বিনোদন ডেস্ক: লতা মঙ্গেশকরের চিরপ্রস্থানের মধ্য দিয়ে সংগীত জগতের এক ইতিহাসের উজ্বল অধ্যায়ের সমাপ্তি হলো। দীর্ঘ সঙ্গীত জীবনে হাজারো গানের কোকিলকণ্ঠী এ শিল্পী বহু বছর কোটি কোটি শ্রোতা-ভক্তদের মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছেন তার কণ্ঠের মহিমায়। হয়তো এভাবেই আরও বহুকাল তার গান রয়ে যাবে মানুষের হৃদয়ে। নিজের ভেতরে নিজেকে লুকিয়ে রাখার অভ্যস্থতা নিয়েই জীবন কাটিয়েছেন সঙ্গীতের এ সাক্ষাৎ সারস্বত। কিন্তু নিজের জীবনকে কারও সঙ্গে ভাগাভাগি করেননি।
ভারতের কিংবদন্তি সংগীতশিল্পী লতা মঙ্গেশকর ৯২ বছর বয়সে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। জীবনের ৭০ বছর তিনি সংগীতেই কাটিয়ে দিয়েছেন।
উপহার দিয়েছেন নানা ভাষায় অসংখ্য গান।
তবে এই দীর্ঘ জীবন একাই কাটিয়ে দিয়েছেন লতা। বিয়ে করেননি। সাফল্যের শিখরে পৌঁছেও কেনো তিনি চিরকুমারী রয়ে গেলেন? এমন প্রশ্ন সবসময় তার ভক্তদের মুখে মুখে ঘোরে!
বিয়ে না করা প্রসঙ্গে একবার খালিদ মহম্মদকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে লতা মঙ্গেশকর খোলাখুলি কথা বলেছিলেন।
সেসময় সুর-সম্রাজ্ঞী বলেন, ‘মা আমার বিয়ে নিয়ে জোরাজুরি করতেন, একসময় তিনি হাল ছেড়ে দেন। আমার কাছে আমার পরিবার বিয়ের চেয়ে বেশি জরুরি ছিল। ’
তিনি অবশ্য অস্বীকার করেননি যে কোনোদিন তাকে একাকীত্ব ঘিরে ধরেনি। কিন্তু ভালোবাসার মানুষরা পাশে ছিলেন বলে একাকীত্ব তার কাছে ক্ষতিকারক হয়নি। সেজন্য নিজেকে খুব সৌভাগ্যবানও মনে করতেন লতা মঙ্গেশকর।
কোনোদিন প্রেমে পড়েছিলেন? এমন প্রশ্নে লতা তখন মুচকি হেসে বলেছিলেন, ‘হ্যাঁ, পড়েছি তো, তবে শুধু নিজের কাজের সঙ্গে। আর আমি ভালোবেসেছি আমার আপনজনদের, আমার পরিবারকে, আর কাউকে নয়’।
১৯২৯ সালে মধ্যপ্রদেশের এক মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম নেন এই ‘ভারতরত্ন’।
মূলত পরিবারের জন্যই চিরকুমারী ছিলেন লতা মঙ্গেশকর। বিয়ে করেননি কখনো। তবে সংসার না থাকলেও কোটি মানুষের ভালোবাসা পেয়েছেন এই কিংবদন্তি।
১৯২৯ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর সংস্কৃতিপ্রেমী মধ্যবিত্ত মারাঠি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন লতা। পণ্ডিত দিনানাথ মঙ্গেশকরের বড় মেয়ে লতার জন্ম মধ্য প্রদেশের ইন্দোরে। প্রথমে লতার নাম রাখা হয় ‘হেমা’। জন্মের পাঁচ বছর পর তার নাম বদলে রাখা হয় লতা। ভাইবোনদের মধ্যে লতা সবার বড়। পিতা পণ্ডিত দিনানাথ ছিলেন থিয়েটার অভিনেতা এবং গায়ক। তার বেড়ে ওঠাটা মহারাষ্ট্রেই। সাত বছর বয়সে এই শহরে পৌঁছান ভারতের এই সুর সাম্রাজ্ঞী। পাঁচ বছর বয়সে বাবার সঙ্গে মঞ্চে অভিনেতা হিসেবে কাজ শুরু করেন।
তিনি শৈশব থেকেই গায়িকা হতে চেয়েছিলেন। পিতা ছিলেন শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের অনুরাগী। এজন্য সম্ভবত, তিনি লতার চলচ্চিত্রে গান করার বিরুদ্ধে ছিলেন। ১৯৪২ সালে তার পিতা মারা যান এবং পরিবারের আর্থিক অবস্থার অবনতি ঘটে। এরপর লতা মারাঠি ও হিন্দি চলচ্চিত্রে ছোট ভূমিকায় কাজ শুরু করেন।
প্রথমবার মঞ্চে গান গেয়ে লতা ২৫ টাকা পারিশ্রমিক পান। এটাই তার জীবনের প্রথম উপার্জন। ১৯৪২ সালে প্রথমবার মারাঠা চলচ্চিত্র ‘কিতী হাসাল’-এর জন্য গান গেয়েছিলেন সঙ্গীতের এই চিরকুমারী। শৈশবকালে কুন্দনলাল সেহগলের চলচ্চিত্র ‘চণ্ডীদাস’ দেখে তিনি বলেছিলেন, বড় হয়ে সেহগলকেই বিয়ে করবেন তিনি।
কিন্তু তা আর হয়ে ওঠেনি। সংসারী না হওয়ার বিষয়ে পরে তিনি জানিয়েছেন- ‘পরিবারের সকল সদস্যের দায়িত্ব ছিল তার ওপর। এমন পরিস্থিতিতে বিয়ের চিন্তা মাথায় এলেও সেটাকে গুরুত্ব দেয়ার কথা ভাবতেই পারেননি তিনি। সঙ্গীতকেই জীবনের একমাত্র অবলম্বন বেছে নেন লতা মুঙ্গেশকর। এভাবেই সবার কথা ভাবতে ভাবতে নিজের প্রতি অবহেলায় জীবনের ৯১টি বসন্ত কাটিয়েছেন একাকিত্বে।
কয়েক বছর আগে এক সাক্ষাৎকারে বিয়ে প্রসঙ্গে লতা বলেছিলেন- ‘সব কিছুই স্রষ্টার ইচ্ছাতে হয়। যা হয় তা ভালোর জন্যেই হয় আর যা হয়না তা আরো বেশি ভালোর জন্যই। বিয়ে করার সুযোগ আমি কখনও পাইনি আর এ ব্যাপারে কখনও চিন্তাও করিনি। আমি এখন যেমন আছি তাতেই অনেক সুখী। জাগতিক বিষয়গুলো এখন আর আমাকে স্পর্শ করে না।’
তবে ভারতীয় গণমাধ্যমে প্রকাশ পায়, লতা মঙ্গেশকর একজনকে ভালোবেসে ছিলেন। প্রেমে সফল হননি বলেই তিনি আজীবন একা রয়ে গেলেন। রাজস্থানের দুঙ্গরপুরের রাজ সিং-এর প্রেমে পড়েছিলেন লতা। যিনি সম্পর্কে লতার বড়ভাইয়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। তবে শেষ পর্যন্ত তা পরিণতি পায়নি। কারণ রাজ সিং ছিলেন রাজবংশের ছেলে। কোনো সাধারণ ঘরের মেয়েকে রাজবংশের বউ করেবেন না তিনি। তাই এই সম্পর্ক পরিণতি পায়নি। রাজ সিং আদর করে লতাকে মিট্টু বলে ডাকতেন। পকেটে সবসময় লাতার একটি রেকর্ডার নিয়ে ঘুরতেন। ২০০৯ সালে প্রয়াত হন রাজ সিং।
তিনি ভারতের প্রধান সুরকারদের প্রায় সবার সঙ্গেই কাজ করেছেন। তিনি প্রায় সব ধরণের গানই করেছেন। শাস্ত্রীয় সঙ্গীত থেকে শুরু করে রোমান্টিক গান, এমনকি ভজনও গেয়েছেন তিনি। লতা মুঙ্গেশকর প্রায় ৩৬টি ভাষায় গান করেছেন। এর মধ্যে আছে বাংলাও। ‘প্রেম একবার এসেছিল নীরবে’, ‘আষাঢ় শ্রাবণ মানে না তো মন’, ‘ও মোর ময়না গো’, ‘ও পলাশ ও শিমুল’, ‘আকাশ প্রদীপ জ্বেলে’সহ আরো অনেক কালজয়ী বাংলা গানের কণ্ঠ দিয়েছেন তিনি।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।