জেনে নেওয়া যাক কীভাবে সেখানে কৃত্রিম উপগ্রহগুলো নির্দিষ্ট কক্ষপথ বজায় রেখে পরিভ্রমণরত থাকে। বিষয়টি বোঝার জন্য প্রথমে নিউটনের চিন্তার জগৎ থেকে একটু ঘুরে আসা যাক। ধরুন, মাটিতে একটি কামান রাখা আছে। এর থেকে সোজাসুজি সামনের দিকে একটি গোলা ছুড়ে দেওয়া হলো। কিছুক্ষণ পৃথিবীপৃষ্ঠের সমান্তরালে চলার পর সেটি ক্রমেই নিচের দিকে নামতে থাকবে। একসময় মাটিতে পড়ে যাবে।
এমন হওয়ার পেছনে মূল কলকাঠি নাড়ে মহাকর্ষ বল। আমরা যদি অনেক বেশি পরিমাণ বারুদ ব্যবহার করে খুব জোরে গোলাটি ছুড়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করি, তাহলে সেটি মাটিতে পড়ার আগে আরও পথ অতিক্রম করবে। এ সময় সেটির পৃথিবীর সমান্তরালে চলার সময়কাল আগের চেয়ে বেশি হবে। অর্থাৎ আমরা যদি যথেষ্ট বেগে গোলাটি ছুড়ে দিতে পারি, তাহলে সেটির পৃথিবীপৃষ্ঠের সমান্তরালে চলার সময়কাল এত বেশি হবে যে সেটি আর মাটিতে পড়বে না। সেই সময় গোলাটি পৃথিবীর চারদিকে বৃত্তাকার পথে ঘুরতে থাকবে।
এই মানস পরীক্ষা প্রথম মাথায় এসেছিল নিউটনের। এর কয়েক শ বছর পর বিজ্ঞানীরা এই তত্ত্ব কাজে লাগিয়ে কৃত্রিম উপগ্রহ পৃথিবীর চারদিকে ভারসাম্যপূর্ণ কক্ষপথে পরিভ্রমণ করাতে সক্ষম হন। প্রথমে রকেট ব্যবহার করে কৃত্রিম উপগ্রহকে ওপরের দিকে ওঠানো হয়। একটি নির্দিষ্ট উচ্চতায় ওঠানোর পর ধীরে ধীরে এর দিক পরিবর্তন করা হয়। যেন এটি পৃথিবীর সমান্তরালে চলতে পারে।
পৃথিবীর সমান্তরালে চলার সময় কৃত্রিম উপগ্রহটি একটি নির্দিষ্ট বেগে গতিশীল রাখা হয়। এই বেগের কারণে কৃত্রিম উপগ্রহের ওপর পৃথিবীর আকর্ষণ বলের প্রভাব নাকচ হয়ে যায়। ফলে সহজে ভারসাম্য বজায় রেখে পৃথিবীকে পরিভ্রমণ করতে পারে উপগ্রহগুলো। খুব সতর্কতার সঙ্গে হিসাব–নিকাশ করে বিজ্ঞানীরা উপগ্রহের এই বেগের (কক্ষীয় বেগ) মান নির্ধারণ করেন। কারণ, সামান্য কমবেশি হলে সব আয়োজন ভন্ডুল হয়ে যেতে পারে। বেগের মান কম হলে কৃত্রিম উপগ্রহটি পৃথিবীর আকর্ষণ বল পুরোপুরি নাকচ করতে পারবে না।
ফলে ক্রমে এটির কক্ষপথের ব্যাসার্ধ কমে যাবে এবং একসময় পৃথিবীর বুকে আছড়ে পড়বে। আর যদি কক্ষীয় বেগের মান বেশি হয়, তাহলে সেটি পৃথিবীর চারদিকে ঘোরা বাদ দিয়ে সোজা যাত্রা করবে গভীর মহাশূন্যের দিকে। যদি কোনো কৃত্রিম উপগ্রহকে ভূপৃষ্ঠ থেকে ৩০০ কিলোমিটার ওপরে ভারসাম্যপূর্ণ কক্ষপথে গতিশীল রাখতে হয়, তাহলে এর কক্ষীয় বেগের মান হতে হবে প্রতি ঘণ্টায় প্রায় ২৮ হাজার কিলোমিটার। ভূপৃষ্ঠ থেকে কক্ষপথের দূরত্ব যত বেশি হবে, তত কম বেগে গতিশীল রাখতে হবে কৃত্রিম উপগ্রহকে। যেমন এক হাজার কিলোমিটার উচ্চতায় প্রয়োজনীয় কক্ষীয় বেগের মান হবে প্রতি ঘণ্টায় প্রায় ২৫ হাজার কিলোমিটার।
ভারসাম্যপূর্ণ কক্ষপথে পরিভ্রমণরত থাকার পরও বায়ুমণ্ডলের প্রভাবে কৃত্রিম উপগ্রহগুলো কক্ষপথ থেকে সামান্য বিচ্যুত হতে পারে। আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের কথাই ধরুন। এর অবস্থান পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৪০০ কিলোমিটার ওপরে। ভূপৃষ্ঠের মোটামুটি ৬২ কিলোমিটার ওপর থেকে মহাশূন্য শুরু হলেও পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের প্রভাব প্রায় ১০ হাজার কিলোমিটার পর্যন্ত থাকে।
তাই সেখানে অল্প হলেও কিছু পরিমাণ গ্যাসীয় অণু-পরমাণুর অস্তিত্ব সব সময় থাকে। তাদের সঙ্গে সংঘর্ষের ফলে প্রতিদিন আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন ৯০ মিটার পর্যন্ত পৃথিবীর দিকে সরে আসতে পারে। তবে এতে চিন্তার কিছু নেই। বিচ্যুতির পরিমাণ বেশি হলে স্টেশনের সঙ্গে সংযুক্ত রকেট ব্যবহার করে সহজে সঠিক কক্ষপথে ফিরিয়ে নিয়ে আসা হয় তাকে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।