারা গেছেন মানে দন্ডবিধির ৩০২ ধারার অপরাধ। আবার, গতকাল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছবিসহ এসেছে যে একজন আলেম ব্যক্তির জানাজা নামাজে লক্ষাধিক লোকের সমাগম হয়েছে। তাহলে আমরা বাংলাদেশের মানুষেরা কোন আইন মানছি? কোন আইন ই মানছি না।
সংক্রামক রোগ (প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল) আইন, ২০১৮ এর ২৪-২৬ ধারার বিধানমতে সংক্রামক রোগের বিস্তার ও তথ্য গোপনের অপরাধ, আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়িত্ব পালনে বাধা ও নির্দেশ পালনে অসম্মতি জ্ঞাপনের অপরাধ এবং মিথ্যা ও ভুল তথ্য প্রদানের অপরাধ সংঘটন হয়েছে যার দন্ড সর্বোচ্চ ৬ (ছয়) মাসের কারাদন্ড এবং সর্বোচ্চ ১ (এক) লক্ষ টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে। এতকিছু জানার পরেও বাংলাদেশের মানুষের আইনের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন কোনক্রমেই নেই। কিন্তু, এই না থাকার কারণে যে ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে তা সামাল দেওয়ার মত শারিরীক, আর্থিক ও মানসিক শক্তি রয়েছে কি?
মোঃ আজিজুল বাশার: অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট
[email protected]
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।