নিউক্লিয়ার অস্ত্রের মতো রাসায়নিক অস্ত্রও বিপজ্জনক। পারমাণবিক অস্ত্রগুলো অন্তত সরাসরি দেখা যায়। কিন্তু রাসায়নিক অস্ত্রের ক্ষেত্রে আমরা হয়তো টেরও পাব না, কোন দিক থেকে অস্ত্র এল, আর কীভাবে সবাইকে মেরে রেখো গেল। বিভিন্ন যুদ্ধ ও হত্যাকাণ্ডে রাসায়নিক অস্ত্রের ব্যবহারও কম নয়। আবার এর ধরনও আছে অনেক। তবে এখানে আলোচনা করা হবে ক্লোরিন গ্যাস নিয়ে। এটি বিষ হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
যুদ্ধক্ষেত্রে রাসায়নিক অস্ত্রের ব্যবহার নতুন কিছু নয়। অন্তত প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকেই আধুনিক রাসায়নিক অস্ত্রের ব্যবহার হয়ে আসছে। ইউরোপে বিংশ শতাব্দীর শুরুর সময়টা ছিল অনেক ঘটনাবহুল। ১৯১৪ সালে ইউরোপ দেখতে পায় তখন পর্যন্ত তাদের সবচেয়ে বড় যুদ্ধ—প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। একে বলা হয়েছিল ‘সব যুদ্ধ শেষ করার যুদ্ধ’। এই যুদ্ধেই জার্মান বিজ্ঞানীরা প্রথম রাসায়নিক অস্ত্রের ব্যবহার শুরু করেন।
এই বিজ্ঞানীদের একজন ছিলেন ফ্রিৎস হেবার। তাঁর জন্ম বর্তমান পোল্যান্ডে। তবে তিনি পড়াশোনা করেন বার্লিনে রসায়ন বিভাগে। ওই সময় জার্মানিতে ইহুদিদের অবস্থা ভালো ছিল না। তিনি চাইতেন নিজেকে প্রত্যন্ত অঞ্চলের ইহুদি থেকে সফল জার্মান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ যখন শুরু হয়, তখন তিনি কাজ করতেন বার্লিনের কাইজার ভিলহেম ইনস্টিটিউট অব ফিজিক্যাল কেমিস্ট্রির পরিচালক হিসেবে। নিজেকে খাঁটি দেশপ্রেমিক হিসেবে প্রমাণ করতে তিনি জার্মানির জন্য বিশেষ কিছু করতে চাইছিলেন।
হেবার বিশ্বাস করতেন, মিত্রপক্ষের সেনাদের ট্রেঞ্চ থেকে বিতাড়িত করতে রাসায়নিক অস্ত্র কার্যকর ভূমিকা রাখবে। ফলে জার্মানি খুব সহজেই বিজয়ী হতে পারবে এ যুদ্ধে। সে জন্য তিনি ব্যবহার করতে চাইছিলেন বিষাক্ত ক্লোরিন গ্যাস।
সমস্যা ছিল, এই বিষাক্ত গ্যাস শত্রুপক্ষের ট্রেঞ্চ পর্যন্ত পরিবহন করে নিয়ে যাওয়া। পূর্ববর্তী এক পরীক্ষায় ক্লোরিন গ্যাস ছড়িয়ে দেওয়ার সময় খোদ জার্মানির কয়েকজন সেনা মারা যান। জার্মান সেনা কর্মকর্তারা তাই হেবারের অস্ত্র নিয়ে খুব একটা ইতিবাচক ছিলেন না। কিন্তু ১৯১৫ সালে কয়েকটি ফ্রন্টে পরাজয় ঘটে জার্মানির। তখন জার্মান সামরিক বাহিনীকে রাসায়নিক অস্ত্র ছড়িয়ে দেওয়ার সমস্যা দূর করে মাঠে নামতে হয়।
জার্মান সেনারা তখন কয়েক সপ্তাহ অপেক্ষা করেন উপযুক্ত বায়ুপ্রবাহের জন্য। যেন এ বিষাক্ত গ্যাস জার্মান ট্রেঞ্চ থেকে মিত্রবাহিনীর ট্রেঞ্চে যাওয়ার মতো শক্তিশালী হয় এবং নিজেদের ওপর ছড়িয়ে না পড়ে। হেবার বেলজিয়ামের ইপ্রায় অবস্থিত মিত্রবাহিনীর ট্রেঞ্চে প্রায় ১৬৮ টন ক্লোরিন গ্যাস ছড়িয়ে দেন। এতে একটা সবুজাভ হলুদ দেয়ালের মতো মেঘ সৃষ্টি হয়। আনারস আর মরিচের মিশ্রণের মতো গন্ধের গ্যাসের প্রবাহ চলে যায় মিত্রবাহিনীর সেনাদের দিকে।
প্রথমে এই রঙিন মেঘ দেখে সেনারা ভেবেছিলে, জার্মানদের কোনো ধূম্রজাল। ধোঁয়ার আড়াল নিয়ে হয়তো পদাতিক বাহিনী আসছে আক্রমণের জন্য। কিন্তু ট্রেঞ্চে যখন গ্যাস চলে এল, তখন যা হলো, তার জন্য কেউ প্রস্তুত ছিলেন না। ক্লোরিন বাতাসের চেয়ে ভারী হওয়ায় তা ট্রেঞ্চের গভীরে ঢুকে পড়ে। সৈনিকেরা প্রশ্বাসের সঙ্গে ক্লোরিন গ্রহণ করার সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের বুকে ব্যথা ও গলা জ্বালাপোড়া শুরু হয়। পরে এ আক্রমণের বর্ণনা দেওয়া হয় ‘শুকনো মাটিতে ডুবে মৃত্যু’ হিসেবে।
এ রকম বলার কারণ, তাঁদের তীব্র মাথাব্যথা আর মারাত্মক পিপাসা পাচ্ছিল। কিন্তু পানি পান করলেই মৃত্যু হচ্ছিল তৎক্ষণাৎ। এ ছাড়া তাঁদের ফুসফুসে ছুরির আঘাতের মতো ব্যথা হচ্ছিল। আর কাশির সঙ্গে বেরোচ্ছিল সবুজাভ ফেনা। এককথায় বলা যায়, নির্মম মৃত্যু। ওই আক্রমণে ট্রেঞ্চের প্রায় ১০ হাজার সেনা আক্রান্ত হন। এর মধ্যে প্রায় অর্ধেকই শ্বাসরোধে মারা যান। আর সেটি ঘটে ট্রেঞ্চে ক্লোরিন গ্যাস প্রবেশ করার ১০ মিনিটের মধ্যে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।