কৃষ্ণগহ্বরে ঝাঁপ দেওয়ার পরিণত: মৃত্যু বা মহাজাগতিক ভ্রমণ

কৃষ্ণগহ্বরে

কৃষ্ণগহ্বরে ঝাঁপ দিলে মানুষ মারা যাবে কি না, তা নিয়ে দুশ্চিন্তা আছে অনেকের। আসলে উঁচু কোনো জায়গা থেকে (যেমন কোনো বিল্ডিং বা কোনো প্লেন থেকে) পড়ে গেলেই মৃত্যুর ভাবনা আসা স্বাভাবিক। এসব ক্ষেত্রে শুধু মহাকর্ষকে দোষ দেওয়া ঠিক হবে না। আসলে শুধু ওপর থেকে পতনের কারণে নয়, পতনের পরের আঘাতের কারণে মৃত্যু হয়। তবে কৃষ্ণগহ্বরের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা আলাদা। সেখানে পতনই আপনার মৃত্যুর কারণ হতে পারে। বিষয়টা একটু খুলে বলা যাক।

কৃষ্ণগহ্বর

কৃষ্ণগহ্বরের ভেতর মহাকর্ষ শুধু আপনাকে টানেই না, দেহটাও ছিঁড়ে টুকরা টুকরা করে ফেলতে পারে। মনে রাখতে হবে, ভরযুক্ত বস্তুর দূরত্বের ওপর মহাকর্ষ নির্ভরশীল। আপনি যখন পৃথিবীতে দাঁড়িয়ে থাকেন, তখন আপনার পায়ের ওপর মাথার চেয়ে বেশি মহাকর্ষ টান থাকে। পার্থক্যটা খুব সামান্য বলে তা বোঝা যায় না। কিন্তু কৃষ্ণগহ্বরের ভেতর ব্যাপারটা বোঝা যায় জোরালোভাবে। সেটা বিপদও ডেকে আনতে পারে।

অতি ভারী কোনো কৃষ্ণগহ্বরে পড়ে গেলে পা ও মাথায় মহাকর্ষের পার্থক্য বেশ স্পষ্টভাবে বোঝা যায়। একসময় তফাতটা এতই বেশি হবে যে সেটা আপনাকে টেনে স্প্যাগেটি বা সেমাইয়ের মতো লম্বা বানিয়ে ফেলতে পারে। একে বলা হয় স্প্যাগেটিফিকেশন বা সেমাইকরণ। এ প্রক্রিয়ার শেষে আপনাকে ছিঁড়ে ছিন্নবিছিন্ন করে ফেলতে পারে। এই বিন্দুকে ধরা যাক, স্প্যাগেটিফিকেশন পয়েন্ট বা সেমাইকরণ বিন্দু। এখান থেকে আলোও চলে যায় না ফেরার দেশে। তাই সেখান থেকে আপনার পক্ষেও আর ফিরে আসা কোনোভাবেই সম্ভব নয়।

কৃষ্ণগহ্বরে পতনের কোন পর্যায়ে বা কোন বিন্দুতে আপনি স্প্যাগেটিফায়েড হবেন, তা নির্ভর করে কৃষ্ণগহ্বরের ভরের ওপর। সূত্রমতে, কৃষ্ণগহ্বরের ভরের ঘনমূলের সমানুপাতে স্প্যাগেটিফিকেশন পয়েন্ট পরিবর্তিত হয়। আর কৃষ্ণগহ্বরের ভরের সঙ্গে সীমানার সম্পর্ক রৈখিক। অর্থাৎ কৃষ্ণগহ্বরটা কম ভরের হলে তার ঘটনা দিগন্তের চেয়ে স্প্যাগেটিফিকেশন পয়েন্ট বড় হবে। তখন ওই কৃষ্ণগহ্বরের ওই বিন্দু হবে ঘটনা দিগন্ত বা সীমানার বাইরে। কিন্তু দানবীয় কৃষ্ণগহ্বরের এই বিন্দু বেশ ছোট এবং তা সীমানার ভেতরেই থাকে। যেমন সূর্যের চেয়ে ১০ লাখ গুণ বেশি ভরের কোনো কৃষ্ণগহ্বরের ব্যাসার্ধ হবে ৩০ লাখ কিলোমিটার। কিন্তু কৃষ্ণগহ্বরটার কেন্দ্র থেকে ২৪ হাজার কিলোমিটার দূরত্বে না আসা পর্যন্ত সেটা কাউকে সেমাই বানাতে পারবে না। কিন্তু ছোট কৃষ্ণগহ্বরের ব্যাসার্ধ যদি ৩০ কিলোমিটার হয়, তাহলে সেটা কেন্দ্র থেকে মাত্র ৪৪০ কিলোমিটার দূরত্বেই সেমাইকরণের প্রক্রিয়া সেরে ফেলতে পারবে। তাই বড় বা দানবীয় কৃষ্ণগহ্বরের ক্ষেত্রে কিছুটা সুবিধা পাওয়া যায়। তাই ঝাঁপ দিতে চাইলে বড় কৃষ্ণগহ্বর বেছে নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন পদার্থবিদ স্টিফেন হকিং।

এবার দেখা যাক, কৃষ্ণগহ্বরটার দিকে আরও এগিয়ে গেলে কী কী ঘটতে পারে। এ ক্ষেত্রে দুটি মজার ঘটনা ঘটবে। প্রথমত, ঘটনা দিগন্তের ব্যাসার্ধের প্রায় তিন গুণ এলাকায় অ্যাক্রেশন ডিস্ক শেষ হয়ে যেতে দেখা যাবে। তারপর কৃষ্ণগহ্বরের চারদিকের এলাকা প্রায় ফাঁকা। কারণ, কোনো কিছু এই বিন্দু ছাড়িয়ে গেলে সেটা দ্রুত ভেতরে ঢুকে যায়। এই বিন্দু থেকেই বেশির ভাগ বস্তু আর বেরিয়ে আসতে পারে না। কৃষ্ণগহ্বরের দিকে এগিয়ে যেতে থাকলে আরেকটা চমকপ্রদ ব্যাপার চোখে পড়বে। দেখা যাবে, চারপাশের স্থান বিপুলভাবে বেঁকে গেছে। আপনি তখন এমন এক বিন্দুতে থাকবেন, যেখানে মহাকর্ষ খুবই শক্তিশালী। তাই আলোর চলার পথও ব্যাপকভাবে বিকৃত হয়ে যাবে, যা লক্ষ করার মতো। সেই অনুভূতি হবে লেন্সের ভেতর সাঁতার কাটার মতো। কৃষ্ণগহ্বরের চারদিকের স্থান ব্যাপকভাবে বেঁকে যায়, তাই আলোর চলার পথও সেখানে সোজা মনে হবে না।

এরপর আরেকটু এগিয়ে গেলে ঘটতে থাকবে আরও উদ্ভট সব ঘটনা। কৃষ্ণগহ্বরের ব্যাসার্ধের প্রায় আড়াই গুণ দূরে পৌঁছালে কালো একটা বৃত্ত দেখতে পাবেন। একে বলা হয় কৃষ্ণগহ্বরের ছায়া। কৃষ্ণগহ্বর আসলে তার নিজের আকারের চেয়ে বড় ছায়া ফেলে। কারণ, ঘটনা দিগন্তের ভেতর ঢুকে পড়া ফোটনগুলো আটকে ফেলার পাশাপাশি চারপাশ দিয়ে ছুটে চলা ফোটনগুলোর গতিপথেও বাঁকিয়ে ফেলতে পারে কৃষ্ণগহ্বর। এসব ফোটন একসময় মহাকর্ষীয় এই কূপের ভেতরে ঢুকে যেতে থাকে। তাই এসব আলোও আমরা দেখতে পাই না।

কৃষ্ণগহ্বরের যত ভেতরে যেতে থাকবেন, এই ছায়াকে তত বড় মনে হতে থাকবে। আরও কাছে এগিয়ে গেলে দেখা যাবে কৃষ্ণগহ্বর আরও আলো আটকে ফেলছে। সেটি না হলে এই আলোই হয়তো আপনার চোখে এসে আঘাত করত। আপনার দৃষ্টিসীমার প্রায় পুরোটাই দখল করে নিতে শুরু করবে এটি। এই জায়গায় এসে আপনার একটি সেলফি নেওয়ার শখ জাগতে পারে। কারণ, আপনার চারপাশে ঘোর কৃষ্ণবর্ণ দেখা যাবে। মনে হবে, আপনি কৃষ্ণগহ্বরের ভেতরে সেলফি তুলেছেন। কিন্তু আপনার আসলে আরও অনেক দূর যাওয়া বাকি।