বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকে কেন্দ্র করে যাত্রাবাড়ী থানার কিশোর আব্দুল কাইয়ূম আহাদ হত্যা মামলায় সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হককে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দিয়েছেন আদালত।
গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে শুনানি শেষে ঢাকার অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো. ছানাউল্যাহর আদালত এই আদেশ দেন।
এর আগে সন্ধ্যা ৭টা ৪৫ মিনিটের দিকে তাকে আদালতে হাজির করে কারাগারে আটক রাখার আবেদন করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও যাত্রাবাড়ী থানার পুলিশ পরিদর্শক খালেদ হাসান। এরপর ৮ টা ১৫ মিনিটের দিকে পুলিশের কঠোর নিরাপত্তা বেষ্টনির মধ্যদিয়ে তাকে এজলাসে ওঠানো হয়।
আটক রাখার আবেদনে বলা হয়, আসামিদের ছোড়া গুলিতে মামলার বাদী মো. আলাউদ্দিনের ছেলে আব্দুল কাইয়ুমের মুখে ও বুকে গুলি লাগলে সে পুলিশ বক্সের সামনে লুটিয়ে পড়ে এবং তার আশেপাশে থাকা আরও কয়েকজন গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়। আসামি এ বি এম খায়রুল হক প্রধান বিচারপতি থাকাকালে ২০১১ সালের ১ মে থেকে বিভিন্ন সময়ে অপরাধমূলক বিশ্বাসভঙ্গ করে প্রতারণার উদ্দেশে জাল-জালিয়াতি করে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধ করেছেন। এ সংক্রান্ত নারায়ণগঞ্জ জেলাসহ বিভিন্ন থানায় তার বিরুদ্ধে মামলা আছে। আসামি একজন প্রভাবশালী বাক্তি। তাকে জামিনে মুক্তি দিলে প্রভাব বিস্তার করে মামলার তদন্তকাজে ব্যাঘাত ঘটানোর সম্ভাবনা আছে; ফলে তাকে বিচারের আগ পর্যন্ত জেলহাজতে আটক রাখা আবশ্যক।
এদিন রাত ৮টা ১৫ মিনিটে পুলিশের কড়া নিরাপত্তায় এজলাসে হাজির করা হয় সাবেক প্রধান বিচারপতিকে। ৮টা ১৬ মিনিটে এজলাসে আসেন বিচারক। এ সময় শুনানিতে বিএনপিপন্থী আইনজীবী আবুল কালাম আদালতকে বলেন, ‘শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট হওয়ার কারিগর এই বিচারক। শেখ হাসিনাকে ফ্যাসিস্ট করার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে এই বিচারক নামের কুলাঙ্গার।’
সাবেক বিচারপতি খায়রুল হককে উদ্দেশ্য করে ঢাকা বারের সভাপতি খোরশেদ মিয়া আলম বলেন, ‘এই খায়রুল হকের ইন্ধনে হত্যাযজ্ঞ হয়েছে। উনি ছোটবেলা থেকেই পাপাচারে লিপ্ত ছিলেন। উনি একজন নিকৃষ্ট পাপী। বিচার ব্যবস্থাকেও পাপাচারে ভরে ফেলেছেন। উনার এই বয়সে যে পাপ করেছেন, আমার মনে হয় না বাকি জীবনে উনার পাপের প্রায়শ্চিত্ত হবে। আরও ১০০ বছর বাঁচলেও উনার পাপ মোচন হবে না।’
এ সময় তিনি বলেন, ‘উনার (সাবেক বিচারপতি) কলমে খোঁচায় প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে টাকা লুট হয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রথা বাতিল করে যে নির্বাচনের কারিগর, তিনিই এই খায়রুল হক।’
অতিরিক্ত পিপি আজিজুল হক দিদার আদালতকে বলেন, ‘ইনি (খায়রুল হক) হাসিনার কৃতদাস ছিলেন। হাসিনার নির্দেশে বিচার বিভাগকে ধ্বংস করে দিয়েছিলেন। বর্তমান সরকার দেরিতে হলেও এই জালিমকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে। হাসিনার বিরুদ্ধে যতগুলো মামলা আছে সবগুলো তার বিরুদ্ধে হওয়া উচিৎ।’
তিনি আরও বলেন, ‘আইনের শাসন আছে, এজন্য উনাকে আদালতে হাজির করা হয়েছে। বিচারব্যবস্থা ভালো না থাকলে জনগণ উনাকে গণপিটুনি দিত। তার যথাযথ শাস্তি প্রয়োজন। এ সময় শুনানি চলাকালে ৮টা ৩২ মিনিটে বিদ্যুৎ চলে যায়। এদিন তার পক্ষের কোনো আইনজীবী ছিল না।’
এ সময় বিচারক বলেন, ‘মানুষের শ্রদ্ধা তার কাজের মাধ্যমে। আমার আপনার সকলের এই বিচার থেকে শিক্ষা নিতে হবে।’ এ সময় আদালতে উপস্থিত সবাই সাবেক বিচারপতির উদ্দেশ্য করে ‘ছি ছি’ করে ওঠেন। ৮টা ৩২ মিনিটে বিদ্যুৎ চলে যায়।
এ সময় মোবাইলের আলো জ্বালানো হলে বিচারক বলেন, আগে বিচারকদের মানুষ সম্মান-শ্রদ্ধা করতেন। কিন্তু কিছু বিরূপ কারণে সেই শ্রদ্ধার জায়গা থেকে সরে এসেছে। শ্রদ্ধা মানুষকে কর্মের মাধ্যমে অর্জন করতে হয়। সকলের শেখার আছে। সবাইকে কর্মের ফল ভোগ করতে হয়। কর্মের মধ্য দিয়েই ঘৃণা বা ভালোবাসা তৈরি হয়। ৮টা ৩৬ মিনিটে বিচারক এজলাস ত্যাগ করেন।
আদালতে নিশ্চুপ সাবেক বিচারপতি
এদিন আদালত চলাকালে পুরোটা সময় কাঠগড়া ধরে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে ছিলেন সাবেক এই প্রধান বিচারপতি। শুনানিতে বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা যখন তাকে উদ্দেশ্য করে আদালতে কথা বলছিলেন; তিনি মাথা নিচু করে ছিলেন। আদালতে তিনি কোনো কথা বলেননি। আদালত চলাকালীন ৮টা ১৫ মিনিট থেকে ৮টা ৩৬ মিনিটি পর্যন্ত নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তার চোখ-মুখে ক্লান্তির ছাপ বোঝা যায়।
বিএনপিপন্থী আইনজীবীদের স্লোগান
এদিকে শুনানি শেষে আদালত চত্বরে সাবেক এই প্রধান বিচারপতির ফাঁসি চেয়ে শ্লোগান দেন আইনজীবীরা। এ সময় তারা বলেন, এই কুখ্যাত বিচারকের একমাত্র শাস্তি ফাঁসি।
এদিকে খায়রুল হককে আদালতে নেওয়া হবে এই সংবাদে বিএনপিপন্থী আইনজীবী ও বিক্ষুব্ধ জনতা আগে থেকে অবস্থান নেন। এ সময় বিএনপিপন্থী আইনজীবী ও জনতা দুয়োধ্বনিসহ স্লোগান দিতে থাকেন।
এর আগে বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ৮টার দিকে রাজধানীর ধানমন্ডির বাসা থেকে সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হককে গ্রেপ্তার করেন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।
মামলা সূত্রে জানা গেছে, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময় গত ১৮ জুলাই যাত্রাবাড়ী থানাধীন এলাকায় কাজলা পুলিশ বক্সের সামনে গুলিবিদ্ধ হন কিশোর আব্দুল কাইয়ূম আহাদ। পরে যাত্রাবাড়ী থানার ওসি আবুল হাসান তার দুই পায়ে ব্রাশফায়ার করলে ঘটনাস্থলে সে মারা যায়। এ ঘটনায় নিহতের বাবা আলাউদ্দিন ৪৬৭ জনকে এজাহারনামীয় আসামি এবং অজ্ঞাতনামা ১ থেকে ২ হাজার জনকে আসামি করে যাত্রাবাড়ী থানায় হত্যা মামলা করেন।
বিচারপতি খায়রুল হক ২০১০ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর থেকে ২০১১ সালের ১৭ মে পর্যন্ত বাংলাদেশের ১৯তম প্রধান বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। অবসরের পর তিনি আইন কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন এবং শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর গত বছরের ১৩ আগস্ট সেই পদ থেকে পদত্যাগ করেন।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।