খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (কুয়েট) আজ এক আবেগঘন ও নাটকীয় সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের (ভিসি) পদত্যাগের দাবিতে একদফা আন্দোলনে অনড় অবস্থান নিয়েছে শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের অসন্তোষ এতটাই গভীর যে, বুধবার সন্ধ্যায় তারা কফিন মিছিলের মতো প্রতীকী কর্মসূচি আয়োজন করেছে। এ ঘটনাটি শুধুমাত্র একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ সংকট নয়, বরং এটি তরুণদের ন্যায়বিচার এবং নৈতিক অবস্থানকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা এক শক্তিশালী প্রতিবাদের প্রতিচ্ছবি।
কুয়েট: চলমান আন্দোলনের গভীর প্রেক্ষাপট
কুয়েটের শিক্ষার্থীরা গত কয়েক সপ্তাহ ধরেই উপাচার্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে আসছে। তাদের দাবি—উপাচার্যের পদত্যাগ। এর পেছনে রয়েছে নানা অসন্তোষ, সিদ্ধান্তহীনতা এবং প্রশাসনিক দুর্বলতা। গত কিছুদিনে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের একাধিক সিদ্ধান্তকে কেন্দ্র করে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন শিক্ষার্থীরা। সেই ক্ষোভ থেকেই একপর্যায়ে তারা অনশনের মতো চূড়ান্ত পদক্ষেপে যান। কুয়েট ক্যাম্পাসে চলমান এই আন্দোলন আজ শুধু একটি প্রশাসনিক সংকট নয়, বরং একটি মৌলিক অধিকার আদায়ের সংগ্রামে রূপ নিয়েছে।
Table of Contents
২৩ এপ্রিল সন্ধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টুডেন্ট ওয়েলফেয়ার সেন্টারের সামনে থেকে শিক্ষার্থীরা কফিন মিছিল শুরু করে। প্রতীকী এই মিছিলের মাধ্যমে তারা দেখাতে চেয়েছে যে, প্রশাসনের দৃষ্টিশক্তি যতদিন অন্ধ থাকবে, ততদিন শিক্ষার্থীদের জীবন ও চেতনা অনিশ্চয়তার মধ্যে থাকবে। মিছিলটি দুর্বার বাংলা থেকে শুরু হয়ে প্রশাসনিক ভবনের সামনে এসে শেষ হয়।
কফিন মিছিলে অংশ নেয় দুই শতাধিক শিক্ষার্থী। তাদের কণ্ঠে ছিল একের পর এক প্রতিবাদী স্লোগান—“আমার ভাই মরছে, ভিসি কেন হাসছে?”, “আমার ভাই শয্যায়, ভিসি কেন ক্ষমতায়?” এইসব স্লোগান প্রমাণ করে শিক্ষার্থীরা কেবল প্রতিবাদই নয়, বরং তারা চাইছে একটি মানবিক, ন্যায্য এবং কার্যকর প্রশাসন।
সাম্প্রতিক সিন্ডিকেট সভায় উপাচার্য বিষয়ক যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, সেটি শিক্ষার্থীদের মনে আস্থার সঞ্চার করতে পারেনি। তারা মনে করেন, এসব সিদ্ধান্ত শুধু আন্দোলন ভাঙার অপচেষ্টা। একদিকে বহিষ্কার করে ভয় দেখানো হয়, আরেকদিকে সেই বহিষ্কার প্রত্যাহার করে অনশন ভাঙাতে চেষ্টা করা হয়—এই দ্বৈত নীতিকে শিক্ষার্থীরা দেখছেন প্রহসন হিসেবে।
শিক্ষার্থীদের ভাষ্য মতে, তারা কোনো প্রহসন চায় না। তারা চায় কার্যকর সিদ্ধান্ত, যার মাধ্যমে উপাচার্যের অপসারণ নিশ্চিত হবে। আন্দোলনরত এক শিক্ষার্থী বলেন, “সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্ত আমাদের আন্দোলনের পটভূমিকে পরিবর্তন করতে পারবে না। আমরা এক দফা দাবি নিয়ে অনশন করছি, সেটা পূরণ না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে।”
এই দাবির পেছনে রয়েছে দীর্ঘদিনের ক্ষোভ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রশাসনিক জবাবদিহির অভাব, এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে স্বচ্ছতার অভাব। ছাত্রদের দাবি যেন শুধু কুয়েট নয়, বরং দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য একটি মডেল হয়ে ওঠে—সেটিই তাদের লক্ষ্য।
অনশনরত শিক্ষার্থীদের অনেকেই এখন শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছেন। দীর্ঘ সময় অনশন করার ফলে একাধিক শিক্ষার্থী অসুস্থ হয়ে পড়েছেন এবং তাদেরকে চিকিৎসা সহায়তা দিতে হয়েছে। কিন্তু তারা এখনও নিজেদের দাবিতে অনড়। এমনকি চিকিৎসক ও শিক্ষক সমাজের অনুরোধেও তারা অনশন ভাঙেননি।
পুরো ক্যাম্পাসে এক ধরণের অস্থিরতা বিরাজ করছে। একদিকে শিক্ষকদের মধ্যে রয়েছে প্রশাসনিক চাপে পিষ্ট হবার শঙ্কা, অন্যদিকে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ক্ষোভ আর হতাশা। কিছু শিক্ষক ও অভিভাবক শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করেছেন।
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অবশ্য বলছে, তারা পরিস্থিতি শান্তিপূর্ণভাবে সমাধানের চেষ্টা করছেন। তবে শিক্ষার্থীদের বক্তব্য অনুযায়ী, এসব প্রচেষ্টা খুব বেশি বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করতে পারেনি।
এই আন্দোলনের প্রতিক্রিয়া শুধু কুয়েট ক্যাম্পাসেই সীমাবদ্ধ নয়। এটি জাতীয় পর্যায়েও আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে। বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যম, সংবাদমাধ্যম এবং শিক্ষাবিদরা এ নিয়ে আলোচনা করছেন। কেউ কেউ মনে করেন, এই আন্দোলন দেশের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থার গভীর সংকটকেই সামনে নিয়ে এসেছে।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ফোরামের মতে, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পেছনে যে ক্ষোভ, সেটি দীর্ঘদিনের সমস্যা থেকে জন্ম নেওয়া। তারা বলেছেন, প্রশাসনিক স্বচ্ছতা, ছাত্রবান্ধব পরিবেশ ও জবাবদিহিমূলক ব্যবস্থা ছাড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শান্তি নিশ্চিত করা কঠিন।
কিছু নাগরিক সংগঠন ইতিমধ্যে একাধিকবার উপাচার্যের পদত্যাগের পক্ষে বিবৃতি দিয়েছে। তারা মনে করেন, এটি কেবল একটি প্রশাসনিক সংকট নয় বরং বিশ্ববিদ্যালয়ের নৈতিক অবস্থানের প্রশ্ন।
বর্তমান শিক্ষার্থীদের আন্দোলন একটি নতুন ধরণের ভাষা সৃষ্টি করেছে—যেখানে কফিন মিছিল, অনশন, এবং প্রগতিশীল স্লোগানগুলো শুধু প্রতিবাদ নয়, বরং একটি মানসিক আন্দোলনের রূপ।
এই আন্দোলন ভবিষ্যতের শিক্ষার্থীদের কাছে এক শিক্ষা হয়ে থাকবে—কিভাবে ন্যায়, জবাবদিহি এবং নৈতিক অবস্থানের জন্য নিজের অবস্থান ধরে রাখতে হয়। এটি কেবল উপাচার্য অপসারণের প্রশ্ন নয়, বরং শিক্ষা ব্যবস্থার পূর্ণসংস্কারের দাবিও বয়ে আনছে।
এই আন্দোলন কুয়েট শিক্ষার্থীদের সাহস, প্রতিজ্ঞা ও ন্যায়ের জন্য সংগ্রামের নিদর্শন হয়ে থাকবে। কুয়েট এখন একটি পরিবর্তনের পথে, যার নেতৃত্ব দিচ্ছে তরুণ প্রজন্ম।
FAQs
কেন কুয়েট শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নেমেছে?
কুয়েট শিক্ষার্থীরা উপাচার্যের পদত্যাগের এক দফা দাবিতে আন্দোলনে নেমেছে, কারণ তারা প্রশাসনিক স্বচ্ছতা ও ন্যায়বিচার চান।
কফিন মিছিলের অর্থ কী?
কফিন মিছিল একটি প্রতীকী কর্মসূচি, যার মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেয়েছেন এবং প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানিয়েছেন।
সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্তে শিক্ষার্থীরা কেন সন্তুষ্ট নয়?
কারণ শিক্ষার্থীরা মনে করেন, সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্তগুলো আন্দোলন দমন করার প্রচেষ্টা, যা প্রকৃত সমস্যার সমাধান নয়।
এই আন্দোলনের প্রভাব কী হতে পারে?
এই আন্দোলনের প্রভাবে কুয়েটসহ অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রশাসনিক জবাবদিহি বাড়তে পারে এবং শিক্ষার্থীদের ন্যায্য দাবি সামনে আসতে পারে।
কুয়েট আন্দোলনের ভবিষ্যৎ কী?
আন্দোলন সফল হলে এটি দেশের শিক্ষা প্রশাসনে একটি নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারে, যেখানে শিক্ষার্থীদের কণ্ঠস্বর প্রাধান্য পাবে।
এই আন্দোলন কতদিন চলবে?
যতদিন না উপাচার্যের পদত্যাগ হয়, শিক্ষার্থীরা আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।