বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ডেস্ক: এ যাবৎকালের সবচেয়ে কার্যক্ষম চ্যাটবট হিসেবে আলোচিত হচ্ছে চ্যাটজিপিটি। অভিষেকের প্রথম পাঁচ দিনে ১০ লাখের বেশি ব্যবহারকারী পেয়েছে প্ল্যাটফর্মটি।
প্রযুক্তি ভক্তদের এ চ্যাটবট নিয়ে আগ্রহ এত বেশি যে ইতোমধ্যে কয়েকবার সর্বোচ্চ সক্ষমতার চেয়ে বেশি ব্যবহারকারীর চাপে পড়েছে এর সার্ভার।
এআই টুলটির নির্মাতা ‘ওপেনএআই’ এখন আলোচিত হচ্ছে ‘গুগল ঘাতক’ হিসেবে। সার্চ ইঞ্জিনে বিজ্ঞাপন আর পয়সা খরচ করে প্রচার বাড়ানোর কনটেন্টের ভিড়ে প্রয়োজনীয় তথ্য খুঁজে পাওয়া যেখানে বাড়তি ঝক্কি, সেখানে প্রশ্নের উত্তর আস্ত অনুচ্ছেদ আকারে লিখে দিচ্ছে চ্যাটজিপিটি। কিন্তু এই অভূতপূর্ব সক্ষমতার ‘রহস্য’ কী?
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক সাইট সায়েন্স অ্যালার্ট বলছে, গত কয়েক দশকে উন্মুক্ত বিজ্ঞান সাময়িকীতে প্রকাশিত গবেষণা প্রতিবেদন আর প্রযুক্তিগত অগ্রগতির পূর্ণ সদ্ব্যবহার করছে চ্যাটজিপিটি। তবে কোম্পানির নিজস্ব উদ্ভাবনী দিকগুলো নিয়ে মুখে কুলুপ এঁটে রেখেছেন এর নির্মাতারা।
সায়েন্স অ্যালার্ট লিখেছে, ওপেনএআই হয়ত কারিগরি ও ব্যবসায়িক বিবেচনায় আলাদা রাজত্ব প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখছে।
চ্যাটজিপিটির দৌড় কত দূর?
ছড়া চাইলে তা লিখে দেবে চ্যাটজিপিটি। চ্যাটবট প্রযুক্তি নিয়ে রসিকতা শুনতে চান? তাও বানাতে পারে এই চ্যাটবট।
ব্যবহারকারীর প্রয়োজন মত কম্পিউটার কোড লিখে দিতে পারে চ্যাটজিপিটি। ব্যবসায়িক চিঠি, ভাড়া নেয়ার চুক্তিপত্র, ক্লাসের হোমওয়ার্ক, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষাও পাস করিয়ে দিতে পারবে।
কিন্তু সত্যি-মিথ্যার পার্থক্য জানে না এ প্রোগ্রাম। আর একবার মিথ্যা বা ভুল তথ্য দেওয়া শুরু করলে সেটা গ্রহণযোগ্য করে তুলতে লেগে থাকে।
এক্ষেত্রে, চ্যাটজিপিটি খানিকটা হলেও মোবাইল ডিভাইসের অটোকমপ্লিট ফিচারের মত আচরণ করে। প্রকৌশলীরা স্মার্টফোনকে ডিকশনারির সকল শব্দ শিখিয়ে ব্যবহারকারীর লেখা বা শব্দ বা বাক্যের বাকি অংশ লিখে দেওয়ার প্রশিক্ষণ দেন।
আর চ্যাটজিপিটির প্রশিক্ষণে কার্যত পুরো ইন্টারনেট ব্যবহার করেছেন এর নির্মাতারা। ফলে জটিল কোনো বিষয়ে একটি পুরো অনুচ্ছেদ লেখাও চ্যাটবটটির জন্য কঠিন কিছু নয়।
এখানে মনে রাখার বিষয় হচ্ছে, নিজের লেখার অর্থ বোঝার সক্ষমতা নেই এ চ্যাটবটের; কেবল পরবর্তী শব্দটি কী হতে পারে, সেটা আঁচ করার চেষ্টা করে এর এআই।
কেবল নামেই ‘ওপেন’
আগে এআই প্রযুক্তির অগ্রগতিগুলো জনসম্মুখে আসত সমপর্যায়ের বৈজ্ঞানিক গবেষকদের পর্যালোচনার পর সবুজ সংকেত পাওয়া গবেষণা প্রতিবেদন হিসেবে।
উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে ২০১৮ ‘গুগল ব্রেইন টিম’-এর নির্মিত ‘বার্ট নিউরাল নেটওয়ার্ক’ এর কথা। বাজারের সিংহভাগ ‘ন্যাচারাল ল্যাঙ্গুয়েজ প্রোসেসিং সিস্টেম’ ওই এআইটির ভিত্তিতে বানানো।
বার্টের নির্মাণ প্রক্রিয়া গবেষণা প্রতিবেদন আকারে প্রকাশ করেছিলেন এর নির্মাতারা এবং এর কোড ছিল সবার জন্য উন্মুক্ত।
কিন্তু চ্যাটজিপিটির ভেতরের খুঁটিনাটি সযত্নে গোপন রেখেছেন এর নির্মাতারা। এর কার্যপ্রণালীর সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা দিয়ে লেখা একটি ব্লগ পোস্ট ছাড়া বিস্তারিত কিছু তারা জানাননি। বিষয়গুলো গবেষণা প্রতিবেদন আকারে প্রকাশ করা হবে বা কোড উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে– এমন কোনো ইঙ্গিতও কোম্পানি দেয়নি।
নির্মাতা ওপেনএআই-এর এমন লুকোছাপার ব্যাখ্যা মিলতে পারে কোম্পানির ইতিহাস থেকে।
সায়েন্স অ্যালার্ট লিখেছে, সিলিকন ভ্যালি থেকে যাত্রা শুরু করা সবচেয়ে অদ্ভুত কোম্পানিগুলোর একটি ওপেনএআই। ২০১৫ সালে একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে যাত্রা শুরু করা কোম্পানির প্রতিশ্রুতি ছিল ‘সার্বিক মানবসভ্যতার কল্যাণের লক্ষ্যে একটি বন্ধুসুলভ এআই’ নির্মাণ।
শুরুতেই ওপেনএআইয়ের লক্ষ্য অর্জনে সহযোগিতা করতে একশ কোটি ডলার তহবিলের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন ইলন মাস্ক এবং পিটার থিয়েলের মতো প্রভাবশালী প্রযুক্তি উদ্যোক্তারা।
সে সময় তাদের বক্তব্য ছিল, মুনাফার লোভে পরিচালিত কোনো কোম্পানিকে মানবসভ্যতার জন্য ইতিবাচক এআই নির্মাণে বিশ্বাস করা যায় না। তাই, এআইয়ের নির্মাণ হতে হবে অলাভজনক অবকাঠামোতে এবং উন্মুক্ত প্রক্রিয়ায়।
কিন্তু ২০১৯ সালে ‘ক্যাপড-ফর প্রফিট’ কোম্পানিতে পরিণত হয় ওপেনএআই। এ ধরনের কোম্পানির বিনিয়োগকারীরা তাদের বিনিয়োগের বিপরীতে সর্বোচ্চ একশ গুণ আর্থিক সুবিধা নিতে পারেন। এর পরপরই মাইক্রোসফটের কাছ থেকে একশ কোটি ডলারের বিনিয়োগ নিয়েছিল কোম্পানিটি।
এ পরিস্থিতির ব্যাখ্যা দিয়ে সায়েন্স অ্যালার্ট বলছে – সব কিছু বিবেচনায় নিয়ে মনে হচ্ছে, দিন শেষে অর্থসম্পদই ওপেনএআইয়ের ‘উন্মুক্ত’ যাত্রায় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
নির্মাণ প্রক্রিয়ায় পরোক্ষ অংশগ্রহণ
সায়েন্স অ্যালার্ট লিখেছে, সম্ভবত ব্যবহারকারীদের প্রতিক্রিয়ার ভিত্তিতে চ্যাটজিপিটির দেওয়া ভুল উত্তরগুলো মুছে দিচ্ছে ওপেনএআই।
নিজস্ব ব্লগে ওপেনএআই লিখেছে, ভুয়া বা ভুল উত্তর দেওয়া ঠেকাতে কম্পিউটার প্রকৌশলীদের নিজ হাতে নির্মিত ডেটা সেট ব্যবহার করে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে এই বটকে। কিন্ত জনসাধারণের জন্য চালু হওয়ার পর এর ‘টিউন’ করার কাজ সম্ভবত ব্যবহারকারীরাই করছেন।
ভিন্ন কোনো উপায়ে মানব ব্যবহারকারীদের প্রতিক্রিয়ার ভিত্তিতে এআই প্রশিক্ষণ দিতে চাইলে ব্যাপক হারে খরচ করতে হত ওপেনএআইকে।
সোজা কথা বললে, মূল ধারায় গ্রহণযোগ্য বা স্বীকৃত নির্মাণ কৌশলের ওপর নির্ভর করছে না ওপেনএআই। চ্যাটজিপিটির বৈজ্ঞানিক খুঁটিনাটি প্রকাশ করা হচ্ছে না কোনো বিজ্ঞান সাময়িকীতে; মূল ডেটাসেট গোপন রাখা হচ্ছে কোম্পানির ভেতরেই।
আর এ কোম্পানি গুগলের বার্ট নিউরাল নেটওয়ার্ক নকল করছে কি না– এমন সন্দেহের কথাও লিখেছে সায়েন্স অ্যালার্ট।
সামনে কী?
গত এক দশকে এআই প্রযুক্তির অগ্রগতিতে বড় ভূমিকা রেখেছেন শিক্ষাবিদরা এবং বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। বাজারের সবচেয়ে বেশি প্রচলিত এআই টুলগুলোর সবগুলোই কার্যত সবার জন্য উন্মুক্ত প্রযুক্তি নির্ভর।
কিন্তু আরও সক্ষম এআই নির্মাণের প্রতিযোগিতা শুরু হওয়ার সুবাদে সে পরিস্থিতি সম্ভবত পাল্টাতে যাচ্ছে। এ প্রযুক্তি খাতের গতিও হয়ত তাতে কিছুটা কমে আসবে; একইসঙ্গে দৃশ্যপটে আবির্ভাব হতে পারে একাধিক একচেটিয়া ব্যবসার।
ইতিহাস ঘাটলে বলতে হয়, প্রযুক্তি শিল্পে অসাধু আচরণ আর স্বচ্ছতার অভাব দুটোই আসে এক অন্যের হাত ধরে। তাই চ্যাটজিপিটি নিয়ে মাতামাতির মধ্যেই এর পারিপার্শ্বিক বাস্তবতার ওপর সজাগ দৃষ্টি রাখা শ্রেয় হবে বলে সতর্ক করেছে সায়েন্স অ্যালার্ট।
গোটা পৃথিবী কী লুকিয়ে আপনার শরীরেই? প্রশ্ন উঠছে যে ছবি থেকে
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।