বনমোরগ দেখতে খুবই সুন্দর। মাথার চমৎকার ফুলটা, গলার নিচের থলথলে চামড়াটা, চোখের চারপাশটা, বুজানো অবস্থায় ডানা যেখানে লেজের গোড়ায় শেষ হয়েছে সেখানটাসহ পিঠের কিছু অংশের রং লাল। কান সাদাটে। ঠোঁট থেকে চোখের নিচ দিয়ে চওড়া কালচে-কমলা টান কানের গোড়ায় এসে মিশেছে। মাথার পেছন দিকের চমৎকার পেলব পালকগুলোর রং আলতা-লাল। ঘাড়-গলার বাহারি পালকের রং হলুদ। পিঠ-বুক কালো।
ঋতুভেদে এই রং লালচে-হলদেটে হয়। পালকের শেষ প্রান্ত কালচে। বুজানো পাখায় পালকের বিন্যাসগুলো ভালোভাবে বোঝা যায়। গায়ের রং ঘন-বাদামি। নখের রংও তাই। তরবারি নখটা (প্রতিপক্ষের সঙ্গে লড়াইয়ের সময় দুই পায়ের পেছন দিকের যে দুটি নখ ওরা ব্যবহার করে) ছুরির মতো খুবই ধারালো এদের। বনমোরগের ঘাড়-গলায় ঝুলে থাকা বাহারি পালকগুলো যতটা সুন্দর, তার চেয়েও বেশি সুন্দর বোধহয় এদের লেজের গড়ন-ধরন, লেজ ও লেজের চকচকে কালো পালকগুলো। লেজের মূল পালক দুটি উল্টো তরবারির মতো দেখায়, লেজের অন্য পালকগুলোর চেয়ে এই দুটি বড়।
শ্রীমঙ্গল থেকে সংগ্রহ করা লেজের দুটি মূল পালক আমার সংগ্রহে আছে। সাঁওতালরা তীর-ধনুক দিয়ে ওটিকে শিকার করেছিল। শিকার করার পর মুহূর্তেই পালক দুটি আমি টেনে তুলেছিলাম। পালক দুটির মাপ ২৯ সেন্টিমিটার। সুন্দরবন থেকে সবশেষ ১৯৯১ সালে যে দুটি মূল পালক আমি মৌয়ালদের কাছ থেকে সংগ্রহ করেছিলাম, সে দুটির মাপ ছিল ৩৪ সেন্টিমিটার।
বনমুরগি দেখতেও কম সুন্দর নয়। পোষা মুরগির চেয়ে একটু লম্বাটে গড়নের হয় ওরা। ওরা এক নজরে বাদামি-লাল ও ছিট-ছোপযুক্ত পাখি। টান ও ছিট-ছোপ থাকে পোড়া ইটের রঙের মতো পালকের ওপর। এদের লেজ লম্বাটে ধরনের। মূল পালক নেই।
এই মোরগ-মুরগিদের নাম বনমোরগ বা লাল বনমোরগ। ইংরেজি নাম Red Jungle Fowl. বৈজ্ঞানিক নাম Gallus gallus। সুন্দবনের বনমোরগের (মুরগিও) মাপজোক যেমন নিয়েছি বারকয়েক, শ্রীমঙ্গলেও তা করেছি। আমি নিজে সুন্দরবনে মোরগ-মুরগি শিকার করেছি, শিকার করতেও দেখেছি। হাতে নিয়ে ওদেরকে নেড়েচেড়ে দেখার সুযোগ আমার হয়েছে। ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে এক শিকারি গুলি করেছিল একটি বনমুরগিকে। ওর সঙ্গে ছিল ৪টি ছানা।
মুরগিটি আহত হয়েও উড়ে একটি বড় খাল পাড়ি দিয়েছিল। ছানাগুলো তাড়িয়ে ধরতে গিয়ে হিমশিম খেয়ে গিয়েছিলাম আমরা। বারবার লুকাচ্ছিল ওরা। আত্মগোপনের অসম্ভব সুন্দর কৌশল ওরা জানে। একজনের পায়ের তলায় পড়ে ১টি ছানা মারা গিয়েছিল। ২টিকে ধরা গিয়েছিল। বাকিটি হারিয়ে গিয়েছিল গোলবনে।
এই লাল বনমোরগ আর বনমুরগিই হচ্ছে পৃথিবীর সব ধরনের পোষা মোরগ-মুরগির আদি পিতা-মাতা। সেই আদি পিতা-মাতা বাংলাদেশের সুন্দরবন, সিলেট-চট্টগ্রামের টিলা-পাহাড়িবনসহ নেত্রকোনা জেলার গারোপাহাড় এলাকা ও জামালপুর জেলার গারোপাহাড় এলাকায় আছে। আছে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডু ইকোপার্কে। টাঙ্গাইলের মধুপুর বনেও থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। এজন্য আমরা গর্ব অনুভব করতে পারি।
এলাকাভেদে খাদ্যতালিকা একটু ভিন্ন। গারোপাহাড় এলাকায় ওদেরকে আমি ধানক্ষেতে নেমে ধান খেতে দেখেছি। বৃহত্তর সিলেটের বনমোরগরাও ধান খাবার সুযোগ পায়। সুন্দরবনে আবার ধান নেই। বৃহত্তর চট্টগ্রামের পাহাড়ি বনেও ধান খাওয়ার সুযোগ খুবই সীমিত। তবে ওদের কমন খাদ্য তালিকায় আছে কচি ঘাস-পাতার ডগা, যেকোনো ধরনের শস্যদানা, ছোট ছোট মাছ ও ব্যাঙ, নির্বিষ ও বিষধর ছোট সাপ।
কেঁচো, ছোট কাঁকড়া, আঞ্জন, টিকটিকি ও বিভিন্ন ধরনের পোকা মাকড়সহ কাঁচা মরিচ, কচি বেগুন। সুন্দরবনের বাওয়ালি-মৌয়ালদের কাছে শুনেছি ধান-চাল ছিটিয়ে মোরগ-মুরগি পাকড়াও করার চেষ্টা ওরা করে সুন্দরবনে। ভাতও ছিটায়। মৌয়ালরাই সুন্দরবনে মুরগির ডিম-বাসা বেশি পায়। সুন্দরবনের বাসার উপকরণে ঘাস, শুকনো কেয়াপাতা-গোলপাতার আধিক্য থাকে।
আমি যে ৩ বার সুন্দবনে ওদের ডিম-বাসা দেখেছি, সেই ৩ বারই ছিল মাঘ মাস। লালচে-বাদামির আভাসহ ডিমের রং সাদা। বনমোরগের শরীরের মাপ ৬০-৭০ সেন্টিমিটার। মুরগির মাপ ৪০-৪৫ সেন্টিমিটার। যদিও মোরগে মোরগে তুমুল লড়াই লাগে, তবুও একদলে ৭/৮টি মুরগি ও ৩/৪টি মোরগ দেখা যায়। ধান কেটে নেওয়ার পর খুব ভোরে ও সন্ধ্যার আগে দলবেঁধে ওরা ধানক্ষেতে নামে। এই দুই সময়েই বন্দুকশিকারিরা ওদের শিকার করার মোক্ষম সুযোগ পায়। এমনিতে কী শ্রীমঙ্গল, কী সুন্দরবন; ওদেরকে শিকার করা খুবই দুরূহ কাজ।
অত্যন্ত চালাক আর বুদ্ধিমান ওরা। মাটিতে বুক-পেট ঠেকিয়ে ঝোপঝাড়ের তলায় বা গাছের আড়ালে আত্মগোপন করতে ওস্তাদ। ভালো দৌড়াতে যেমন পারে তেমনি পারে দ্রুত উড়তে। তবুও সুন্দরবনে ওরা গুইসাপ, মেছোসাপ ও সাগর-ঈগলের কবলে পড়ে যায় মাঝে-মধ্যে। জেলে-বাওয়ালিদের কাছে শুনেছি, কুমিরও নাকি ধরে ওদের জলপান করার সময়।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।