মুহাম্মদ শফিকুর রহমান : প্যাঁচা একটা পাখি, দিনের বেলা যার দেখাই মেলে না। সে আবার কী করে কৃষকের বন্ধু হয়! অন্যদিকে সাপ তো খুব ভয়ংকর প্রাণী। কামড়ালে রক্ষা নেই। তার আবার কৃষকের বন্ধু হওয়া!
প্যাঁচা এবং দাঁড়াশ সাপ খুব নিরীহ প্রাণী। শান্ত। প্যাঁচা কাউকে কামড়ে দিয়েছে, প্যাঁচার কামড়ে কারো মৃত্যু হয়েছে—এমন নজির নেই। মানুষ দেখলে প্যাঁচা দৌড়ে পালায়। দাঁড়াশ সাপ হলো নির্বিষ। মানে এই সাপের বিষ নেই। দংশন করলেও কিছু হবে না। ইদুর খেয়ে এরা কৃষকের ফসল রক্ষা করে। এই প্রাণী দুটি সম্পর্কে যে সব কথা প্রচলিত আছে, তার অধিকাংশই ভুল। ভুল জেনে মানুষ এই প্রাণীগুলো মেরে ফেলে। অথচ এরা প্রকৃতি ও পরিবেশের কত বড় উপকার করে, তা অনেকেরই জানা নেই।
প্যাঁচার পছন্দের খাবার ইঁদুর। প্যাঁচার বিরুদ্ধে সবচেয়ে ভুল প্রচারণা—বলা হয় এরা অশুভ পাখি। অত্যন্ত নিরীহ এই পাখিটিকে অশুভ ভাবার কোনো যৌক্তিক কারণ নেই। পৃথিবীজুড়ে ১৭০ প্রজাতির প্যাঁচা দেখা গেলেও বাংলাদেশে রয়েছে ১৬ প্রজাতির প্যাঁচা। এর মধ্যে হুতুম, লক্ষ্মী, নিমখোর, ভুতুম, রূপালি, পিশাচ, যমদূত, গুহা, হিমহিম, বানরমুখো ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় নিম প্যাঁচা। এদের দৈর্ঘ্য ২৪ সেন্টিমিটার এবং ওজন ১৭০ গ্রাম। আবাসস্থল ধ্বংসের কারণে বর্তমানে এরা অনেকটাই বিপন্ন হয়ে পড়েছে। দেখতে আর্কষণীয় হলো লক্ষ্মী প্যাঁচা। এরা মাথা ঘুরিয়ে প্রায় পুরোপুরি পেছনের দিকে তাকাতে পারে।
প্যাঁচার ডাক শুনে অনেকেই একে অশুভ প্রতীক বলে মনে করেন। কোনো কোনো অঞ্চলে প্যাঁচা ডাকলে ঘরে ওঠার সিঁড়িতে জল ঢেলে দেওয়া হয়। তাদের বিশ্বাস, এতে সব ধরনের অকল্যাণ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। আবার কোনো কোনো অঞ্চলে দা, খুন্তি আগুনে গরম করা হয় প্যাঁচার গায়ে ছ্যাকা দেওয়ার জন্য।
প্যাঁচা ছোট ইঁদুর, শুঁয়াপোকা, ছোট পাখি, টিকটিকি, ঢোঁড়া সাপ, ব্যাঙ ইত্যাদি খেয়ে জীবনধারণ করে। প্যাঁচা দিনের আলো সহ্য করতে পারে না। তাই বড় বড় গাছের কোটরে, বন-জঙ্গল, দালানের ফাঁকফোকর কিংবা গাছগাছালির ঘনপাতার আড়ালে লুকিয়ে থাকে। নির্বিচারে বৃক্ষ উজাড়, ফসল আবাদ করতে জমিতে বিভিন্ন রাসায়নিক সার ও কীটনাশক প্রয়োগ, শিকারিদের দৌরাত্ম্য, খাবারের অভাব, ‘অশুভ পাখি’ বলে মেরে ফেলাসহ বিভিন্ন কারণে প্রকৃতি থেকে প্যাঁচার সংখ্যা কমে যাচ্ছে।
রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতায় শুভ ও সুন্দরের প্রতীকরূপে বারবার এসেছে বাংলার প্যাঁচা। প্যাঁচা কৃষকের অনেক উপকার করে। প্যাঁচার প্রধান খাবার ইঁদুর। ইঁদুর রাতে বের হয়, প্যাঁচাও রাতে বের হয়। যেখানে ইঁদুরের আনাগোনা সেখানে প্যাঁচার আনাগোনা। খেতের ভেতর প্যাঁচা বসার উপযোগী ডাল, বাঁশ ইত্যাদি পুঁঁতে রাখলে এক রাতেই ১২-১৩টি ইঁদুর সাবাড় করতে পারে। একটি প্যাঁচা প্রতিরাতে কমপক্ষে একটি ইঁদুর খায়। একটি ইঁদুর কমপক্ষে ১০ হাজার টাকার শস্য ধ্বংস করে। তাহলে একটি প্যাঁচা প্রতিবছর ১০ হাজার – ৩৬৫= ৩৬ লাখ ৫০ হাজার টাকা রক্ষা করে থাকে। আর প্যাঁচাটি যদি কমপক্ষে ১০ বছর বাঁচে তাহলে কত টাকা রক্ষা করে, ভাবা যায়?
দাঁড়াশ এমনই এক সাপ, হাত দিয়ে ধরলেও এরা বেশি নড়াচড়া করে না। রেগে উঠে ছোবল মারার অভ্যাস এদের নেই। এদের গায়ের রং হালকা বাদামি, হলুদ বাদামি কিংবা জলপাই বাদামিও হয়ে থাকে। কৃষকের যম ইঁদুর। আর দাঁড়াশ সাপের প্রধান খাবারই হলো ইঁদুর। এরা ফসলের খেতে থাকতে পছন্দ করে। এই সাপ যে জমিতে থাকে তার আশেপাশে প্রায় ৩ একর এলাকাজুড়ে তার বিচরণ থাকে। এরা খুঁজে খুঁজে ইঁদুর শিকার করে। নীরবে ইঁদুর খেয়ে ফসল তো রক্ষা করেই, উপরন্তু পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় তার অবদান বলার মতো। দাঁড়াশ সাপের লেজে কাটা আছে, বিষ থাকার মতো প্রচলিত এই কথাও ঠিক নয়।
কৃষকের গাভীর দুধ খায় দাঁড়াস সাপ। এমনটা অনেকেই মনে করেন। বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞ ড. মনিরুল এইচ খান বলেন, দাঁড়াশ কেন পৃথিবীর কোনো সাপই দুধ চুষে খেতে পারে না। গরুর ওলানে এক ধরনের পোকার কামড়ে দাগ হয়। সাপের পরিপাকতন্ত্র দুধ হজম করতে পারে না। প্রাণী বিশেষজ্ঞরা দাঁড়াশ সাপের প্রজনন বৃদ্ধির ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, প্রতি বছর ইঁদুর যে পরিমাণ খাদ্যশস্য নষ্ট করে তার আনুমানিক বাজারমূল্য ১১ হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি। দাঁড়াশ সাপ রক্ষা করতে পারলে বছরে ১১ হাজার কোটি টাকার ফসলের পাশাপাশি কৃষি বিভাগ যে টাকা ইঁদুর দূর করতে খরচ করে তাও রক্ষা করা সম্ভব।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।