মুকিমুল আহসান, বিবিসি নিউজ বাংলা : সম্প্রতি বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন জায়গায় কালেমা খচিত কালো পতাকা নিয়ে মিছিলের বেশ কিছু ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। এসব মিছিল থেকে ফিলিস্তিনে গণহত্যা বন্ধ, ইসলামের নবী মুহাম্মদকে কটূক্তির প্রতিবাদ কিংবা কেউ ইসলামি খেলাফত কায়েমেরও দাবি তুলতে দেখা গেছে।
এসব ছবি ফেসবুক বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যারা শেয়ার করছেন তাদের কেউ কেউ দাবি করছেন, এই পতাকা ইসলামি জঙ্গিগোষ্ঠীর। বাংলাদেশে ইসলামি খেলাফত কায়েম করতেই এই পতাকা নিয়ে মিছিল করছে।
তবে, আরেকটি পক্ষ এটিকে সন্দেহের চোখে দেখছেন। তাদের বক্তব্য কোন রাজনৈতিক ইন্ধনেই এসব করা হয়ে থাকতে পারে।
যারা কালো পতাকা নিয়ে মিছিল করছে, তাদের উদ্দেশ্য নিয়েও প্রশ্ন করছেন অনেকে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, যারা কালো পতাকা নিয়ে মিছিল করছে তারা নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন হিযবুত তাহ্রীরের সদস্য।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ বা ডিএমপি কমিশনার মাইনুল হাসান বিবিসি বাংলাকে বলেন, “হিযবুত তাহ্রীর নিষিদ্ধ ঘোষিত হওয়ার কারণে তারা প্রকাশ্যে মাঠে নামতে পারছে বলেই অতর্কিতভাবে নামার চেষ্টা করছে। তাদের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান চলছে”।
মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে ইসরায়েলি হামলার প্রতিবাদে শুক্রবার জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমে থেকে একটি মিছিল বের করে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। ওই মিছিল তিনজনকে আটক করা হয়।
রোববারও রাজধানীর কয়েকটি কয়েক জায়গায় স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীদের কালো পতাকা নিয়ে মিছিল করতে দেখা গেছে। এ নিয়ে সামজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পক্ষে-বিপক্ষে নানা ধরনের আলোচনা সমালোচনাও চলছে।
পতাকা নিয়ে স্কুল কলেজ শিক্ষার্থীদের মিছিল
রোববার ঢাকার জাতীয় সংসদ ভবনের সামনে এমন একটি মিছিল দেখা যায়। সেই মিছিল বের করে সেখানকার একটি স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থীরা।
‘সচেতন শিক্ষক ও শিক্ষার্থীবৃন্দ, সেন্ট যোসেফ হায়ার সেকেন্ডারি স্কুল’ ব্যানার নিয়ে এই মিছিলটিতে বিভিন্ন শ্লোগান ও প্ল্যাকার্ড ও কালেমা লেখা পতাকা ছিল।
তাদের হাতে বাংলাদেশের পতাকা, ফিলিস্তিনের পতাকা এবং কালেমা লেখা পতাকাও ছিল। তারা যে ব্যানার নিয়ে মিছিল করছিল সেখানে লেখা ছিল ইসলামের নবীকে ভারতীয় পুরোহিত কর্তৃক কটূক্তি ও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের জবাবে তাদের প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ মিছিল।
সেই মিছিলে তাদের শ্লোগান দিতে শোনা যায়, ‘মুক্তির এক পথ, খিলাফত-খিলাফত’, ‘তুমি কে আমি কে, মুসলমান-মুসলমান’।
রোববার দুপুরে সংসদ ভবন এলাকায় সেই মিছিলের ভিডিও ধারণ করেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করেন সিনিয়র সাংবাদিক ফয়সাল আলম। তিনি বলেন, “ওই মিছিলে শিক্ষার্থীরা ভারতীয় পুরোহিতের মহানবীকে নিয়ে কটূক্তির প্রতিবাদ জানাচ্ছিল। শিক্ষার্থীদের সাথে তাদের কয়েকজন শিক্ষককেও দেখা গিয়েছিল ওই মিছিলে। সেখানে খিলাফত প্রতিষ্ঠা নিয়েও শ্লোগান দিচ্ছিল তারা”।
একই দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় টিএসসি এলাকায় একই রকমভাবে একটি মিছিল দেখা যায়। যেই মিছিলে শিক্ষার্থীদের হাতে ইসলামের কালেমা লেখা কালো ও সাদা পতাকা দেখা যায়।
যে সব ঘটনায় আলোচনা-সমালোচনা
গত সপ্তাহে ঢাকার নটরডেম কলেজ, ঢাকা কলেজ উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের শিক্ষার্থীরা রাজধানীতে আলাদা আলাদা মিছিল বের করতে দেখা যায়।
যেখানে তাদের কারো কারো হাতে বিশাল কালেমা লেখা কালো পতাকা দেখা যায়। কেউ কেউ আবার কাল কাপড়ে কালেমা লেখা পতাকা নিয়েও মিছিল করতে দেখা যায়।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ নিয়ে অনেককেই এ নিয়ে নানা সমালোচনা করতেও দেখা গেছে। এরই মধ্যে গত শুক্রবার কিশোরগঞ্জের একটি মিছিলের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।
ইসলামের নবীকে কটূক্তির প্রতিবাদে তৌহিদি জনতার ব্যানারে কিশোরগঞ্জ শহীদি মসজিদ থেকে ওই মিছিলটি বের হয়েছিল বলে বিবিসি বাংলাকে জানান স্থানীয় সাংবাদিক নূর মোহাম্মদ। তিনি বলেন, “ওই মিছিল থেকে কেউ কেউ নবীজির কটূক্তির প্রতিবাদ ছাড়াও ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠার দাবিতে শ্লোগান দিচ্ছিল”।
“এই মিছিলে কিছু লোক ঢুকে গিয়েছিল, তাদের কারো কাছে কালো পতাকা, গলায় কালারফুল মাফলারও পরিহিত ছিল”, বলছিলেন মোহাম্মদ।
ওই মিছিলে ব্যবহার হওয়া কালেমা লেখা কালো পতাকার বাইরেও একটি ভিন্ন রকমের পতাকার বিষয়টি নিয়েও নানা আলোচনা দেখা যায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।
ফ্যাক্ট চেকার কদরুদ্দিন শিশির ওই ভিডিওর তথ্য যাচাইয়ে পর ফেসবুকে ভিডিও থেকে নেয়া একটি ছবি শেয়ার করে জানান, ওইদিন সেই মিছিলে কথিত ইসলামিক স্টেট বা “আইসিসের’র পতাকা উড়ানো হয়েছে।
শিশির বলেন, “কিশোরগঞ্জের মিছিলে কালো কালেমার পতাকার বাইরেও একটি আলাদা পতাকা ব্যবহার হয়েছে যেটি সম্পূর্ণ আলাদা। এই পতাকা শুধুমাত্র আইসিস’ই ব্যবহার করে থাকে। যেটির সাথে জঙ্গিগোষ্ঠী আল কায়েদার পতাকারও মিল রয়েছে”।
রাজধানীতে এই ইসলামের কালেমা লেখা কালো পতাকা নিয়ে যারা মিছিলে অংশ নিতে দেখা গেছে গত কয়েকদিন তাদের বেশিরভাগই ছিল ঢাকার নামীদামী স্কুল কলেজের শিক্ষার্থী।
তবে কিশোরগঞ্জের মিছিলে কারা কথিত ‘আইসিস’র পতাকা ব্যবহার করেছে সেটি এখনো শনাক্ত করতে পারেনি পুলিশ।
তবে কালেমা লেখা পতাকা নিয়ে যেসব মিছিল বের হয়েছে, সেখান থেকে অনেককেই ইসলামি খেলাফত প্রতিষ্ঠার দাবিতে শ্লোগান দিতে দেখা গেছে।
এর আগে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর একই রকম পতাকা নিয়ে ঢাকায় কর্মসূচি পালন করতে দেখা গেছে নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন হিযবুত তাহ্রীরকে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সাইফুল আলম চৌধুরী বিবিসি বাংলাকে বলেন, “সাম্প্রতিক মিছিল গুলোতে কালেমা তাইয়্যেবা ও আইএস’র পতাকা প্রদর্শন করতে দেখা গেছে। দুইটা পতাকাই কালো রংয়ের”।
আগে বাংলাদেশে খুব কমই এই ধরনের পতাকার প্রদর্শন দেখা গেলও এখন হঠাৎ কেন এটি বেড়েছে সেই প্রশ্ন তুলেছেন মি. চৌধুরী।
খেলাফত ও জঙ্গিবাদ গবেষকদের মতে, ইসলামের নবীর যুগে কোন নির্দিষ্ট পতাকা ইসলামের প্রতীক হিসেবে পরিচিতি পায় নি কিংবা ইসলামের নির্দিষ্ট কোন পতাকাও কখনো ছিল না।
ইতিহাসের উদাহরণ টেনে তারা বলছেন, নবী মুহাম্মদের পরবর্তী খেলাফাতের জামানায় কালেমা লেখা কালো পতাকা ব্যবহার করতে দেখা গিয়েছে কোথাও কোথাও।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শাফি মো. মোস্তফা বলেন, “সাম্প্রতিক সময় এই পতাকা ব্যবহার করতে দেখি কথিত ইসলামিক স্টেট বা আইসিস গোষ্ঠীকে। সুতরাং বাংলাদেশে এখন এই ধরনের পতাকার ব্যবহার করলে এক ধরনের ট্যাগিংয়ের শিকার হওয়ার সম্ভাবনা থাকবেই”।
তবে, বিশ্লেষকরা এই পতাকার সাথে ধর্মের কোন সম্পর্ক আছে বলেও মনে করছেন না।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের প্রধান মো. মাসুদ করিম বিবিসি বাংলাকে বলেন, “আমরা এই বিষয়টি নিয়ে ক্লোজ মনিটরিং করছি। এর সাথে কারা জড়িত থাকতে পারে সেটাও তদন্ত করছি”।
গত শুক্রবার জুমার নামাজের পর মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলি হামলার প্রতিবাদ ও ভারতে ইসলাম ধর্ম ও ইসলামের নবীকে নিয়ে কটূক্তির প্রতিবাদ জানিয়ে জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমে বিক্ষোভ সমাবেশ ও মিছিলের ডাক দেয় ইসলামী আন্দোলন।
এই মিছিলে অংশ নেয় এমন তিনজনের কাছে হাতে কালো পতাকা, মাথায় পাগড়ি ছিল। পরে তাদেরকে আটক করে পুলিশ।
একই দিন অভিযান চালিয়ে আটক করা হয় নিষিদ্ধ সংগঠন হিযবুত তাহ্রীরের মিডিয়া সমন্বয়ক ইমতিয়াজ সেলিমকে।
ডিএমপি কমিশনার মাইনুল হাসান বলেন, “এতদিন বিভিন্নভাবে আড়ালে আবডালে থাকার পর এখন তারা মাঠে আসার চেষ্টা করছে। আমরাও আমাদের আইনি ব্যবস্থা নিশ্চিত করছি। তবে এসব সংগঠনকে প্রতিহত করতে হলে সাধারণ মানুষকেও এগিয়ে আসতে হবে”।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে জঙ্গিবাদ বা নিষিদ্ধ সংগঠনগুলো দমনে সরকার যে কঠোর ভূমিকা নিয়েছিল সেটিও ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। তারা বলছেন, ঢাকাসহ দেশে স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীরা যে মিছিল করছে তা শুধু হিযবুত তাহ্রীরের না।
“শুধু হিযবুত তাহ্রীর না, এখানে একটা সালাফি গ্রুপও রয়েছে হয়তো। যারা খেলাফাতের কথা বলে, সরাসরি সামনে আসছে না। তারা এভাবে মিছিল করে কি অর্জন করতে চায় তা গোয়েন্দাদের খুঁজে বের করতে হবে”, বলছিলেন জঙ্গিবাদ গবেষক শাফি মো. মোস্তফা।
গবেষকদের মতে, স্কুলের বাচ্চাদের হাতে পতাকা দিয়েছে পরে তারা মিছিলে নেমে গিয়ে শ্লোগান দিয়েছে, বিষয়টি যত সহজ ভাবা হচ্ছে ঠিক ততটা সহজ নয়।
ডিএমপির কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের প্রধান মি. করিম বিবিসি বাংলাকে বলেন, “যারা ধরা পড়ছে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। এমন অনেকে আছে যাদেরকে আমরা ওয়াচে রেখেছি”।
এ নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় যে আলোচনা চলছে তা নিয়ে সবাইকে সচেতন থাকার পরামর্শও দিয়েছে পুলিশ।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।