ওবায়দুর চৌধুরী: দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তুলে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিতের লক্ষ্যে গত পাঁচ দশকে প্রায় দেড় লাখ শিক্ষার্থী এবং বিদেশগামীকে কারিগরি প্রশিক্ষণ ও সেবা দিয়েছে মিরপুর এগ্রিকালচারাল ওয়ার্কশপ এন্ড ট্রেনিং স্কুল (মটস)।
এদের মধ্যে কেউ কেউ নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছেন ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা হিসেবে; অনেকে দেশের বিভিন্ন শিল্পে দক্ষ মানবসম্পদ হিসেবে যুক্ত হয়েছেন; বাকিরা পাড়ি দিয়েছেন বিদেশ বিভুঁইয়ে। বিশ্ব জনশক্তির বাজারে তারা নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছেন কর্মদক্ষ মানবসম্পদ হিসেবে। যে কারণে শক্তিশালী হয়েছে বাংলাদেশের প্রবাসী আয়।
কারিগরি প্রশিক্ষণ প্রদানে সুনাম অর্জন করায় বাংলাদেশ পুলিশ, বাংলাদেশ এয়ার ফোর্স, বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান কোকাকোল সহ বিভিন্ন জনশক্তি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান মটসের সেবা গ্রহণ করে আসছে।
যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন জনগোষ্ঠীর অভাব পূরণের লক্ষ্যে কারিতাস বাংলাদেশ ও কারিতাস সুইজারল্যান্ড আর্থিক সহায়তায় ১৯৭৩ সালে মিরপুর ১২ নম্বর সেক্টরে ২৩ বিঘা জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত হয় মটসের নিজস্ব ক্যাম্পাস। তখন ফার্ম মেশিনারিজ ও মেশিনিস্ট-এই দুটি ট্রেডে ৩০ জন শিক্ষার্থী নিয়ে মটসের পথ চলা শুরু হলেও এখন তা বিস্তৃত হয়েছে নানা ক্ষেত্রে।
মটসের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দেশের ১৬ থেকে ২০ বছরে তরুণদের জন্য তিন বছর মেয়াদি কারিগরি প্রশিক্ষণ কোর্স রয়েছে যেখানে এসএসসি পাশ করা শিক্ষার্থীরা অটোমোবাইল ও মেশিনিস্ট দুটি ট্রেডে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে পারে।
এছাড়া কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অনুমোদন নিয়ে ২০০৪ সাল থেকে ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্স চালু করা হয়েছে।পাশাপাশি বেকার ও কম যোগ্যতাসম্পন্ন তরুণদের জন্য রয়েছে ‘মডুলার’ নামে একটি শর্ট কোর্স। এই কোর্সে ন্যূনতম পঞ্চম শ্রেণি পাস থেকে শুরু করে ১৬ বছর বয়স পর্যন্ত যেকোন তরুণ-তরুণী আবেদন করতে পারে।
এছাড়া বিদেশি নিয়োগ সংস্থা বা কর্পোরেট অফিসের অনুরোধে গ্রুপ ভিত্তিক মডুলার কোর্সের ব্যবস্থা করা হয় এখানে।
মটস থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণের মাধ্যমে নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে অনেকেই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন। এমনই একজন ড্রিম পাওয়ার বাংলাদেশের সিইও ইঞ্জিনিয়ার সাইদুর ইসলাম।
মটস নিয়ে জুমবাংলার সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, ‘মটস থেকে আমার প্রধান শিক্ষা হলো নিয়মানুবর্তিতা। একটা স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে যে সময়কে মূল্য দিতে হয়, মটসে পড়াশোনার মাধ্যমে আমরা দৃঢ়ভাবে তা শিখেছি। এখান থেকে আমরা যে আধুনিক কারিগরি শিক্ষা পেয়েছি তার মাধ্যমে আমি আজ নিজেকে উদ্যোক্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছি।’
এখানকার শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পড়াশোনার পাশাপাশি মূল্যবোধ, নৈতিকতা, মানবিকতার চর্চাও করছে প্রতিষ্ঠানটি। মটস তার নিজস্ব আয় থেকে বছরে দুই কোটির অধিক টাকা ব্যয়ে প্রতিবছর গ্রামের দুশোজন দরিদ্র শিক্ষার্থীদের থাকা খাওয়া, চিকিৎসা ও পোশাক সহ ফ্রি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে আসছে।
এছাড়া নিয়মিত কোর্সগুলোতে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী বিশেষ করে নারী, দরিদ্র, প্রতিবন্ধী ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর প্রার্থীদের বিশেষ অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে। দূর-দূরান্ত থেকে আসা শিক্ষার্থীদের জন্য ক্যাম্পাসের ভিতরে নিজস্ব হোস্টেল ব্যবস্থা রেখেছে মটস। যেসব শিক্ষার্থীদের আর্থিক অসঙ্গতি ও থাকার জায়গার সমস্যা রয়েছে তারা ক্যাম্পাসে অবস্থান করে নির্বিঘ্নে প্রশিক্ষণ গ্রহণের সুযোগ পাচ্ছে । এছাড়া বিএসিআই ও সেইপ প্রকল্পের আওতায় শিক্ষার্থীরা মাসিক ৩০০০ টাকা বৃত্তি সহ বিনা বেতনে প্রশিক্ষণ নিতে পারছে।
মটসের কার্যক্রম সম্পর্কে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক জেমস গোমেজ বলেন, ‘প্রযুক্তির সার্থক নিয়োগে কল্যাণকর রাষ্ট্র বিনির্মাণে মটস নিয়মিত কাজ করে যাচ্ছে ।ভবিষ্যতের কর্মব্যবস্থার উপর নজর রেখে আমরা নিজেদেরকে আরও বেশি আন্তর্জাতিকভাবে সম্পৃক্ত করার চেষ্টায় নিয়োজিত রেখেছি।’
মটসের ক্যাম্পাস ঘুরে দেখা গেছে, এখানে আধুনিক উৎপাদন বিভাগ ও গবেষণা ল্যাব রয়েছে। ভ্যাকুটাগ যন্ত্র তৈরীর মাধ্যমে পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা উন্নয়ন করে স্বাস্থ্য সুরক্ষায় এসডিজি লক্ষ্য পূরণে কাজ করে যাচ্ছে মটস। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে শিক্ষা কার্যক্রমে যুক্ত করা হয়েছে ডিপ্লোমা-ইন-কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি ।
এছাড়া দেশ ও বিদেশের প্রযুক্তিনির্ভর কর্মব্যবস্থা ও পরিবেশের চাহিদাকে বিবেচনা রেখে জেনারেল কেয়ার গিভিং, গ্রাফিক্স ডিজাইন, কম্পিউটার অপারেশন, অ্যালুমিনিয়াম ফেব্রিকেশন, ফ্যাশন ডিজাইন সহ বিভিন্ন কোর্স চালু রয়েছে।
ক্যাম্পসেই কথা হয় মটসের শিক্ষার্থী আব্দুর কাদেরের সঙ্গে। জুমবাংলাকে তিনি বলেন, ‘আমার পূর্বে কোন কারিগরি জ্ঞান ছিল না। আমি লোকাল বিদ্যুতের কারিগরের কাছে কিছু শিখেছিলাম। মটসে আসার পরে তাদের কারিকুলাম ও কারিগরি প্রশিক্ষণ আমাকে সত্যি মুগ্ধ করেছে। আমি এখন বিদ্যুতের আর্কিটেকচার আঁকতে পারি। আমার ইচ্ছা আমি ভবিষ্যতে আরো পড়াশোনা করবো।’
শুরুতে প্রতিষ্ঠানটি কারিতাসের অন্তর্ভুক্ত একটি প্রকল্প হলেও ২০১১ সাল থেকে মটসের সকল টেকনিক্যাল স্কুল ট্রাস্টিবোর্ডের অধীনে পরিচালিত হচ্ছে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।