সামান্য জোয়ার বলের কারণে চাঁদ প্রতিবছর পৃথিবী থেকে প্রায় ৪ সেন্টিমিটার হারে দূরে সরে যাচ্ছে। প্রায় ২ বিলিয়ন বছরে এটি এতই দূরে চলে যাবে যে তা আর পৃথিবীর ঘূর্ণনকে স্থিতিশীল রাখতে পারবে না। এ ঘটনা পৃথিবীর প্রাণের অস্তিত্বের জন্য মারাত্মক হয়ে উঠতে পারে। এখন থেকে কয়েক বিলিয়ন বছর পর রাতের আকাশ শুধু চাঁদহীনই হবে না, সেই সঙ্গে আমরা হয়তো পুরোপুরি ভিন্ন ধরনের নক্ষত্রমণ্ডল দেখব।
কারণ, পৃথিবীর কক্ষপথ গোলমেলে হয়ে যাবে। পৃথিবীর আবহাওয়াও হয়ে যাবে অচেনা, যা জীবনধারণের জন্য অসম্ভব হয়ে উঠবে। যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতাত্ত্বিক পিটার ওয়ার্ড এবং জ্যোতির্বিদ ডোনাল্ড ব্রাউনলি লিখেছেন, চাঁদ ছাড়া জ্যোৎস্না থাকবে না, কোনো চান্দ্রমাস, চাঁদ নিয়ে কবিত্ব, কোনো অ্যাপোলো অভিযান থাকবে না, কবিতাও কম লেখা হবে। কারণ, তখন পৃথিবীর প্রতিটি রাতই হবে ঘনঘোর অন্ধকারে ভরা।
পৃথিবীর গোল্ডিলকস জোনে অবস্থানের আরেকটি কারণ গ্রহরাজ বৃহস্পতি। নানা কারণে গ্রহটির প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। এক কম্পিউটার মডেলে দেখা গেছে, সৌরজগতে বৃহস্পতি গ্রহের উপস্থিতি পৃথিবীতে জীবনের টিকে থাকার জন্য একটি আশীর্বাদ। কারণ, এ গ্রহের শক্তিশালী মহাকর্ষ গ্রহাণুগুলোকে বাইরের মহাকাশে ছুড়ে মারতে সহায়তা করে। আমাদের সৌরজগতের গঠনের পর গ্রহাণু ও ধূমকেতুর ধ্বংসাবশেষগুলো সাফ করতে বৃহস্পতির প্রায় ১ বিলিয়ন বছর লেগেছিল। এটি ঘটেছিল ৩.৫ থেকে ৪.৫ বিলিয়ন বছর আগে।
বৃহস্পতি গ্রহ যদি অনেক ছোট হতো আর তার মহাকর্ষ যদি বেশ দুর্বল হতো, তাহলে আমাদের সৌরজগৎ এখনো গ্রহাণুতে ভরে থাকত। স্বাভাবিকভাবেই তাতে পৃথিবীতে প্রাণের উদ্ভব অসম্ভব হয়ে উঠত। কারণ, গ্রহাণুর প্রাণ ধ্বংস করে দিত। ডাইনোসরদের বিলুপ্তির পেছনে এমনই এক গ্রহাণুকে দায়ী করেন বিজ্ঞানীরা। কাজেই সৌরজগতে পৃথিবীর একজন বড় ভাই হিসেবে বৃহস্পতি গ্রহের আকারও যথার্থ।
আবার গ্রহের ভর বা আকৃতির দিক দিয়েও আরেকটা গোল্ডিলকস জোনে বাস করি আমরা। বেশি নয়, কমও নয়, একদম যেটুকু হওয়ার দরকার, সেটুকুই আছে। পৃথিবী যদি আরেকটু ছোট হতো, তাহলে এর মহাকর্ষ বেশ দুর্বল হতো। অনেকে হয়তো ভাববেন, তখন একলাফে এখনকার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি ওপরে উঠতে পারতাম। সে কথা সত্যি। কিন্তু মাটিতে লাফালাফি বা দাপাদাপি করার জন্য কেবল আমরাই এখানে থাকতাম না।
কারণ, দুর্বল মহাকর্ষের জন্য পৃথিবী অক্সিজেন আটকে রাখতে পারত না। আবার পৃথিবী আরেকটু বড় হলেও ঝামেলার অন্ত ছিল না। তখন হয়তো জমি দখলবাজদের জন্য বেশ সুবিধা হতো। কিন্তু এর চেয়ে বেশি বড় পৃথিবীতে অনেক আদিম, বিষাক্ত গ্যাস আটকে থাকত। তাতেও জীবনের উদ্ভব হতো অসম্ভব। তাই জমি দখল করার জন্য কেউ টিকে থাকত না। আমাদের চলাফেরাতেও সমস্যার সৃষ্টি করতে পারত এই অতিরিক্ত মহাকর্ষ। কাজেই প্রাণধারণের উপযোগী বায়ুমণ্ডল গড়ে তুলতে পৃথিবীর ওজন একেবারে যথার্থ।
আবার আমরা সহনীয় বা গ্রহণযোগ্য গ্রহের কক্ষপথের এক গোল্ডিলকস জোনেও বাস করি। লক্ষণীয় ব্যাপার হলো, প্লুটো বাদে অন্যান্য গ্রহের কক্ষপথ প্রায় বৃত্তাকার। এর মানে হলো সৌরজগতে গ্রহসংক্রান্ত প্রভাব খুবই বিরল ঘটনা। অর্থাৎ পৃথিবী এমন কোনো গ্যাসীয় দানব গ্রহের কাছে যায় না, যার মহাকর্ষ খুব সহজে পৃথিবীর কক্ষপথে বিঘ্ন ঘটাতে পারে। বলা বাহুল্য, এটা প্রাণের টিকে থাকার জন্য বেশ ভালো। এর জন্য আসলে কয়েক শ মিলিয়ন বছরের স্থিতিশীলতার প্রয়োজন।
একইভাবে মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি বা আকাশগঙ্গা ছায়াপথের একেবারে গোল্ডিলকস জোনের মধ্যে অবস্থান পৃথিবীর। এ ছায়াপথের কেন্দ্র থেকে প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ দূরে রয়েছে পৃথিবী। আমাদের গ্যালাকটিক কেন্দ্রে একটি কৃষ্ণগহ্বর ওত পেতে রয়েছে। তার বিকিরণক্ষেত্র খুবই তীব্র। তাই আমাদের সৌরজগৎ যদি গ্যালাকটিক কেন্দ্রের খুব কাছে হতো, তাহলে ওই তীব্র বিকিরণক্ষেত্রের প্রভাবে পৃথিবী হয়ে উঠত প্রাণধারণের পক্ষে অসম্ভব একটি গ্রহ। আবার সৌরজগৎ যদি ছায়াপথের কেন্দ্র থেকে অনেক দূরে থাকত, তাহলেও ঝামেলা ছিল। তখন সেখানে উচ্চ শ্রেণির মৌল পর্যাপ্ত পাওয়া যেত না। অথচ এগুলো প্রাণ সৃষ্টির জন্য বেশ দরকারি মৌল।
বিজ্ঞানীদের ঝুলিতে এ রকম অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে। তাতে দেখা যায়, পৃথিবী এ রকম অগণিত গোল্ডিলকস জোনের ভেতরে রয়েছে। জ্যোতির্বিদ ওয়ার্ড ও ব্রাউনলি যুক্তি দিয়েছেন, আমরা এত বেশি গোল্ডিলকস জোনের ভেতর বাস করি যে এই ছায়াপথের জন্য, এমনকি হয়তো গোটা মহাবিশ্বের জন্যও বুদ্ধিমান জীব অনন্য কোনো ঘটনা। ওপরের তালিকার বাইরে তারা আরও কিছু গোল্ডিলকস জোনের তালিকা দিয়েছেন।
এগুলোর মধ্যে রয়েছে: পৃথিবীর মহাসাগরের পরিমাণ একেবারে যথার্থ, প্লেট টেকটোনিকস, অক্সিজেনের পরিমাণ, অক্ষরেখার কোণসহ অনেক কিছু। তাঁদের যুক্তিতে এ রকম আরও অনেক কিছুই আমাদের মতো বুদ্ধিমান জীব সৃষ্টির জন্য যথার্থ ও দরকারি। পৃথিবী যদি এসব ছোট্ট গোল্ডিলকস পরিসরের কোনোটির বাইরে থাকত, তাহলে এখানে বুদ্ধিমান প্রাণীর অস্তিত্ব স্রেফ রূপকথা হয়ে যেত। কিংবা তখন এগুলো নিয়ে চিন্তাভাবনা বা আলোচনার জন্যও কেউ থাকত না। বিজ্ঞানচিন্তা নামে কোনো ম্যাগাজিনও থাকত না। কখনো লেখা হতো না এই লেখা। আর এ লেখার পাঠক তো আরও অনেক দূরের ব্যাপার।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।