জুমবাংলা ডেস্ক: কোনো কিছু কেনা-বেচা করতে দরকার হয় মুদ্রার। বেশিরভাগ মুদ্রাই তো কাগজের। কিন্তু কখনো কি আমরা ভেবে দেখেছি পকেটের কিংবা মানিব্যাগে গোছানো মুদ্রা অর্থাৎ টাকাগুলো কেন এত গুরুত্ববহ? সাধারণ কাগুজে নোটই তো। সোনা কিংবা রূপা নয়। সাধারণ টাকা। চোখের দেখার দিক থেকে খুব একটা বিশেষ কিছু নয়। কিন্তু তারপরেও এটি টিকে গিয়েছে আমাদের অর্থনীতিতে। বর্তমানে মুদ্রা ছাড়া মানুষ অচল। আর সেই মুদ্রা প্রসঙ্গ নিয়েই আমাদের আজকের এই আলোচনা। একসময় তো আমরা স্বর্ণ ও রৌপ্যের মুদ্রা ব্যবহার করতাম বেশি। কিন্তু কীভাবে স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রার মতো দামি জিনিসকে পেছনে ফেলে কাগজের টাকা অর্থনীতিতে টিকে গেল?
প্রায় ৬০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মেসোপটেমিয় সভ্যতার সময়। বিনিময় ব্যবস্থার প্রচলন শুরু হয় এখানকার জাতিগোষ্ঠী ফোনিসিয়ানদের হাত ধরে। উৎপাদিত শস্য বিক্রি করতে তারা বিনিময় ব্যবস্থার প্রচলন করে। পরবর্তীতে ব্যবিলনিয়রা এই ব্যবস্থার আরো উন্নতি সাধন করে। খাবার, অস্ত্র, সরঞ্জামের বিনিময়ে তারা দ্রব্য আদান-প্রদান করতো। আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০০ অব্দে সুমেরিয়রা বার্লি বিক্রির জন্য প্রথম ধাতব মুদ্রা ব্যবহার করে। এরপর ৭০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে লিডিয়ায় রূপা ও সোনার সংকর দিয়ে তৈরি মুদ্রার প্রচলন শুরু হয়। লিডিয়া অর্থাৎ বর্তমান পশ্চিম তুরস্কই প্রথম পশ্চিমা জগতে বেশ সংগঠিত এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে মুদ্রা ব্যবস্থার প্রচলন শুরু করে।
কাগুজে মুদ্রার বা নোটের প্রচলন শুরু হয় চীনে, ট্যাঙের রাজত্বকালে (৬১৮-৯০৭ সাল)। তারও ৬০০ বছর আগে চীনারা মালবেরি গাছের বাকল থেকে কাগজ তৈরি করতে শিখেছিল। প্রথমদিকে সরাসরি গাছের বাকল থেকে কাগজ তৈরি করতো বলে সেই কাগজ ছিল ভারী। পরবর্তীতে গাছের বাকল ব্যবহার না করে কাণ্ডের নরম অংশ কেটে কাগজ তৈরি করতে শিখল তারা। এর ফলে কাগজ আরো হালকা হয়ে গেলো। হালকা হওয়ায় লেখা বোঝা যেত সহজে।
ট্যাঙের রাজত্বকালে বাণিজ্যিক প্রসারের ফলে ধাতব মুদ্রার লেনদেনের পরিমাণ বাড়ছিল। ধাতব মুদ্রা অর্থাৎ সোনার ও রূপার মুদ্রা যথেষ্ট দামি এবং নৌপথে জলদস্যুর আক্রমণের প্রবল সম্ভাবনা থাকায় সেগুলো নিয়ে ভ্রমণ করা ছিল রীতিমতো ঝুঁকির কাজ। তাই ধাতব মুদ্রার বিনিময়ে তারা সমমূল্যের কাগজের অঙ্গীকারনামা গ্রহণ করতে শুরু করল। ব্যাপারটা একটু খোলাসা করেই বলা যাক। ধরুন আপনার কাছে ৫০ আউন্স স্বর্ণ আছে। আপনি ব্যাংকে (রাষ্ট্রীয় কোষাগারে বা তখনকার দিনের রাজদরবারে) সেই ৫০ আউন্স স্বর্ণ জমা রেখে একটি কাগজে লিখিয়ে নিলেন যে, আপনি চাওয়া মাত্র এই কাগজের মাধ্যমে ৫০ আউন্স স্বর্ণ ফেরত পাবেন। অর্থাৎ সেই কাগজের মূল্য ৫০ আউন্স স্বর্ণের সমান। এতে আপনার স্বর্ণমুদ্রাগুলো রাষ্ট্রীয় হেফাজতে রইলো, আর আপনিও রইলেন নিশ্চিন্ত।
এই আইডিয়াটি ছিল তখনকার দিনে বিপ্লবের মতো। ট্যাঙের রাজত্বের শেষের দিকে বণিকরা দলে দলে তাদের সকল স্বর্ণ-রৌপ্য মুদ্রা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা করতে লাগল। তারা যে নোট পেত সেটাকে হেকান (টাকা) বলা হতো। আর এই টাকাকে ফে-থেসিয়ান বলা হতো। বর্তমান ব্যাংকিং ব্যবস্থায় যেটা ফিয়াট মানি। এবারের নিয়ন্ত্রণের পালা। রাজ্যের সকল হিসেব-নিকেশ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার জন্য মিংয়ের রাজত্বকালে সৃষ্টি হলো অর্থ মন্ত্রণালয়। অর্থ মন্ত্রণালয় নিয়ে এলো নতুন নোট ব্যবস্থা। অর্থাৎ আজকের ১, ২, ৫, ১০, ২০, ৫০, ১০০, ৫০০, ১০০০ ইত্যাদি নোটের মতো তখনকার চীনেও চালু হলো ভিন্ন ভিন্ন নোট ব্যবস্থা। তখন নোট ছিল ৬ ধরনের। ১০০, ২০০, ৩০০, ৪০০, ৫০০ ওয়েন এবং ১ কুয়েন সমমূল্যের নোট। ১ কুয়েন ছিল ১০০০ তাম্র মুদ্রার সমান অথবা ১ লিয়াং রূপার সমান। ৪ কুয়েন ১ লিয়াং স্বর্ণের সমান।
তখনও ইউরোপের কাছে কাগজের নোটের কথা অজানা। তারা তখনো এ ব্যবস্থার ধারে কাছে যায়নি। স্বর্ণের মূল্য কিনা কাগজের মূল্যের সমান! পাগল ছাড়া আর কেউ এই কথা বিশ্বাস করবে?
ভ্যানিসের বণিক এবং পর্যটক মার্কো পোলো জাহাজ ভাসিয়ে চীনে এলেন। তখন মোঙ্গল শাসক কুবলাই খানের রাজত্ব চলছে। কাগজের টাকার অদ্ভুত এই রাজ্যে এসে মার্কো পোলো তো যারপরনাই অবাক। তার সেই অনুভূতি তার বর্ণনা থেকেই জানা যাক।
খানবালিকে তখন মোঙ্গল সম্রাট কুবলাই খানের রাজত্ব। (খানবালিক অর্থাৎ আজকের বেইজিং। এখানে মোঙ্গল সাম্রাজ্যের কেন্দ্র ছিল। ঐতিহাসিক স্থান খানবালিক, ইয়ান সাম্রাজ্যের রাজধানীও ছিল।) এখানে কাগজের টাকার মাধ্যমে বিনিময় ব্যবস্থা প্রচলিত। খুব সহজেই প্রস্তুত হয় এই কাগজের টাকা। মালবেরি গাছের নরম এবং আর্দ্র কাঠ হলো কাগজের টাকার মূল কাঁচামাল। গাছের বাকল থেকে মধ্যভাগের মাঝামাঝিতে এই নরম কাঠ পাওয়া যায়। তারপর এই কাঠের সাথে আঠা মিশিয়ে প্রচণ্ড চাপ দেওয়া হয়। ব্যস! তৈরি হয়ে গেলো কাগজ। এই কাগজ দেখতে অনেকটা তুলার কাগজের মতো। কিন্তু কালো রঙের। অত্যন্ত সাবধানতা এবং যত্নের সঙ্গে এই কাগজগুলো প্রস্তুত করা হয়, দেখে মনে হয় যেন কাগজ নয় স্বর্ণ কিংবা রৌপ্য মুদ্রা প্রস্তুত করা হচ্ছে। এরপর নোটের জন্য প্রস্তুত কাগজগুলোকে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার হাতে দেওয়া হয়। নোটে মালিকের নাম এবং নোটের মূল্যমান সহ অন্যান্য লিখিত কাজ শেষ হলে সেটা চলে যায় সম্রাট কুবলাই খানের হাতে। এরপর সম্রাট নিজে হাতে নোটে সিল দেন এবং তার রাজত্বের চিহ্ন বহন করে এমন চিহ্ন নোটের একদম উপরে বসিয়ে দেন। এবার নোটটি সর্বজন গ্রহণযোগ্য হলো। এই নোটের মাধ্যমে সাম্রাজ্যের যেকোনো স্থানে যেকোনো ধরনের লেনদেন করা সম্ভব হতো। এর বাইরে কোনো লেনদেনের কথা কেউ চিন্তাও করতো না।
যেখানে বিজ্ঞানী এবং রসায়নবিদেরা কয়েক শত বছর ধরে সাধারণ ধাতু থেকে স্বর্ণ তৈরির চিন্তায় মশগুল সেখানে এক সম্রাট কিনা সাধারণ কাগজকে টাকায় রূপান্তর করে ফেলেছেন! মার্কো পোলো বাড়ি ফিরলেন। ছড়িয়ে দিলেন তার ভ্রমণ অভিজ্ঞতা। কিন্তু ইতিহাসে বরাবর যা হয়! মার্কো পোলোকে কেউ বিশ্বাস করলো না। বরং তাকে পাগল বলে ঠাওরালো। ফলে পশ্চিম আরো ৬০০ বছর পিছিয়ে গেল। চীনে তখন প্রয়োজনমতো নোট ছাপানো হলেও সেই নোট কখনো ফেরত নেয়া হতো না। ফলে মারাত্মক মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেয় পুরো চীন জুড়ে। ১৩৮০ সালে ১ কুয়েন ১০০০ তাম্র মুদ্রার সমান ছিল। ১৫৩৫ সালে সেটা দাঁড়ায় ০.২৮ তাম্র মুদ্রায়।
১৬৯০ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস বে কলোনিতে সর্বপ্রথম কাগজের নোটের প্রস্তাবনা করা হয়। ১৭৬০ সালে প্রথম ডলার ছাপানো হয় এবং তা সর্বজন কর্তৃক গৃহীত হয়। ইউরোপে কাগুজে নোট প্রচলনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো উত্তর আমেরিকার ঔপনিবেশিক সরকার।
ইউরোপ এবং উত্তর আমেরিকার মাঝে বেশ ভালো বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল। ধরুন, আপনি ইউরোপ থেকে উত্তর আমেরিকা যাচ্ছেন কাঁচামাল কিনতে। কেনাকাটার জন্য একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ মুদ্রাও সাথে নিয়ে যাচ্ছেন। গিয়ে দেখলেন কাঁচামাল কিনতে আরো ১০০ স্বর্ণমুদ্রা বেশি লাগবে। কিন্তু আপনি চাইলে ইউরোপে ফিরে গিয়ে মুদ্রা আনতে পারবেন না আবার এখন কাঁচামাল কম নিয়ে গেলে আবার এসে বাকিটা নিতে গেলে ব্যবসায়িকভাবে ক্ষতির মুখে পড়বেন। এখন উপায়?
উত্তর আমেরিকার ঔপনিবেশিক সরকার তখন আইওইউ (IOU) নামক একটি মুদ্রা ব্যবস্থার প্রচলন করলেন। এর মাধ্যমে অঙ্গীকারনামা দেওয়া হতো। অর্থাৎ আপনি এখন কাঁচামাল নিয়ে দেশে যেতে পারবেন কিন্তু অঙ্গীকারনামায় দেওয়া তারিখের মধ্যে আপনাকে বাকি অর্থ পরিশোধ করতে হবে। ব্যাপারটা অনেকটা ‘আমি তোমার কাছে ঋণী’ এর মতো। ইংরেজিতে ‘I owe you’। আমজনতার ভাষায়, ‘আমি আপনার এই পাওনা দিয়ে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ’। যে কারণে আজও বিশ্বের প্রায় প্রতিটি ব্যাংক নোটে লেখা থাকে- ‘চাহিবামাত্র ইহার বাহককে দিতে বাধ্য থাকিবে’।
ইউরোপের সরকার ব্যবস্থাকেও এই মুদ্রা ব্যবস্থা চালু করতে হলো। এ ধরনের মুদ্রা ব্যবস্থার ফলে সবচেয়ে বেশি লাভবান হয় ১৬৮৫ সালে সংঘটিত হওয়া যুদ্ধের ফরাসি সৈনিকেরা। তারা তাসের কার্ডে সরকার থেকে অঙ্গীকারনামা লিখিয়ে নেয়। ফলে তাদের আর সরাসরি মুদ্রা ব্যবহার করতে হয়নি।
এদিকে ভারতীয় উপমহাদেশে ইংরেজরা সর্বপ্রথম কাগজের নোটের প্রচলন করে। ১৮৬১ সালে সর্বপ্রথম মুদ্রা আইন পাস হলেও ভারতের রিজার্ভ ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৩৫ সালে। ১৯৭২ সালের ১ জানুয়ারি বাংলাদেশে বাংলাদেশি টাকার প্রচলন শুরু হয়। তার আগে ভারতীয় উপমহাদেশ এবং পাকিস্তানের অধীনে থাকাকালীন রুপি ব্যবহার করতো বাংলাদেশিরা। বর্তমানে গাজীপুরে অবস্থিত টাকশালে (দ্য সিকিউরিটি প্রিন্টিং প্রেস) ব্যাংক নোট প্রস্তুত করা হয়। টাকশালে ব্যাংক নোট ছাড়াও রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ দলিল, ব্যাংকের চেক বই, বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদ থেকে শুরু করে আরো গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র অত্যন্ত নিরাপত্তার সাথে ছাপা হয়। যদিও কাঁচামাল বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। ফলে প্রতি নোটে প্রচুর অর্থ খরচ হয়। কীভাবে টাকা প্রস্তুত করা হয় এবং পুরোনো টাকা নষ্ট করা হয় সেটা নিয়ে পরবর্তী কোনো এক লেখায় বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।
এখন চলুন নোট ভেদে তাদের উৎপাদন খরচের পরিমাণ (২০১৮ সালের তথ্য) জেনে নিই-
১ টাকার কয়েন – ৯৫ পয়সা খরচ
২ টাকার কয়েন – ১ টাকা ২০ পয়সা খরচ
৫ টাকার কয়েন – ১ টাকা ৯৫ পয়সা খরচ
২ টাকার নোট – ১ টাকা ৫০ পয়সা খরচ
৫ টাকার নোট – ২ টাকা খরচ
১০ টাকার নোট – ২ টাকা ২০ পয়সা খরচ
২০ টাকার নোট – ২ টাকা ৫০ পয়সা খরচ
৫০ টাকার নোট – ২ টাকা ৫০ পয়সা খরচ
১০০ টাকার নোট – ৪ টাকা ৫০ পয়সা খরচ
৫০০ টাকার নোট – ৬ টাকা ৫০ পয়সা খরচ
১০০০ টাকার নোট – ৭ টাকা খরচ
একটু একটু করে একসময় স্বর্ণ রৌপ্য মুদ্রার সাথে অর্থনীতির দৌড়ে টিকে গেলো কাগজের নোট। অদূর ভবিষ্যতে হয়তো টাকাও বিলীন হয়ে যাবে। আসতে পারে নতুন কোনো মাধ্যম। এরকমই একটি মাধ্যম হলো ক্রিপ্টোকারেন্সি।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।