বিজ্ঞানের ইতিহাসে ১৯৫৯ সালের ৪ অক্টোবর তারিখটা লেখা থাকবে লাল হরফে। এ দিন প্রথম স্পুটনিক উৎক্ষেপের দ্বিতীয় বার্ষিকীতে তৃতীয় সোভিয়েত (বর্তমান রাশিয়া) রকেট করে চাঁদের চারপাশে ঘুরে আবার পৃথিবীতে ফিরে আসে। কক্ষপথে রকেট পৌঁছনোর পর ২৭৮.৫ কেজি ওজনের একটি স্বয়ংক্রিয় আন্তঃগ্রহ স্টেশন তা থেকে বিচ্যুত হল। এ শতাব্দীর প্রথম দিকে এ ধরনের স্টেশনের ডিজাইন করেছিলেন যিনি, সেই তসিওলকভস্কির স্বপ্ন এত দিনে সত্য হলো।
স্টেশনে ছিল অত্যন্ত জটিল ও নিখুঁত যন্ত্রপাতি, তাদের এবং রেডিও ট্রান্সমিটারগুলোকে প্রবাহ সরবরাহের ব্যাটারি। রাসায়নিক ব্যাটারি ছাড়া ছিল সৌর ব্যাটারি, সূর্যের তেজকে সরাসরি বিদ্যুতে পরিণত করে বহুক্ষণ চালু থাকে এগুলো—বিদ্যুৎ সরবরাহের গুরুত্বপূর্ণ উৎস এরা। একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আন্তঃগ্রহ স্টেশনটি স্পুটনিকগুলো থেকে আলাদা। স্পুটনিকের রেডিও ট্রান্সমিটার ক্রমান্বয়ে অবিরাম সঙ্কেত পাঠাত পৃথিবীতে। স্বয়ংক্রিয় আন্তঃগ্রহ স্টেশনটি কিন্তু এ ব্যাপারে আলাদা। ডিজাইন এমন যে পৃথিবী থেকে নির্দেশ এলে তবে চলত এর সরঞ্জাম।
নির্দেশ পেলে সরঞ্জাম চালু হতো, শুরু হতো ‘রেডিও অনুষ্ঠান’, যন্ত্রপাতিতে পাওয়া মাপ ও অন্যান্য খবর রেডিওযোগে যেত পৃথিবীতে। প্রত্যেকটি অনুষ্ঠান চলত দুই-এক ঘণ্টা বা যতক্ষণ পৃথিবী থেকে নির্দেশ না আসে ততক্ষণ। তারপর নতুন নির্দেশের জন্য অপেক্ষা করা কয়েক দিনের জন্য। চাঁদে প্রথম রকেট পাঠানোর জন্য কত নির্ভুলতার দরকার পড়ে তা আগেই তোমাদের বলেছি। আন্তঃগ্রহ রকেটটিকে পাঠাতে আরও নির্ভুল হওয়ার প্রয়োজন হয়, বিদেশের কয়েকটি খবরের কাগজ তো বলে ‘আজব নির্ভুলতা’।
আগেকার রকেটগুলোর চেয়ে আরও অনেক সুদূরপ্রসারী উদ্দেশ্য ছিল আন্তঃগ্রহ স্টেশনটির। শুধু চাঁদে পৌঁছিয়ে নামা নয়—চাঁদকে ঘুরপাক দিয়ে পৃথিবীমণ্ডলে ফিরে আসা। কাজটা অত্যন্ত কঠিন হলেও সম্পূর্ণ হয়। ১৯৫৯ সালের ১৮ অক্টোবর ঠিক পূর্ব-পরিকল্পিতভাবে এটি কক্ষপথে প্রবেশ করে এবং সন্ধ্যা সাতটা বেজে পঞ্চাশ মিনিটে (মস্কোর সময়) পৃথিবী ও চাঁদকে প্রদক্ষিণের প্রথম পালা শেষ করে। প্রায় একপক্ষ লাগে এ যাত্রায়।
স্টেশনটির জন্য আরও একটি অভূতপূর্ব বৈজ্ঞানিক সাফল্য অর্জিত হয়েছে। চাঁদকে ঘোরার সময়ে এটি আমাদের উপগ্রহের মানুষের চোখে কখনো না দেখা দিকটির ছবি তুলে রেডিওতে পাঠায় পৃথিবীতে। অনেক সমস্যার সমাধান করতে হয় তার আগে। চাঁদের অগোচর দিকটিকে অতিক্রম করার মূহূর্তে ভিডিও ক্যামেরাগুলোকে চালু করতে হলো। ‘মুক্ত পতন’ অর্থাৎ ভারহীন অবস্থায় রাখতে হলো সব সরঞ্জামকে, ক্ষতিকর মহাজাগতিক বিকিরণ থেকে আগলানো হয়। তারপর ফিল্ম ডেভেলপ করা, বসানো, শুকোনো, অন্য রোলারে ঘোরানো। এ অবস্থায় দিনকয়েক রেখে তারপর রেডিওযোগে পৃথিবীতে পাঠানো।
একেবারে নিখুঁতভাবে চলে সমগ্র প্রক্রিয়াটি। রকেটটির মেরুদণ্ড যখন সূর্য থেকে চাঁদে টানা একটি লাইন বরাবর, তখন পৃথিবী থেকে রেডিও-সঙ্কেতের নির্দেশে বিশেষ সরঞ্জাম তার আবর্তন বন্ধ করে দেয়, আর চল্লিশ মিনিট ধরে চাঁদের যে দিকটা আমাদের অগোচর তার ছবি তোলে ক্যামেরাগুলো। দুটি স্কেলে ছবি তোলা হয়, সব চাকতিটিকে দেখানোর জন্য ছোট স্কেলে আর ওপরিভাগের খুঁটিনাটি ধরার জন্য বড় স্কেলে।
আন্তঃগ্রহ স্টেশনে স্থাপিত রেডিও টিভি ট্রান্সমিটারগুলো যে ছবি পাঠায় সেগুলো এলো পৃথিবীর স্টেশনে। প্রসঙ্গত, এ সব ট্রান্সমিটার যে শক্তি ব্যবহার করে তা পৃথিবীতে সাধারণত ব্যবহৃত শক্তির দশ কোটি গুণ কম। বিজ্ঞানীদের সামনে অনাবৃত হলো চাঁদের অপর দিকের একটি মানচিত্র, কখনো না দেখা দিকটার রহস্য ধরা পড়ল সোভিয়েত ইঞ্জিনিয়রদের প্রতিভাগুণে।
ফোটো নেওয়া বস্তুগুলোর কয়েকটির নাম দিলেন বিজ্ঞান একাডেমির একটি কমিশন। এখন চাঁদের মানচিত্রে আছে স্বপ্ন সাগর (মানুষ-সৃষ্ট প্রথম গ্রহ, সোভিয়েত সৌর গ্রহের উৎক্ষেপের দিনে যে স্বপ্ন সত্য হয় তার স্মরণার্থে), আছে মস্কো সাগর, যে শহর শান্তির জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করে তার সম্মানে। সোভিয়েত পাহাড়গুলো বহিশূন্যের প্রথম বিজেতাদের কথা চিরকাল মনে করিয়ে দেবে। আগ্নেয় গিরিবিবরগুলোর নামকরণ করা হয়েছে তসিওলকভস্কি, লমোনোসভ, জুলিও-কুরি এবং অন্যান্য বিদেশী বিজ্ঞানীদের নামে; জ্ঞানের উচ্চ শিখায় মানবজাতিকে যে মহাপুরুষেরা নিয়ে গেছেন তাঁদের স্মৃতি জাগাবে এরা চিরকাল।
১৯৫৯ সালের অক্টোবরের সেই অবিস্মরণীয় দিনগুলোতে চন্দ্র-ভূগোলের বিকাশ খরগতিতে এগিয়ে গেল। কয়েক বছরের মধ্যে চাঁদের অপর দিকে স্বয়ং মানুষ পৌঁছবে। তাঁদের সঙ্গে থাকবে একটি নিখুঁত মানচিত্র, যে মানচিত্র প্রস্তুত করে প্রথম আন্তঃগ্রহ স্টেশন, যার সংশোধন করে অন্যান্য স্টেশন—পরে যে এমন স্টেশন উড্ডীয়মান হবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।