এ কে বোরহানউদ্দিন : কোটা নিয়ে হাইকোর্টের দেওয়া রায়ের ওপর এক মাসের স্থিতিবস্থার আদেশ দিয়েছেন আপিল বিভাগ। একই সঙ্গে কোটাবিরোধী আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ক্লাসে ফিরে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন মাননীয় প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান।
মাননীয় প্রধান বিচারপতির আহবানের প্রতি সমর্থন জানিয়ে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমিও সকল শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে বলব, ‘আপনারা ঘরে ফিরে যান।’
এই প্রসঙ্গে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সাংবিধানের মৌলিক অধিকারের ২৯ ধারা উপস্থাপন করা হলো :
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সংবিধানের মৌলিক অধিকারের ২৯ ধারার প্রতিপাদ্য বিষয় হলো -‘সরকারের নিয়োগ লাভে সুযোগের সমতা।
২৯ (১) প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা লাভের ক্ষেত্রে সকল নাগর নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা থাকিবে।
(২) কেবল ধর্ম, গোষ্টী, বর্ণ, নারী-পুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোন নাগরিক প্রজাতন্ত্রের কর্মে
নিয়োগ বা পদ-লাভের অযোগ্য হইবেন না কিংবা সেই ক্ষেত্রে তাঁহার প্রতি বৈষম্য প্রদর্শন করা যাইবে না।
(৩) এই অনুচ্ছেদের কোন কিছুই –
(ক) নাগরিকদের যেকোনো অনগ্রসর অংশ যাহাতে প্রজাতন্ত্রের কর্মে উপযুক্ত প্রতিনিধিত্ব করিতে পারেন সেই উদ্দেশ্যে তাহাদের অনুকূলে বিশেষ বিধান -প্রণয়ন করা হইতে,
(খ) কোন ধর্মীয় বা উপ-সম্প্রদায়গত প্রতিষ্ঠানে উক্ত ধর্মাবলম্বী বা উপ-সম্প্রদায়ভুক্ত ব্যক্তিদের জন্য নিয়োগ সংরক্ষণের বিধান -সংবলিত যে কোনো আইন কার্যকর করা হইতে,
(গ) যে শ্রেণীর কর্মের বিশেষ প্রকৃতির জনতা নারী বা পুরুষের পক্ষে অনুপযোগী বিবেচিত হয়, সেইরূপ যে কোন শ্রেণীর নিয়োগ বা পদ যথাক্রমে পুরুষ বা নারীর জন্য সংরক্ষণ করা হইতে রাষ্ট্রকে নিবৃত করিবে না।’
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের মৌলিক অধিকারের ২৯ ধারার এক ও দুই উপধারা কোন কোটা প্রবর্তনের সুযোগ নাই কিন্তু উপধারা তিন এর (ক), (খ), (গ) অনুচ্ছেদে যে বিষয়ে নিহিত আছে রাষ্ট্রের সংবিধান প্রণেতাগণ এবং সুপ্রীম কোর্ট বাংলাদেশের স্বাধীনতার আজ অর্ধশতাব্দীর অধিক সময় পরে শর্তাবলির কতটুকু গ্রহণযোগ্যতা আছে বা আদৌ প্রয়োজন আছে কি না তা সংবিধানের এই শর্তাবলির ক্ষেত্রে সংশোধন বা পরিমার্জনের প্রয়োজন হলে তা সঠিকভাবেই করবেন।
আমরা যদি মেধাকে উপেক্ষা না করি এবং এর বিকাশ সাধনে তৎপর থাকি, তাহলে শক্তিশালী জাতি গঠন করার ক্ষেত্রে মেধা এবং প্রযুক্তি হবে আমাদের চলার পথের অগ্রযাত্রার সোপান।
এখানে উল্লেখ্য যে, সরকারি চাকরিতে স্বাধীনতার পর থেকেই কোটা ছিল। বিভিন্ন সময় তা কমে এবং বৃদ্ধি পেয়ে ২০১৮ সালে এসে তা দাঁড়ায় ৫৬ শতাংশে। এর মধ্যে ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা, ১০ শতাংশ নারী, ১০ শতাংশ জেলা, ৫ শতাংশ ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী এবং ১ শতাংশ প্রতিবন্ধী কোটা। শুরু থেকেই মুক্তিযোদ্ধা কোটা ছিল। পরে এ কোটায় মুক্তিযোদ্ধার সন্তান এবং তারপর নাতি-নাতনি যুক্ত করা হয়।
শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে ২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর সরকারি চাকরিতে নারী কোটা ১০ শতাংশ, মুক্তিযোদ্ধা কোটা ৩০ শতাংশ এবং জেলা কোটা ১০ শতাংশ বাতিল করে পরিপত্র জারি করে সরকার।
ওই পরিপত্রের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২০২১ সালে হাই কোর্টে রিট আবেদন করেন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান পরিচয়ে সাতজন।
আবেদনের চূড়ান্ত শুনানি শেষে গত ৫ জুন হাই কোর্টের একটি বেঞ্চ মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন। এই রায়কে প্রত্যাখ্যান করে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এখন আন্দোলনে নেমেছে।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মাননীয় সংসদ সদস্য ওবায়দুল কাদের বলেন, তারা ‘যেই ইস্যুতে আন্দোলন করছে সেটা তো সরকারেরই সিদ্ধান্ত ছিল। আদালত ভিন্ন রায় দিয়েছে। আদালতের ব্যাপারটা আপিল বিভাগে আছে। বিচারাধীন বিষয় নিয়ে আমার কথা বলা উচিত নয়। এটা এখন আদালতের এখতিয়ার।’
প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ লাভের ক্ষেত্রে সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা থাকিবে আজ মোটামুটি বৃহৎ জনমতে এটাই প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে।
আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, জাতীয় সংসদের নেতা বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশব্যাপী ছাত্ররা যখন কোটা চান না তখন কোটা সংস্কারের তাঁর সংসদে উত্থাপিত নির্দেশণার আলোকে সরকারের প্রণীত কোটা নীতি সম্বলিত পরিপত্র বাতিল হয়ে যায়। কোটা বাতিলে নুতন পরিপত্র জারি হয়।
সংবিধান সমুন্নত। কিন্তু আপিল বিভাগ হাইকোর্ট বিভাগের সে রায় এর উপরে কিন্তু এখনো রায় প্রদান করেন নাই। ফলে আপিলের কারণে হাইকোর্ট বিভাগ যে রায় প্রদান করেছেন সে রায় ঝুলে আছে। অর্থাৎ অকার্যকর আছে।
এখন এই সংবিধানকে সমুন্নত রাখতে মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট যে রায় প্রদান করবেন তাই আগামীতে সংবিধানে প্রতিষ্ঠিত হবে। সুতরাং সময় নষ্ট করে রাজপথে অবস্থান না করে বিদ্যালয়ের ক্লাস রুমে যে লেখালেখির মাধ্যমে সরকারকে সহজভাবে বার্তাগুলো পৌঁছে দেয়ার ভূমিকা থাকা উচিত বলে আমি মনে করি।
আরো একটি বিষয় লক্ষ্যণীয় যে, কোটা নিয়ে হাইকোর্টের দেওয়া রায়ের ওপর এক মাসের স্থিতিবস্থার আদেশ দিয়েছেন আপিল বিভাগ। একই সঙ্গে কোটাবিরোধী আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ক্লাসে ফিরে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের মাননীয় বিচারপতি প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান।
সরকারি চাকরির প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা পদ্ধতি বাতিলের সিদ্ধান্ত অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেওয়া রায়ের ওপর স্থিতাবস্থা জারি করেছেন আপিল বিভাগ। একই সঙ্গে আগামী চার সপ্তাহ পর বিষয়টি পরবর্তী শুনানি করার জন্য দিন নির্ধারণ করা হয়েছে।
এদেশে এখনো অনেক কিংবদন্তি মুক্তিযোদ্ধা জীবিত আছেন। আমি আমার শৈশবে ক্লাস নাইনে ওঠে মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলাম সেখানে কোন নিজের আকাঙ্ক্ষা ছিল না ; ছিল এই দেশ শত্রু মুক্ত করতে হবে। এদেশ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের আদর্শ উজ্জীবিত হবে-এই মনে করে।
স্বাধীনতার এই ৫৪ বছরে পিছনে আমরা অনেক ইতিহাস দেখেছি, দেখেছি স্বাধীনতার স্থপতি প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমান কী নৃশংসভাবে সপরিবারে নিহত হযে শহীদ হলেন মীরজাফরদের ষড়যন্ত্রে। বাঙালির ইতিহাসে যে কাল অধ্যায়ের অমানিশার প্রলয়ান্ধকার স্বাধীনতার ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছে বোধ করি আজও তার জের শেষ হয়নি।
আমি মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির আহ্বানকে সশ্রদ্ধ চিত্তে স্বাগত জানাই। এবং সেই সাথে তাঁর সমীপে সদয় মন্তব্য করতে চাই যে কিংবদন্তি মুক্তিযোদ্ধারা এখন জীবিত আছেন, তাঁদের মধ্যে এখন কেহ কেহ মাননীয় এমপিও আছেন।
আমি কথা বলছিলাম বীর মুক্তিযোদ্ধা, সাবেক এমপি(গোপালগঞ্জ) জনাব ফরিদ আহমেদের সাথে। তিনি বলেন, ‘আমাদের খুব দুর্ভাগ্য আমরা জাতির পিতাকে হত্যা করেছি। আমার সৌভাগ্য হয়েছিল তাঁর সান্নিধ্য পাওয়ার। তিনি বেঁচে থাকলে আজকে বাংলাদেশে কোথায় চলে যেত, আজকের প্রজন্মরা তা চিন্তাও করতে পারবেনা। বাংলাদেশের অভ্যুদয় কেন হয়েছিল এবং এর অবস্থান কি-তা সারা বিশ্ব তাকিয়ে থাকতো। প্রধানমন্ত্রী এবং রাষ্ট্রপতি থাকা অবস্থায় তিনি অধ্যায়ন করতেন এবং আমাদের কাছে শেয়ার করতেন কীভাবে এই দেশকে গঠন করবেন। কিন্তু বাঙালির বড় দুর্ভাগ্য যে তারা তাদের প্রিয় নেতাকে হারিয়েছেন সবেমাত্র স্বাধীনতার অভ্যুদয়ের পরেই। সমাজকে তিনি এমনভাবে গড়তেন, এই কোমলমতি ছাত্রদের তো কোন আন্দোলন করার কথাই নয়। তারপর তাঁর কন্যা বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা যেভাবে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন কিন্তু যাকে ক্ষমতা দেয় সেই নিজের স্বার্থ দেখেন রাষ্ট্রের স্বার্থ কেউ দেখেনা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কিন্তু আজকের আন্দোলন নয়। অথচ এদের আন্দোলনকে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ মনে করে কেউ কেউ। এরাই বর্তমানের এবং আগামী প্রজন্মের ভবিষ্যৎ। তাঁদের প্রতি বৈষম্য কখনো মুক্তিযোদ্ধের চেতনা হতে পারে না।’
আমি সংবিধানের মৌলিক অধিকারের এক এবং দুই অনুচ্ছেদের প্রতি মহামান্য প্রধান বিচারপতি, অন্যান্য ডিভিশনের মাননীয় বিচারপতি মহোদয়গণের দৃষ্টি আকর্ষণ করব।
নতুন প্রজন্মরা চাচ্ছে না কোন কোটা। সুতরাং আপনাদের বিচারিক রায়ের প্রতি একটি সার্বজনীন মতামত থাকবে বলেই সমগ্র জাতি প্রত্যাশা করে।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা (কর কমিশনার, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড।
*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।