২২ বছর বয়সে তিনি আবিষ্কার করেছেন একটি উপপারমাণবিক কণা বা সাবঅ্যাটমিক পার্টিকেল (প্রচলিত ‘ভুল’ বাংলায় যাকে বলে ‘অতিপারমাণবিক’ কণা)। তারপর পরিবারের জন্য ছেড়ে গেছেন গবেষণার জগৎ। তিনি ব্রিটিশ পদার্থবিদ রোজমেরি ফাউলার। প্রায় ৭৫ বছর পর সম্মানসূচক পিএইচডি ডিগ্রি পেয়েছেন এই বিজ্ঞানী।
কণাপদার্থবিজ্ঞানের আজব চিড়িয়াখানাটির নাম স্ট্যান্ডার্ড মডেল। এই মডেলে মৌলিক কণাগুলোকে সহজেই খুঁজে পাবেন আপনি। এতে আছে ছয় ধরনের কোয়ার্ক—আপ, ডাউন, টপ, বটম, চার্ম ও স্ট্রেঞ্জ; এবং ছয় ধরনের লেপটন—ইলেকট্রন, মিউওন, টাউ, ইলেকট্রন নিউট্রিনো, মিউওন নিউট্রিনো ও টাউ নিউট্রিনো। এসবই বস্তুকণা। পাশাপাশি বলের কণা হিসেবে পাবেন গ্লুয়ন, ফোটন, জেড বোসন, ডব্লিউ বোসন এবং সব কণার ভরের জন্য দায়ী হিগস বোসন।
১৯৪৮ সালের কথা। রোজমেরি ফাউলার ততদিনে যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব ব্রিস্টল থেকে মাস্টার্স শেষ করে ব্রিটিশ পদার্থবিদ সিসিল পাওয়েলের অধীনে গবেষণারত পিএইচডি শিক্ষার্থীদের দলে যোগ দিয়েছেন। সিসিল পাওয়েল নিউক্লিয়ার ইমালশন কোটেড প্লেট ব্যবহারের অগ্রপথিকদের একজন।
নিউক্লিয়ার ইমালনশন প্লেট একধরনের পার্টিকেল ডিটেক্টর বা কণা শনাক্তকারী যন্ত্র। মহাকাশ থেকে ছুটে আসা মহাজাগতিক রশ্মি বা কসমিক রের কণাগুলো শনাক্তের জন্য এ ডিটেক্টর ব্যবহৃত হয়। পাওয়েল ও তাঁর দল ততদিনে বড় সাফল্য পেয়ে গেছেন এ পদ্ধতিতে। তাত্ত্বিকভাবে অনুমিত পাই মেসন বা পায়ন কণা শনাক্ত করেছেন তাঁরা। এ সময়, যেমনটা বললাম, মঞ্চে আগমন রোজমেরির।
তাঁর ভবিষ্যৎ স্বামী, তৎকালীন পিএইচডি সহপাঠী পিটার ফাউলারের সঙ্গে কাজ শুরু করেন তিনি পাওয়েলের দলে। সুইজারল্যান্ডের স্ফিংস মানমন্দিরে ফটোগ্রাফিক প্লেটে কণাদের গতিপথের যে ছাপ রয়ে যেত, সেগুলো নিয়ে গবেষণা করতেন তিনি। একদিন দলের আরেক সদস্য মিনি ভ্যান ডার মারউই তাঁকে এরকম একটি প্লেট দেন, যাতে কণার অদ্ভুত গতিপথের ছাপ পড়েছে।
রোজমেরি এই প্লেট দেখেই বোঝেন, নতুন একধরনের মেসন কণার ভাঙনের ফলে পাওয়া গেছে ছবিটি। তিনি এর নাম দেন টাউ মেসন (মৌলিক কণা টাউ নয়)। ১৯৪৯ সালে বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞান জার্নাল নেচার-এ প্রকাশিত এক গবেষণাপত্রে জানা যায় তাঁদের এ নতুন আবিষ্কারের কথা।
এটা কী কণা হতে পারে, তা বড় এক সমস্যা হয়ে দেখা দেয় তখনকার বিজ্ঞানীদের জন্য। দেখা গেল, যুক্তরাষ্ট্রের ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল বিজ্ঞানী একইরকম একটি ছবির প্লেট পেয়েছেন, যাতে একটি কণা ভেঙে দুটি পায়ন তৈরি হচ্ছে। আর রোজমেরির পাওয়া সেই প্লেটে একটি কণা ভেঙে তৈরি হচ্ছিল ৩টি পায়ন কণা।
সমস্যাটি মূলত ছিল প্যারিটি বা সমতুল্যতাবিষয়ক। স্থানে রোটেশন বা ঘূর্ণনের ফলে স্থানিক দিকগত যে পরিবর্তন দেখা যায়—এতে দৈর্ঘ্য, প্রস্থ বা উচ্চতা বরাবর কোনো একটি স্থানাঙ্কের চিহ্ন বদলে যায়—তাকে বলা হয় প্যারিটি ট্রান্সফরমেশন বা সমতুল্যতার পরিবর্তন। এককালে বিজ্ঞানীরা মনে করতেন, কণাদের স্থানে রোটেশন বা ঘূর্ণন কোনো পার্থক্য তৈরি করে না। এর নাম ছিল কনজার্ভেশন অব প্যারিটি বা সমতুল্যতার সংরক্ষণশীলতা। এ সমস্যা সমাধানে কণাপদার্থবিজ্ঞানে আবিষ্কৃত হয় নতুন একধরনের স্ট্রেঞ্জনেস—কণাদের বিশেষ এক বৈশিষ্ট্য।
এর ধারাবাহিকতায় ১৯৫৭ সালে করা এক পরীক্ষায় দেখা যায়, দুর্বল মিথস্ক্রিয়ায় কণাদের সমতুল্যতা সংরক্ষিত থাকে না। তবে অন্য সব ধরনের মিথস্ক্রিয়ায় মৌলিক কণাদের সমতুল্যতা বা প্যারিটি সংরক্ষিত থাকে। অতি, অতি সরল করে বলা যায়—সমতুল্যতা বা প্যারিটি সংরক্ষিত থাকার মানে, এসব কণার কোনো মিথস্ক্রিয়ায় ডান-বাঁয়ের পার্থক্য করা যায় না।
যেহেতু দুর্বল মিথস্ক্রিয়া বা উইক ইন্টার্যাকশনে এটি সংরক্ষিত নয়, তাই এ মিথস্ক্রিয়ায় কণাদের ডান-বাঁয়ের পার্থক্য করা যায়। এটি অনেক বড় আবিষ্কার ছিল বিজ্ঞানীদের জন্য। এভাবে ধীরে ধীরে উদ্ভূত সমস্যার সমাধান মেলে। ফাউলারের আবিষ্কৃত এ কণার নাম দেওয়া হয় কেওন বা কে-মেসন কণা। আর বিজ্ঞানীরা বহুদূর এগিয়ে যান উপপারমাণবিক কণাদের আচরণ বোঝার কাজে।
প্রকৃতিতে মোট চার ধরনের কেওন কণা পাওয়া গেছে। কে মাইনাস (K–), কে প্লাস (K+), কে-নট ও এর প্রতিকণা। একটি স্ট্রেঞ্জ কোয়ার্ক বা অ্যান্টিকোয়ার্ক এবং একটি আপ বা ডাউন কোয়ার্কের সমন্বয়ে গঠিত হয় এই যৌগ কণাগুলো।
কেওন কণা আবিষ্কারের কৃতিত্ব বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেওয়া হয় পিটার ফাউলার ও সিসিল পাওয়েলকে। কেওন বা কে-মেসন এবং এর আগে পায়ন বা পাই-মেসন কণার আবিষ্কার কত বড় ব্যাপার, তা বোঝা যায় এই তথ্য থেকে: ১৯৫০ সালে সিসিল পাওয়েলকে নিউক্লিয়ার প্রক্রিয়া গবেষণার জন্য ফটোগ্রাফিক বা ছবিনির্ভর পদ্ধতিতে অবদান রাখা এবং এ পদ্ধতিতে মেসন কণা আবিষ্কারের জন্য নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়।
১৯২৬ সালে ইংল্যান্ডের সাফোকে জন্ম, বেড়ে ওঠা মাল্টা, পোর্টসমাউথ ও বাথ শহরে। বাবা রয়েল নেভির প্রকৌশলী, সে জন্যই ওরকম নানা শহরে বেড়ে ওঠা। তারপর অনার্স, মাস্টার্স শেষে যোগ দেওয়া সিসিল পাওয়েলের দলে। এরপর তো ২২ বছর বয়সে সেই কেওন কণা শনাক্ত করা।
২০০৪ সালে রয়েল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটিকে সহায়তা করেছেন স্বামী ও শ্বশুরের স্মৃতিতে একটি পদক প্রণয়নের জন্য—ফাউলার অ্যাওয়ার্ড। জ্যোতির্বিজ্ঞানে প্রাথমিক অবদানের জন্য দেওয়া হয় এ পদক।
এত বছর পর, ৯৮ বছর বয়সে ইউনিভার্সিটি অব ব্রিস্টল থেকে সম্মানসূচক পিএইচডি স্বীকৃতি পেয়েছেন তিনি। এ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টি বলেছে, ‘রোজমেরির আবিষ্কার কণাপদার্থবিজ্ঞান ও মৌলিক মিথস্ক্রিয়াগুলোকে বুঝতে সাহায্য করেছে আমাদের। এর কৃতিত্ব প্রায়ই শুধু তাঁর স্বামী পিটার ফাউলার ও সিসিল পাওয়েলকে দেওয়া হয়। এ স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে তাঁর অবদানের গুরুত্ব স্বীকার স্বরূপ।’
অনেক নারীই যে পরিবারের কথা ভেবে নিজের কাজ ছেড়ে যান, তাঁদের ভূমিকা হয়তো ভুলেই যাই আমরা। পরিবার নাকি গবেষণা—কোনটি বেশি গুরুত্বপূর্ণ, এ প্রশ্ন অনেকেরই। রোজমেরি আমাদের মনে করিয়ে দেন সেই কথাটিই—কোনোটিরই গুরুত্ব কম নয়।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।