ড. এ কে এম এম হুমায়ুন কবির: ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়—বিভিন্ন অস্থিতিশীল, প্রতিকূল ও অনিশ্চিত পরিস্থিতির মধ্যেও বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের নিজস্ব কার্যক্রম চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার রেকর্ড রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়সমূহকে রাজনৈতিক প্রতিকূলতা, আর্থিক অসংগতির মতো সমস্যা ছাড়াও ডিজিটালাইজেশন বা ডিজিটাল ব্যবস্থায় রূপান্তর এবং বিশ্বায়নের মতো চ্যালেঞ্জ ও মোকাবিলা করতে হয়েছে। বিভিন্ন সময় শিক্ষার্থী, সমাজ, দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে কিংবা প্রয়োজন অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ তাদের কাঠামোতে নানাবিধ পরিবর্তন এনেছে; কিন্তু করোনা মহামারি এক নজিরবিহীন ও ভয়াবহ সমস্যার সৃষ্টি করেছে। করোনা মহামারিতে বিশ্বব্যাপী ৩০০ মিলিয়নের বেশি শিক্ষার্থীর শিক্ষা ব্যাহত হচ্ছে।
এ সমস্যার মাত্রা এবং প্রভাবও বেশ ব্যাপক। বাংলাদেশ ও অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, এই সমস্যা মানুষের বর্তমানের আর্থসামাজিক অবস্থার সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত। এই মহামারি আমাদের নতুন করে ভাবার সুযোগ করে দিয়েছে। প্রথমে, করোনা-পরবর্তী জীবনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার জন্য আমাদের উদ্যোগী হতে হবে এবং সে অনুযায়ী কর্মপন্থা গ্রহণ করতে হবে। ভবিষ্যতের বৈশ্বিক পরিস্থিতি কেমন হতে পারে তার সঙ্গে সংগতি রেখে উচ্চশিক্ষা কার্যক্রম ঠিক করতে হবে। যদিও কাজটি সহজ নয়, কারণ করোনা-পরবর্তী সময়ে বিশ্বের অবস্থা ঠিক কেমন হতে পারে তা এখনো আমাদের অজানা। তবে একটা জিনিস পরিষ্কার যে, করোনার প্রভাবে সামনের দিনগুলোতে পূর্ববর্তী অনেক বিষয়ে পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে। এই মহামারির কারণে পরিপূর্ণ ডিজিটালাইজেশনের অভাব এবং দারিদ্র্যতা বৃদ্ধির মতো সমস্যাসমূহ তীব্র আকার ধারণ করেছে। ভবিষ্যতে আসার সম্ভাবনা ছিল—এমন কিছু প্রযুক্তি বা অভ্যাস এই মহামারির কারণে আমাদের কাছে তুলনামূলক আগেই ধরা দিয়েছে। তারমধ্যে অনলাইনে পাঠদান (জুম, টেনসেন্ট, গুগল ক্লাসরুম, গুগল মিট, ওয়েবএক্স অ্যাপস ব্যবহার করে সরাসরি ক্লাস পরিচালনা), কর্মস্থলে না থেকে কাজ করা, ত্রিমাত্রিক ছবির ব্যবহার, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং রোবটিকস বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই মহামারি, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রচলিত সিস্টেমের কার্যকারিতা ও স্থায়িত্বকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে। যদি বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ মহামারি-পরবর্তী সময়ে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে চায় বা সময়ের সঙ্গে নিজেদের সমৃদ্ধ করতে চায়, তাহলে তাদের প্রচলিত শিক্ষাপদ্ধতিকে অবশ্যই বদলাতে হবে। এক্ষেত্রে আমার মনে হয়, শিক্ষকদের অনলাইন পাঠ কার্যক্রমে কিছু বিকল্প উপাদান নিয়ে ভাবা উচিত। যার মধ্যে রয়েছে শিক্ষা উপকরণকে পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশন, অডিও/ভিডিও রেকর্ডিং, লেকচার শিট, প্রবন্ধ/বইয়ের অধ্যায় হিসেবে ইমেইল বা ফেসবুক গ্রুপে বা ইউটিউব চ্যানেলে দেওয়া ও নির্দিষ্ট রুটিন মানা, মেসেঞ্জার রুম-সুবিধা নিয়ে শিক্ষকের সঙ্গে প্রশ্নোত্তর পর্ব, ক্লাসে গ্রুপ করে দিয়ে নিজেদের মধ্যে পড়াশোনা নিয়ে আলোচনা করা, নির্দিষ্ট টপিক ধরে ধরে কিছুদিন পরপর গ্রুপ প্রতিবেদন বা বাড়ির কাজ দেওয়া, জুমমাধ্যমে টেস্ট নেওয়া ইত্যাদি (লার্ন-ফ্রম-হোম মডেল)।
উচ্চশিক্ষা কার্যক্রমে করোনার নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে। উচ্চশিক্ষা ও সামাজিক ব্যবস্থার সঙ্গে যে বর্তমানের আর্থসামাজিক অবস্থার একটি অসামঞ্জস্যতা রয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে দূরশিক্ষণ পদ্ধতি গ্রহণ করার পর সেটা আরো বেশি স্পষ্ট হয়েছে। মূলত, প্রাতিষ্ঠানিক সুযোগ-সুবিধা ও শিক্ষার্থীদের আর্থসামাজিক অবস্থার ভিন্নতার কারণে এই সমস্যা দেখা দিয়েছে। ফলে অনলাইন শিক্ষাকার্যক্রম সম্বন্ধে শিক্ষার্থীদের ভিন্ন ভিন্ন ধারণা জন্মাচ্ছে। কিছুসংখ্যক বিশ্ববিদ্যালয় এই পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারছে না। অপ্রতুল তথ্যপ্রযুক্তিসেবা (অস্থিতিশীল উচ্চ গতিসম্পন্ন ইন্টারনেট ও বিদ্যুত্), অনলাইনে পাঠদানে অভিজ্ঞ শিক্ষকের অভাব, প্রতিষ্ঠান কর্তৃক তাদের শিক্ষার্থীদের পর্যাপ্তসংখ্যক কম্পিউটার ও ইন্টারনেট-সেবা নিশ্চিত করতে না পারার কারণে এই সমস্যার উদ্ভব হয়েছে। শুধু এই সমস্যাগুলোই নয়, এই মহামারি দেশের পরিস্থিতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে একটা মিশ্রিত শিক্ষাব্যবস্থা প্রচলনের গুরুত্ব আমাদের সামনে তুলে ধরেছে। এই ব্যবস্থাতে, সরাসরি প্রতিষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে শিক্ষাগ্রহণের বদলে অনলাইন শিক্ষাকে প্রচলন করতে বলা হচ্ছে না, আবার সীমিত সুযোগ-সুবিধা নিয়ে অনলাইন-নির্ভর শিক্ষাব্যবস্থা চালু করাও এর লক্ষ্য নয়। বরঞ্চ, আমাদের সৃজনশীলতা ও বুদ্ধিমত্তাকে কাজে লাগিয়ে পাঠদান ও শিক্ষাগ্রহণের বিভিন্ন পদ্ধতিকে একীভূত করে একটি সুন্দর পাঠদানের ও শিক্ষালাভের পদ্ধতি গড়ে তোলাই এই ব্যবস্থার মূল লক্ষ্য। পাঠদানের বিভিন্ন মাধ্যম ক্রমাগত পরিবর্ধন ও পরিমার্জনের মাধ্যমে এই ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। এই ব্যবস্থা একজন উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তিকে অনিশ্চিত অথচ প্রতিযোগিতামূলক কর্মসংস্থানের বাজারে নিজেকে প্রস্তুত করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।
করোনা পরিস্থিতি, উচ্চশিক্ষা কার্যক্রমে অনলাইন শিক্ষাকে দীর্ঘস্থায়ী করার সুযোগ সৃষ্টি করেছে। এর পাশাপাশি, পাঠদানের মাধ্যম হিসেবে অনলাইনকে বেছে নিয়ে, অনলাইন শিক্ষার নানা সুবিধাদি ব্যবহার করে পাঠদান এবং শিক্ষাগ্রহণকে আরো বেশি উপভোগ্য ও কার্যকরী করার সুযোগ তৈরি করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের আর্থিক সংস্থান ক্রমেই সংকুচিত হচ্ছে। বিগত কয়েক বছরে উচ্চশিক্ষার পাঠদান বাবদ ব্যয় ও শিক্ষার্থীর সংখ্যা উভয়ই বৃদ্ধি পেয়েছে; কিন্তু তদনুযায়ী রাষ্ট্রের আর্থিক সহযোগিতা বৃদ্ধি পায়নি। করোনার কারণে, পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়েছে। করোনা পরিস্থিতির থেকে শিক্ষা নিয়ে, বিশ্ববিদ্যালয়সমূহকে ভবিষ্যতেও এই ধরনের আর্থিক সংকটের জন্য আগাম প্রস্তুতি রাখতে হবে। অপরিকল্পিত ব্যয় কমাতে হবে। শুধু সরকারি সাহায্যের দিকে তাকিয়ে না থেকে, বিশ্ববিদ্যালয়সমূহকে অর্থ সংস্থানের জন্য বিকল্প উৎস খুঁজতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঠামো এমনভাবে গড়ে তুলতে হবে যাতে যে কোনো পরিস্থিতিতে স্বগর্বে নিজস্ব কার্যক্রম চালিয়ে নিয়ে যেতে পারে।
করোনা মহামারির বিভিন্ন খারাপ দিক থাকলেও, কিছু বিষয়ে আশার সঞ্চার করেছে; যেমন—অনলাইন শিক্ষা প্রচলিত পদ্ধতি থেকে পৃথক হওয়ায় শিক্ষকেরা অনলাইন শিক্ষাদানে কোন বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত বা কোনটি বাদ দেওয়া উচিত, সে সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তা করে থাকেন। তাই পাঠদানের গুণমান বৃদ্ধি পায়। অন্যদিকে অনলাইন শিক্ষা এমন একটি প্ল্যাটফরম, যেখানে শিক্ষকপ্রদত্ত ভিডিও লেকচার, শিট, প্রেজেন্টেশন, একজন শিক্ষার্থী একাধিকবার দেখার বা বিশ্লেষণের সুযোগ পেয়ে থাকেন। এইভাবে মহামারি উচ্চ শিক্ষার ভবিষ্যতের ক্ষেত্রে পুনরায় চিন্তাভাবনা করার জন্য আমাদের সুযোগ করে দিচ্ছে। এই মহামারি, ভবিষ্যতের উচ্চশিক্ষা কার্যক্রম কেমন হতে পারে, সেটা নির্ধারণে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। এর পাশাপাশি, মহামারির কারণে সৃষ্ট সংকট উত্তরণে, জাতি-গোত্র-সম্প্রদায়নির্বিশেষে একজোট হয়ে কাজ করছে, তা আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয়, আন্তঃসমাজ, আন্তঃসম্প্রদায় এমনকি আন্তর্জাতিক সম্পর্ক উন্নয়নে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। অনেক বিশ্ববিদ্যালয় করোনা-সংক্রান্ত গবেষণায় নিজেদের নিয়োজিত করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ ভ্যাকসিন ও কার্যকরী ওষুধ উদ্ভাবন, রোগের কারণ, সঞ্চরণ ও প্রতিকারের পদ্ধতি নিরূপণ এবং এই রোগের আর্থসামাজিক প্রভাব নিয়ে গবেষণায় লিপ্ত রয়েছে। এই ধরনের গবেষণা, বিশ্ববিদ্যালয়সমূহকে গবেষণা ক্ষেত্রে নিজেদের দক্ষতা ও সক্ষমতার আস্থা স্থাপন কিংবা আস্থা পুনরুদ্ধার করার সুযোগ করে দিয়েছে। এটা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রমহ্রাসমান গবেষণা তহবিলকে আবার সুসংঘটিত করতেও সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। সমাজের অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কযুক্ত ক্ষেত্রসমূহে গবেষণা পরিচালনার মাধ্যমে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রমাণ করতে পারে—তারা সমাজের সঙ্গে যুক্ত আছে।
করোনা-সংক্রান্ত গবেষণার সূত্র ধরে বলা যায় যে, বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ দেশ, এমনকি বিশ্বের কল্যাণে এবং অগ্রগতিতে অবদান রাখতে পারে। সর্বোপরি বলা যায়, দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাব্যবস্থার পুনর্মূল্যায়ন ভবিষ্যতের সম্ভাব্য পরিস্থিতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে নির্ধারণ করা উচিত। এই মহামারি আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে নতুন মেরুকরণের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে এসেছে। এটি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে পাঠদানের নতুন পদ্ধতি সম্পর্কে ভাবতে বাধ্য করছে। এই মহামারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রচলিত গবেষণা ও সহযোগিতামূলক কার্যক্রম পরিমার্জনের দাবিকে জোরালো করেছে। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার অনগ্রসরতার পেছনে দায়ী নিয়ামকসমূহ চিহ্নিত করে, সেগুলো সংশোধনের মাধ্যমে শিক্ষাব্যবস্থাকে বিশেষত উচ্চশিক্ষা কার্যক্রমকে আরো যুগোপযোগী করার গুরুত্ব আমাদের সামনে তুলে ধরেছে। পরিশেষে বলা যায় যে, করোনা-পরবর্তী বিশ্বে নিজেদের অস্তিত্ব, প্রাসঙ্গিকতা টিকিয়ে রাখতে এবং দেশের আর্থসামাজিক উন্নতিতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে চাইলে, বিশ্ববিদ্যালয়সমূহকে অবশ্যই কার্যকরী সমন্বিত (সরকার, শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষাসংশ্লিষ্ট সবাইকে নিয়ে) পদক্ষেপ নিতে হবে। লার্ন-ফ্রম-হোম মডেল করোনা-পরবর্তী উচ্চশিক্ষা সরাসরি প্রভাব ফেলতে পারে, আমূল বদলে যেতে পারে গোটা শিক্ষাব্যবস্থা। ভবিষ্যতের পৃথিবীর সঙ্গে তাল মেলাতে সক্ষম—এমন বিশ্ববিদ্যালয় কাঠামো গড়ে তোলার জন্য দক্ষ প্রাতিষ্ঠানিক নেতৃত্ব নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি।
লেখক: অধ্যাপক ও সাবেক কোষাধ্যক্ষ, শিক্ষক সমিতি, চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও অ্যানিম্যাল সাইন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।