ইউক্লিডের প্রতিভার কাছে আমরা ঋণী, কারণ তিনি ২ হাজার ৩০০ বছর আগে এই স্বীকার্যের অপরিহার্যতা টের পেয়েছিলেন। একে বুঝতে হলে ইউক্লিডীয় দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করা ছাড়া কোনো গত্যন্তর নেই।
কিন্তু এসব কাজ করতে গিয়ে জ্যামিতিবিদেরা প্রথম বুঝতে পারলেন, পঞ্চম স্বীকার্য বাদ দিয়ে জ্যামিতি গড়ে তোলা যায়, যাকে পরম জ্যামিতি বলে। তবে সেখানে ত্রিভুজ–সংক্রান্ত কোণের ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব নয়—ত্রিভুজের তিন কোণের সমষ্টি দুই সমকোণের বড় হতে পারে, ছোট বা সমানও হতে পারে। সমান হওয়ার জন্য অবশ্যম্ভাবীভাবে প্রয়োজন হয়ে পড়ে পঞ্চম স্বীকার্যের।
পঞ্চম স্বীকার্য বাদ দিয়ে অইউক্লিডীয় জ্যামিতি গড়ে তোলা যৌক্তিকভাবে সম্ভব, এই সিদ্ধান্তে প্রথম এসেছিলেন সুইস পাদ্রি জিরোলামো সাখেরি। সেটা অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথম দিকে। কিন্তু তিনি নিজের কাজকে নিজে বিশ্বাস করতে অস্বীকার করেছিলেন। এরপর ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে জ্যামিতিশাস্ত্রের প্রকৃত ব্যাপারটা বুঝতে পারেন কার্ল ফ্রেডারিক গাউস (১৮২০), রাশিয়ার নিকোলাই লোভেচেভস্কি (১৮২৬) ও হাঙ্গেরির জেনাস বোলাই (১৮৩২)।
তাঁরা এটা নিয়ে গবেষণাপত্রও প্রকাশ করেন। তাঁরা ইউক্লিডের শুধু পঞ্চম স্বীকার্যের বদলে অন্যান্য স্বীকার্য নিয়ে ঋণাত্মক বক্রতাবিশিষ্ট জ্যামিতি গড়ে তোলেন। আর বার্নার্ড রিম্যান দেখান এ রকম প্রয়োজনীয় সংখ্যক স্বীকার্য নিয়ে অসংখ্য জ্যামিতিক কাঠামো গড়ে তোলা সম্ভব।
যেখানে ত্রিভুজের তিন কোণের সমষ্টি দুই সমকোণের সমান, ছোট অথবা বড় হতে পারে। এগুলো বাস্তবিক সত্য হবে কি না বিবেচ্য বিষয় নয়, বিষয়টা হলো যৌক্তিক কোনো অসংগতি থাকতে পারবে না। আর আলবার্ট আইনস্টাইন ও আলেক্সান্দার ফ্রিডম্যান এই রিম্যানীয় জ্যামিতি ব্যবহার করে আধুনিক মহাবিশ্ব–তত্ত্বকে দাঁড় করান এবং সেটাই আধুনিক জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানের ভিত্তি।
এই রহস্য উন্মোচনের জন্য লোভেচেভস্কিকে মানুষের সামনে পাগল হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন সমসাময়িক খ্যাতিমানেরা। তাঁরা পত্রিকায় অমার্জিত ভাষায় তাঁকে বিদ্রূপ ও উপহাস করেছিলেন। বোলাইয়ের নাম চিরকালের জন্য মুছে ফেলার অভিপ্রায়ে গণকবরে সমাধিস্থ করা হয়েছিল, মাত্র তিনজন লোক উপস্থিত ছিল মৃতদেহের সত্কার করার জন্য এবং চার্চ রেজিস্টারে লেখা হয়েছিল তাঁর জীবন অতিবাহিত হয়েছিল অর্থহীন কাজের মধ্য দিয়ে। আর গাউস এর ভয়াবহতা আঁচ করতে পেরে তাঁর গবেষণাপত্রটি প্রকাশ করেননি।
এ ধরনের ঘটনাবলির মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছিল সমান্তরাল সরলরেখার ব্যর্থতা ও বেদনাদায়ক উপাখ্যানের কাহিনি। এসব কর্মকাণ্ড থেকে বোঝা গেল, জ্যামিতির (অইউক্লিডীয় জ্যামিতির) ফলাফলগুলো বাস্তবিকই সত্য হবে কি না বিবেচ্য বিষয় নয়, বিষয়টা হলো জ্যামিতিক ব্যবস্থাটির মধ্যে যৌক্তিক কোনো অসংগতি থাকতে পারবে না। গণিতের কাজ হলো ‘যদি ও তবে’র মাধ্যমে একটি যৌক্তিক শৃঙ্খলা গড়ে তোলা।
এর মধ্যে যে স্বীকার্য ও সংজ্ঞা ব্যবহার করা হয়, সেগুলো অথবা এর ফলাফলগুলো সত্য বা মিথ্যা কি না, তা দাবি করা বিবেচ্য বিষয় নয়, এটা ছেড়ে দেওয়া হয় বিজ্ঞানীদের (বিশেষ করে পদার্থবিজ্ঞানী) হাতে। এভাবে গণিতের প্রকৃত ভূমিকা স্পষ্ট হয়ে যায় এবং গণিতের ‘বিশুদ্ধ চিন্তা’ জগৎ সম্পর্কে সব ধারণা দিতে পারে বা রহস্যবাদী উপায়ে জ্ঞানলাভ সম্ভব–সংক্রান্ত ধারণার অবসান ঘটে। মানবজাতি একক সত্যের ধারণা থেকে সরে আসে। নমনীয় ও বৈচিত্র্যময় দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে মহাবিশ্বের দিকে তাকাতে সামর্থ্য হয়।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।