এক্সরে সংবেদনশীল টেলিস্কোপে দেখা গেছে, গ্যালাক্সিপুঞ্জের মাঝের ফাঁকা জায়গায় একধরনের গ্যাস থাকে। এই গ্যাস ক্লাস্টারের ফাঁকা জায়গাগুলো দখল করে নেয়। এর তাপমাত্রা হয় মোটামুটি দশ মিলিয়িন ডিগ্রির মতো। এত বেশি উত্তপ্ত যে এরা এক্সরে হিসেবে জ্বলজ্বল করতে থাকে।
এই গ্যাসীয় মাধ্যমের মধ্য দিয়ে গ্যাসভর্তি কোনো গ্যালাক্সি যখন ছুটে যায়, তখন এই গ্যাস গ্যালাক্সিগুলোর পাকানো দেহ, মানে সর্পিল প্যাঁচ খুলে ফেলে। ফলে গ্যালাক্সির নতুন নক্ষত্র তৈরি করার নিজস্ব যে ক্ষমতা, তা নষ্ট হয়ে যায়। ছড়িয়ে পড়ে এর ভেতরের নক্ষত্রগুলো। মহাশূন্যে ভেসে চলে ছন্নছাড়াভাবে।
মজার ব্যাপার হলো, এই প্রচণ্ড উত্তপ্ত গ্যাসের ভর হিসেব করলে দেখা যাবে, ক্লাস্টার বা পুঞ্জের সব গ্যালাক্সির চেয়ে ভয়ংকর এই গ্যাসের ভর প্রায় ১০ গুণ বেশি!
এগুলো তো আমাদের জানা বিষয়। অজানা জিনিসপত্রও আছে। ভর মাপতে গেলেই টের পাবেন, অদ্ভুত একধরনের ভর পাওয়া যাচ্ছে, অথচ কীসের ভর, তা কিছুতেই বোঝা যাচ্ছে না। এরকম অজানা ভরকে বিজ্ঞানীরা ইংরেজিতে বলেন ডার্ক ম্যাটার। এরকম ডার্ক ম্যাটারের সন্ধান পাওয়া গেছে আন্তঃগ্যালাকটিক স্থানে। দেখা গেছে, এরকম এক অজানা ভরের স্তূপ ৩০ হাজার আলোকবর্ষ জুড়েও ছড়িয়ে আছে!
তবে মহাশূন্য বা ফাঁকা বলতে আমরা যা বুঝি, যেখানে বামন গ্যালাক্সি নেই, ছড়িয়ে থাকা তারা নেই, সেই মহাশূন্যও কিন্তু আসলে শূন্য নয়। কোনো কারণে আপনি যদি সেখানে যেতে চান, তাহলে একটা সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ দিয়ে দিই—ওসব আন্তঃগ্যালাকটিক জায়গা স্বাস্থ্যের জন্যে ক্ষতিকর!
ওখানে গেলে, প্রথমেই আপনার দেহ মহাবিশ্বের তাপমাত্রার সঙ্গে সমতা করতে ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার দিকে এগোতে থাকবে। শিগগির জমে বরফ হয়ে যাবেন আপনি। বায়ুমণ্ডলীয় চাপের অভাবে আপনার দেহের রক্তকোষগুলো বিস্ফোরিত হবে। ফেটে ছড়িয়ে পড়বে চারদিকে। তবে এগুলো আসলে বড় ব্যাপার না। বলা যায়, সাধারণ সমস্যা।
গ্যালাক্সির ফাঁকে ফাঁকে এ জায়গার আসল সমস্যা হলো, প্রচণ্ড দ্রুতগামী ও ভয়ংকর শক্তিশালী চার্জিত একধরনের অতিপারমাণবিক কণা। বিজ্ঞানীরা বলেন মহাজাগতিক রশ্মি। সর্বোচ্চ শক্তির এ ধরনের কণার শক্তি এলএইচসি বা আরও শক্তিশালী পার্টিকেল অ্যাকসিলারেটরে গতিশীল কণার চেয়ে অন্তত ১০০ মিলিয়ন গুণ বেশি তো হবেই। কিন্তু কোত্থেকে এল এগুলো?
এদের উৎপত্তি আমাদের কাছে আজও রহস্য। কিন্তু এর মধ্যে বেশির ভাগ চার্জিত কণা যে প্রোটন, মানে হাইড্রোজেন পরমাণুর নিউক্লিয়াস, এটুকু আমরা জানি। মহাজাগতিক রশ্মিতে এদের গতিবেগ হয় প্রচণ্ড, আলোর বেগের ৯৯.৯৯৯৯৯৯৯৯৯৯৯৯৯৯৯৯৯৯ শতাংশ!
এরপর আছে ভ্যাকুয়াম। এই হলো, আপনি যাকে এতক্ষণ ধরে শূন্য ভাবছেন, সেই শূন্য। অথচ, এই শূন্যও শূন্য নয়! মহাবিশ্বের তর্কসাপেক্ষে সবচেয়ে অদ্ভুত জায়গা এসব ভ্যাকুয়াম। কারণ, এর মধ্যে প্রতিমুহূর্তে জন্ম নিচ্ছে ভার্চ্যুয়াল কণা। আবার মুহূর্তেই ধ্বংসও হয়ে যাচ্ছে!
এগুলো আসলে পদার্থ ও প্রতিপদার্থ কণাজোড়। মুহূর্তের মধ্যে জন্ম নিয়ে ভ্যাকুয়াম থেকে লাফিয়ে বেরিয়ে আসে, পরমুহূর্তে আবার বিলীন হয়ে যায়। এই মুহুর্তের বেরিয়ে আসার ব্যাপারটাকে ফুটন্ত পানির কড়াই থেকে লাফিয়ে বেরিয়ে আসা পানির বুদবুদের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। কোনোভাবেই এদের অস্তিত্ব শনাক্ত করা যায় না, ইংরেজিতে যাকে বলে আনডিটেক্টেবল। কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞানের এই অদ্ভুত অনুমানকে বলা হয় ‘ভ্যাকুয়াম শক্তি’।
ভ্যাকুয়ামের এই শক্তি যেন তেন শক্তি নয়। অনেক বিজ্ঞানীর ধারণা, এই শক্তি মহাকর্ষের বিপরীতে কাজ করে, করে চলেছে, প্রতিমুহূর্তে। এর জোরেই মহাকর্ষের বাধা ঠেলে বিস্তৃত হয়ে চলেছে মহাবিশ্ব। এর পোষাকী নাম, ডার্ক এনার্জি। বাস্তবতা হলো, ডার্ক মানে অজানা। হ্যাঁ, রহসম্যয় ডার্ক এনার্জি হতে পারে ভ্যাকুয়ামের এই শক্তিই। কিন্তু জিনিসটা আসলে কী, কেউ জানে না।
বুঝতেই পারছেন, গ্যালাক্সির ভেতরের চেয়ে বাইরের অংশগুলো কোনো হিসেবেই কম চমকপ্রদ নয়। মহাজাগতিক এই শহরগুলোই আমাদের চিন্তায় মহাবিশ্বের কাঠামো হিসেবে ধরা দেয়। অথচ মহাবিশ্বের রহস্যময় ঘটনাগুলোর বড় একটি অংশ ঘটে চলেছে ছায়াপথের ফাঁকে ফাঁকে।
এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয়, আমরা কতটা ক্ষুদ্র। অথচ নিজেদের আমরা বরাবরই বড় বেশি গুরুত্ব দিই। আমরা ভুলে যাই, মহাবিশ্বে আসলে কোনো কেন্দ্র নেই। বড় গ্যালাক্সি, বামন গ্যালাক্সি, প্রাণের ঠিকানা কিংবা নানা নাম, ভাগ-বিভাগ—এসবই আমাদের দেওয়া। অথচ আমরা এই বিশাল মহাবিশ্বের নিতান্ত সাধারণ এক গ্রহের মানুষ। এ আলোচনা নিজেদের সেই ক্ষুদ্রতার কথা মনে করিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা। আর কিছু নয়।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।