লাইফস্টাইল ডেস্ক: কোভিড-১৯ এর কারণে যুক্তরাজ্যে প্রথম লকডাউন দেয়া হয় গত বছরের মার্চ মাসে। তখনই ক্রিস্টিনা বুঝে গিয়েছিলেন যে, তার সঙ্গী খোঁজার বিষয়টি বড় ধরণের বাধার মুখে পড়বে। খবর বিবিসি বাংলার।
অনেকের মতো তিনিও ভার্চুয়াল ডেটিংয়ের দিকে ঝোঁকেন- এটা হচ্ছে এমন একটি প্রক্রিয়া যেখানে বিয়ের আগে পাত্র-পাত্রীরা একে অন্যকে জানার সুযোগ পান। তিনি এখন এই প্ল্যাটফর্মে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন এমনকি তিনি এটি পছন্দও করছেন।
আর এভাবেই “জুম্যান্সিং” ডেটিং বা অনলাইন প্ল্যাটফর্মে রোম্যান্সের প্রক্রিয়াটি ভালর জন্যই একটা বদল এনেছে বলে তিনি বলছেন।
ক্রিস্টিনা বলেন, লকডাউন মানে হচ্ছে যে আমি ডেট করতে বাইরে যেতে পারবো না। তিনি ৪৩ বছর বয়সী একজন আফ্রিকান নারী যিনি লন্ডনে থাকেন এবং শিশুদের দেখাশুনা করা ও ঘরের কাজে সহায়তার কাজ করেন।
তিনি বলেন, আমার এখনও বারে গিয়ে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে ভাল লাগে। কিন্তু আগে থেকে চিনি না এমন কারো সাথে পরিচিত হওয়ার প্রক্রিয়াটা এখন আর আমি মিস করি না।
“ভিডিওতে যদি অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু ঘটার শঙ্কা তৈরি হয় তাহলে আপনি যেকোন সময় এটি থেকে বের হয়ে আসতে পারবেন। এটা বিব্রতকর পরিস্থিতি থেকে বাঁচায়। এর মাধ্যমে সময় এবং টাকা-দুটোই বাঁচে। এছাড়া মদ পানও কম হয়।”
“স্লো লাভ বা ধীরে ধীরে প্রেমে পড়া”
প্রায় দুই দশক ধরে ইন্টারনেট বিশ্ব জুড়ে প্রেমিক-প্রেমিকার সাক্ষাতের একটি সাধারণ মাধ্যমে পরিণত হয়েছে। আর সেখানে মহামারির সময় দেখা করা এবং ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা আসায় ডেটিংয়ের বিষয়টিতেও অনেক পরিবর্তন এসেছে।
২০২০ সালে ডেটিং অ্যাপগুলোতে সদস্য হওয়ার হার বেড়েছে। হিঞ্জ নামে একটি অ্যাপ জানিয়েছে যে তাদের অ্যাপটির ডাউনলোডের হার ৮২% বেড়েছে।
উই আর সোশ্যাল নামে একটি কনসালটেন্সি প্রতিষ্ঠান জানাচ্ছে যে, ডেটিং অ্যাপগুলোতে তারা আরো বেশি পরিমাণে টাকা খরচ করছে। এই প্রতিষ্ঠানের হিসাবে গত বছর টিকটক আর নেটফ্লিক্সের তুলনায় বেশি ব্যবহারকারীরা টিন্ডার-এ বেশি অর্থ ব্যয় করেছে। কিন্তু ডেটিং কোম্পানিগুলো বলছে যে, জরিপে আরো কিছু পরিবর্তনও লক্ষ্য করা গেছে।
তারা লক্ষ্য করেছে যে, যেসব স্থানে সামাজিক দূরত্ব মেনে মানুষের সাথে দেখা করা সম্ভব সেখানেও মানুষ প্রথমেই সরাসরি গিয়ে দেখা করার চাইতে প্রথম সাক্ষাত দূরবর্তী প্ল্যাটফর্মে সারতেই পছন্দ করছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে, এই ট্রেন্ডটি ভিডিও কল বেশি ব্যবহার করার মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে এবং এর একটি নামও রয়েছে: জুম্যান্সিং।
এক ডেটিং কোচ এবং টেডএক্স বক্তা হেয়লি কুইন বলেন, যেখানে বাস্তব জীবনে সরাসরি মানুষের সাথে দেখা করার সেই আগের উপায়টা প্রায় উঠে গেলেও মানুষের সাথে দেখা করা বা কারও সাথে যুক্ত হওয়ার আগ্রহ মানুষের কমেনি। কিন্তু মহামারির কারণে ডেটিংয়ের জুম্যান্সিং ট্রেন্ড শুরু হয়েছে, যেখানে মানুষ প্রথমবার দেখা করার আগে পরস্পরকে আরো ভালভাবে জানা ও বোঝার সুযোগ পায়।
ডেটিং বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, মানুষের সামাজিক জীবন স্তব্ধ হয়ে পড়ার কারণে তারা কিভাবে সম্পর্ক তৈরি করতে চায় সে বিষয়ে দৃষ্টি দেয়ার সুযোগ বেড়েছে।
ম্যাচ ডট কম নামে একটি সাইটে কর্মরত নৃবিজ্ঞানী এবং প্রধান বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা হেলেন ফিশার মনে করেন, এই বিষয়টি একটি ট্রেন্ড তৈরি করেছে যাকে “স্লো লাভ বা ধীরে ধীরে প্রেমে পড়া” বলা যায়।
তিনি বলেন, সিঙ্গেল বা সঙ্গীহীন মানুষদের নিয়ে বছরের পর বছর ধরে জরিপ পরিচালনা করেছি আমি। মহামারির আগে মাত্র ৬% মানুষ ভিডিও চ্যাট করতো। আর এখন প্রতি ৫ জনের একজন ভিডিও চ্যাট করে।
“মানুষ এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি ঘরে থাকে এবং তারা এখন পরস্পরের সাথে ফলপ্রসূ আলোচনা করায় বেশি সময় ব্যয় করছে। সেই সাথে আগের তুলনায় সৎ, স্বচ্ছ এবং নিজের সম্পর্কে আরো বেশি তথ্য অন্যের কাছে তুলে ধরছে।”
উদাহরণ হিসেবে বলা যায় ক্রিস্টিনা জানিয়েছেন যে, লকডাউনের কারণে তিনি তার ভবিষ্যৎ সঙ্গীর সাথে আরো বেশি খোলাখুলি আলোচনা করার সুযোগ পেয়েছেন। আর এটা সরাসরি দেখা না করেই সম্ভব হয়েছে।
তিনি বলেন, এর মানে হচ্ছে যে আমরা এখন পরস্পরকে আরো স্বতঃস্ফূর্তভাবে জানার সুযোগ পেয়েছি।
সাংস্কৃতিক পরিবর্তন
স্বাভাবিকভাবেই মহামারির কারণে বেশ কয়েকটি ডেটিং অ্যাপ ভিডিও কল আরও বেশি করে ব্যবহারের সুযোগ দিচ্ছে।
এলজিবিটি সম্প্রদায়ের জন্য তৈরি গ্রিন্ডর নামের অ্যাপটি সীমিত সময়ের জন্য সম্পূর্ণ বিনামূল্যে প্রিমিয়াম ভিডিও চ্যাটিংয়ের সুযোগ দিয়েছে এবং এর মাধ্যমে প্রাইড মান্থের মতো গুরুত্বপূর্ণ দিবস বা অনুষ্ঠানের আগে ব্যবহারকারীদের এক সাথে নিয়ে আসার কাজটি করে।
গ্রিন্ডর এর মার্কেটিং এর প্রধান অ্যালেক্স ব্ল্যাক বলেন, মহামারির সময় আমরা অবশ্যই ডেটিং অ্যাপগুলোতে একটি সাংস্কৃতিক পরিবর্তন লক্ষ্য করছি। আমাদের প্রায় ৪৮% ব্যবহারকারী বলেছেন যে, তারা ভার্চুয়ালি একে অন্যের সাথে যুক্ত হয়েছেন, তারা ছবি এবং ভিডিও দিয়েছেন।
তিনি বলেন, এটার মানে হচ্ছে যে, কারো সাথে দেখা করতে গেলে যে অপেক্ষা করতে হতো সেটা আর করতে হচ্ছে না এবং তার বদলে মানুষ মুহূর্তেই মানুষ পরস্পরের সাথে যুক্ত হতে পারছে। ডেটিং শিল্পে এখন এই জুম্যান্সারদের কথা মাথায় রেখে নতুন প্রযুক্তি বাজারে আনারও চিন্তা করছে।
ফিল্টার অফ নামে একটি অ্যাপের সহ-প্রতিষ্ঠাতা জ্যাক শ্লেইয়েন গত বছর নিজের ডেটিং অভিজ্ঞতা থেকে উৎসাহিত হয়ে ভিডিও চ্যাট ভিত্তিক অ্যাপ তৈরি করেন।
তিনি বলেন, মহামারির আগেও তিনি তার হবু সঙ্গীকে সরাসরি দেখা করার আগে ভিডিও কলের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, আমরা ডেটে গিয়ে অনেক সময় বুঝতে পারি যে আমাদের মধ্যে আসলে তেমন কোন মিল নেই কিংবা এক জন হয়তো আরেক জনকে তেমন পছন্দ করেনি।
“আর তাই কারো সাথে সরাসরি দেখা করার আগে আমি মানুষকে ভিডিও কলের আমন্ত্রণ জানাতাম এটা দেখতে যে তার সাথে ইতিবাচক কোন আবহ তৈরি হয় কিনা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আমি নিরাশ হয়েছি।”
“কিন্তু আমি জানতাম যে, আরো মানুষ রয়েছে যারা আমার মতোই একই ধরণের মানসিকতার। মহামারি দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দিয়েছে এবং ভিডিও চ্যাটিং আরও বেশি গ্রহণযোগ্য হয়েছে।”
কুইন বলেন, তারা জরিপের তথ্য থেকে আভাস পেয়েছেন যে, মহামারি শেষ হয়ে যাওয়ার পরও “মানুষ বলেছে যে তারা ভিডিও কলের প্রতি আগ্রহী।
টিন্ডারের তথ্য মতে, ৬৫% গ্রাহক যারা গত অক্টোবরে ভিডিও চ্যাটের বিষয়টিকে একবার ব্যবহার করেছেন তারা এটি আবারো ব্যবহার করবেন।
ফিশার মনে করেন যে, ভিডিও একটি অনুষঙ্গ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে এবং স্বাভাবিক জীবনযাপন শুরু হলেও এটার ব্যবহার বন্ধ হবে না।
“আমার মনে হয় যে, আগের চেয়ে মানুষ কম পরিমাণে প্রথম বারেই সরাসরি সাক্ষাৎ বা ফার্স্ট ডেটিং করবে। কারণ মানুষ আসলে প্রথমবার সাক্ষাতে অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি এড়াতে চায়। আবার একই সাথে আমরা আরো তাৎপর্যপূর্ণ ফার্স্ট ডেটও দেখবো।
এখনও, ভার্চুয়াল ডেটিং বেশ কঠিন। কারণ ক্রিস্টিনা বলেছে যে, তার কিছু বন্ধু রয়েছে যাদেরকে চাকরীর কারণে নিয়মিত কনফারেন্স কলে মিটিং করতে হয় তারা আরো বেশি পরিমাণে নিজেদের জীবনে স্ক্রিন টাইম যোগ করতে চাইবে না।
তিনি বলেন, এরা অনেকেই প্রায় সারাদিন জুম কলে থাকে এবং তাদের কাছে ভিডিও ডেটিং বেশ কঠিনই বটে।
এছাড়া প্রচলিত ডেটিং পদ্ধতির মতো ভার্চুয়াল ডেটিংয়ের ক্ষেত্রে সফলতা অতোটা নিশ্চিত থাকে না।
ক্রিস্টিনা বলেন, এখনও পর্যন্ত যাদের সাথে তিনি ভিডিও চ্যাট করেছেন তাদের কারো সাথেই তিনি এখনো “যুক্ত” হননি।
তবে লকডাউনের প্রথম ভালবাসা দিবসে এর কারণে তিনি বিমর্ষ বা আতঙ্কিতও নন-তিনি তার চারপাশে থাকা মানুষদের সাথে নিয়ে দিনটি উদযাপনের পরিকল্পনা করছেন।
“আমি আমার ফ্ল্যাটের সঙ্গীদের জন্য সামুদ্রিক মাছের একটি নতুন রেসিপি রান্না করছি। মহামারির পরও যে আমরা বেঁচে আছি সেটাই উদযাপন করবো। এই মুহূর্তে এটাই সবচেয়ে বেশি জরুরি।”
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।