জুমবাংলা ডেস্ক : সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি বিলুপ্ত না করে এর সংস্কারের পথে হাঁটতে চান ক্ষমতাসীনরা। সরকার ও ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের অনেকে মনে করছেন, কোটাবিরোধী আন্দোলনের চাপে এ পদ্ধতির বিলুপ্ত করা ঠিক হবে না। তবে চালু থাকা ৫৬ শতাংশ কোটার হার কমিয়ে এনে সবার স্বার্থ রক্ষা করতে হবে। সরকার ও আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ একাধিক নেতা কালের কণ্ঠকে এমনটা জানিয়েছেন।
সরকারের একাধিক সূত্র জানায়, কোটা পদ্ধতির সংস্কারে সরকার কোনো সিদ্ধান্ত দিতে চায় না। যেহেতু বিষয়টি উচ্চ আদালতে বিচারাধীন, ফলে তাঁদের সিদ্ধান্তের জন্যই অপেক্ষা করাটা সরকারের জন্য সুবিধাজনক পথ হবে। আদালতের যে রায় আসবে, সেটাই বাস্তবায়ন করবে সরকার। ফলে কোটাবিরোধী আন্দোলনের চাপে এই মুহূর্তে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো সিদ্ধান্ত আসার সম্ভাবনা কম।
বর্তমানে সরকারি চাকরিতে ৫৬ শতাংশ কোটা। এর মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা ৩০ শতাংশ, জেলা ১০ শতাংশ, নারী ১০ শতাংশ, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ৫ শতাংশ এবং প্রতিবন্ধীদের জন্য ১ শতাংশ কোটা রয়েছে। এর আগে কোটাবিরোধীদের আন্দোলনের মুখে ২০১৮ সালের অক্টোবরে সরকার এক পরিপত্র জারি করে কোটা বাতিল করেছিল। ওই পরিপত্রের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২০২১ সালে হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান অহিদুল ইসলামসহ সাতজন।
গত ৫ জুন কোটা পুনর্বহাল করে রায় দেন হাইকোর্ট। সরকার হাইকোর্টের আদেশ স্থগিতের আবেদন করলেও আপিল বিভাগ এতে সাড়া দেননি। গত ৪ জুলাই আপিল বিভাগের ওই সিদ্ধান্তের পর কোটাবিরোধীদের আন্দোলন জোরদার করা হয়েছে।
গতকাল সোমবার দুপুরে রাজধানীর ধানমণ্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কার্যালয়ে বৈঠক করেন সরকারের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন মন্ত্রী। এতে উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, শিক্ষামন্ত্রী মুহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত, শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী শামসুন নাহার, প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী ও আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া।
দলীয় একাধিক সূত্র জানায়, বৈঠকে কোটাবিরোধী আন্দোলন ও কোটা পদ্ধতির সংস্কার নিয়েই মূলত আলোচনা হয়। সেখানে আইনমন্ত্রী কোটা পদ্ধতির সংস্কারের আইনি পথ কী হতে পারে, সে বিষয়ে বক্তব্য দেন। সংবিধান অনুযায়ী, কোটা পদ্ধতির প্রয়োজন আছে বলে বৈঠকে আলোচনা হয়।
দলীয় একাধিক সূত্র মতে, আন্দোলনের চাপে কোটা পদ্ধতির বিষয়ে এখনই সরকারের পক্ষ থেকে কোনো সিদ্ধান্ত না নেওয়ার পথে হাঁটার বিষয়ে আলোচনা হয়। এ বিষয়ে উচ্চ আদালতের রায়ের অপেক্ষায় থাকার পক্ষে মত দেন মন্ত্রিসভার সদস্যরা।
বৈঠক শেষে বেরিয়ে যাওয়ার সময় মন্ত্রিসভার সদস্যরা তাঁদের সিদ্ধান্তের বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাননি। এক প্রশ্নের জবাবে তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত বলেন, সামগ্রিক বিষয় নিয়ে কথা বলেছি। রাজনৈতিক, সাংগঠনিক বিষয় নিয়ে কথা বলেছি। এটা রুটিন একটা বিষয়।
চলমান আন্দোলনের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়েছে কি না, জানতে চাইলে তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত বলেন, ‘কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রক্রিয়ার মধ্যে আছে। আমরা নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করছি।’
কোটা ২৫ শতাংশে নেমে আসবে কি না—এমন প্রশ্নের উত্তরে শিক্ষামন্ত্রী মুহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল বলেন, ‘সেটা তো আদালতের বিষয়। আদালত যে সিদ্ধান্ত দেবে সেটা আমরা…বিচারাধীন বিষয়ে আমরা কোনো মন্তব্য করতে চাই না। যারা এই দাবিটা (কোটা বাতিল) করেছেন, তাঁদের একটু অপেক্ষা করতে হবে। সরকার তো এর মধ্যে আপিল করেছে।’
কোটার বিষয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কয়েকজন নেতা জানান, মূলত মুক্তিযোদ্ধাদের নাতিদের জন্য ৩০ শতাংশ কোটার বিষয়টি নিয়েই বেশি সমালোচনা হচ্ছে। এ বিষয়টি নিয়ে দলের উচ্চ পর্যায়ে মূল্যায়ন চলছে। এ কোটার হার কমিয়ে আনার সিদ্ধান্ত আসতে পারে। তবে আন্দোলনকারীদের দাবির কাছে নত হয়ে কোটা বাতিলের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ।
দলের কেন্দ্রীয় একাধিক নেতার মতে, কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীদের সঙ্গে বিএনপি, জামায়াতসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর যোগাযোগ কতটুকু আছে, আন্দোলনকারীদের কারা দলীয় কর্মী, সে বিষয়গুলো দ্রুত চিহ্নিত করতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছে সরকারের উচ্চ পর্যায়।
সংবাদ সম্মেলনে ওবায়দুল কাদের
গতকাল দুপুরে ধানমণ্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে কোটাবিরোধী আন্দোলনের বিষয়ে কথা বলেন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।
কোটাবিরোধী আন্দোলনে জনদুর্ভোগ কমাতে সরকারের কঠোর হওয়ার পরিকল্পনা আছে কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘আমরা তো আপিল করলাম। এখনো আদালত চূড়ান্ত রায় দেননি। এর মধ্যে আমরা কিভাবে হস্তক্ষেপ করি? আমরা তো বলছি, জনদুর্ভোগ হয়—এমন কর্মসূচি পরিহার করা উচিত। আদালতের রায় হোক, তারপর দেখা যাবে।’
ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী ২০১৮ সালে পরিপত্র জারি করে সব ধরনের কোটা বিলোপ করেছেন। এই আদেশের বিরুদ্ধে সাতজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান উচ্চ আদালতে রিট করে, দেশের উচ্চ আদালত কোটা বাতিলের পরিপত্র বাতিল করেছেন। সরকারপক্ষের আইনজীবী হাইকোর্টের রায়ের পক্ষে আপিল করেছেন। সরকার কোটা বাতিলের দাবির প্রতি আন্তরিক বলেই অ্যাটর্নি জেনারেল আপিল করেছেন।’
ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘আদালত উভয় পক্ষের যুক্তি-তর্ক শুনে নিশ্চয়ই একটা চূড়ান্ত রায় দেবেন। উচ্চ আদালতের রায় না হওয়া পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। কোনো প্রকারের উত্তেজনা, রাস্তাঘাট বন্ধ করে মানুষের দুর্ভোগ সৃষ্টি পরিহার করা উচিত। বিশেষত, এইচএসসি পরীক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের অসুবিধা হয় যে কর্মসূচিতে, সে ধরনের কর্মসূচি পরিহার করা দরকার।’
ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘শিক্ষিত, দক্ষ, স্মার্ট প্রজন্ম গঠনের মধ্য দিয়ে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের সংগ্রামকে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে নিতে মেধাবী তরুণ প্রজন্ম আমাদের প্রধান প্রয়োজন।…এর আগে যে কোটা আন্দোলন বাংলাদেশে হয়েছিল, সেখানকার প্রথম সারির ৩১ জন নেতা কিন্তু বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেনি। এটার হিসাব আপনারা (সাংবাদিক) নিতে পারেন।’
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেন, ‘বিএনপি প্রকাশ্যে এবং তাদের সমমনারা এই কোটা আন্দোলনের ওপর ভর করেছে। তারা সমর্থন করেছে প্রকাশ্যেই। সমর্থন করা মানেই তারা এর মধ্যে অংশগ্রহণও করেছে। কাজেই এটা এখন মেরুকরণের রাজধানীর ধারার মধ্যেই পড়ে গেছে। এটা রাজনৈতিক রং, নতুন করে বলার আর অপেক্ষা রাখে না। এখানে কারা কারা যুক্ত আছে, কোনো ষড়যন্ত্রের অংশ কি না, সেটা আন্দোলনের গতিধারার মধ্যেই বোঝা যাবে।’
এ সময়ে সর্বজনীন পেনশন স্কিমের বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের আন্দোলন প্রসঙ্গেও কথা বলেন ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেন, ‘এখানে ভুল বোঝাবুঝি থাকতে পারে। তাঁদের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগও আছে। আনুষ্ঠানিক বসাবসি এখনো হয়নি। সিদ্ধান্ত তো নিতে হবে বাস্তব পরিস্থিতির আলোকে।’
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, সাংগঠনিক সম্পাদক বি এম মোজাম্মেল হক, এস এম কামাল হোসেন, সুজিত রায় নন্দী প্রমুখ।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।