এম এম হাসান: বিএনপি ক্ষমতায় নেই দীর্ঘ ১৪ বছর। আর বিরোধী দলেও নেই প্রায় আট বছর। কিন্তু এই দলটির সঙ্গে এখনও সম্পর্ক অটুট রেখেছে পাকিস্তান। সর্বশেষ বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার কাছে আম পাঠিয়ে তা প্রমাণ করেছে পাকিস্তান। গত ২ আগস্ট সন্ধ্যায় খালেদা জিয়ার গুলশানের বাসায় পাকিস্তান হাইকমিশন থেকে পাক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের উপহারের আমের ঝুড়ি পৌঁছে দেওয়া হয়। এতে প্রমাণিত হয় ক্ষমতায় এবং বিরোধী দলে না থাকলেও বিএনপি’র প্রতি পাকিস্তানের ভালোবাসা একটুও কমেনি।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বেশ কয়েকবার মন্তব্য করেছেন যে, বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী ‘আপন মায়ের পেটের ভাই’। তার এই মন্তব্য দেশের প্রধান প্রধান দৈনিক পত্রিকায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হেডলাইন হয়েছে প্রতিবারই। আমরাও মনে-প্রাণে বিশ্বাস করি, প্রকৃত প্রস্তাবে বিএনপি-জামায়াত দুটি দলই পাকিস্তানের মতাদর্শে বিশ্বাসী খাঁটি পাকিস্তানপ্রেমী রাজনৈতিক দল।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট নারকীয় হত্যাযজ্ঞের মাধ্যমে সামরিক বাহিনীর নরঘাতকরা বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতা জবরদখল করে খোন্দকার মোশতাকের অবৈধ সরকারের মাধ্যমে বাংলাদেশকে আবার পাকিস্তান বানানোর যে এজেন্ডা বাস্তবায়িত করেছিল, তারই ধারাবাহিকতা বজায় রাখার প্রাণপণ প্রয়াস চলেছিল জিয়াউর রহমানের পাঁচ বছর সাত মাস ২৩ দিনের অবৈধ শাসনামলে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের ওই রক্তলোলুপ সামরিক অভ্যুত্থান যে স্বাধীন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের যাবতীয় গৌরবগাথা ও অর্জনকে পরিত্যাগ করে এ দেশে আবার ১৯৭০ সালের ঐতিহাসিক নির্বাচনে পরাজিত পাকিস্তান মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী ও নেজামে ইসলামকে এ দেশের রাজনীতিতে পুনর্বাসনের সুযোগ সৃষ্টি করেছিল এবং স্বাধীনতাবিরোধী ব্যক্তিদের বাংলাদেশের রাজনীতিতে পুনর্বাসিত করেছিল, সেটা বুঝতে এখন আর কারও অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। যদিও জিয়াউর রহমান ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেছিলেন, তবুও পরবর্তীকালে তার শাসনামলে তার পাকিস্তানি সত্তার বহিঃপ্রকাশ এত প্রকটভাবে ঘটেছে যে, তার পুরো শাসনামলেই বাংলাদেশে চরম দক্ষিণপন্থি পাকিস্তানপ্রেমী রাজনীতি দোর্দণ্ড প্রতাপে রাজত্ব করেছিল বলা চলে।
একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম তাঁর এক কলামে জিয়ার পাকিস্তানি সত্তার ১১টা প্রমাণ হাজির করেছিলেন। জিয়ার পাকিস্তানি সত্তার ১১টা প্রমাণ হলো-
১. জিয়া বাংলাদেশে স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ ও নেজামে ইসলামের মতো দলকে বাংলাদেশে পুনর্বাসন করে গেছেন।
২. ১৯৭৮ সালে মাকে দেখতে আসার নাম করে জিয়ার অনুমতি নিয়ে গোলাম আযম পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে চলে এসেছিলেন। প্রায় তিন বছর অবস্থানের পরও জিয়া এ ব্যাপারে কোনো আইনগত ব্যবস্থা নেননি।
৩. জিয়া তার শাসনামলে বিভিন্ন অভিযোগে কয়েক হাজার মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করেছিলেন।
৪. জিয়া সব কুখ্যাত স্বাধীনতাবিরোধী ঘাতক-দালালকে বিএনপিতে যোগদান করার সুযোগ দিয়েছিলেন।
৫. জিয়া সব চিহ্নিত স্বাধীনতাবিরোধী সরকারি আমলা-কর্মকর্তা, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, প্রকৌশলী, ডাক্তার, পেশাজীবী ও সামরিক কর্মকর্তাকে চাকরিতে পুনর্বাসন করেছিলেন।
৬. জিয়া সব প্রচারমাধ্যমে ‘পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী’র পরিবর্তে শুধুই ‘হানাদার বাহিনী’ বলার নির্দেশ জারি করেছিলেন।
৭. জিয়া দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে থাকা বধ্যভূমি, অগ্নিসংযোগ, শরণার্থী ক্যাম্প ও গণহত্যার চিত্র মিডিয়ায় প্রচার বন্ধ করে দিয়েছিলেন।
৮. পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের ন্যায্য হিস্যা আদায়ের ইস্যুকে জিয়া কখনোই কূটনৈতিক নীতিতে অগ্রাধিকার দেননি।
৯. বাংলাদেশে আটকে পড়া বিহারিদের ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য পাকিস্তানের ওপর জিয়া যথাযোগ্য চাপ সৃষ্টি করেননি।
১০. জিয়া দেশের সব স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিসৌধ নির্মাণ কাজ বন্ধ করে দিয়েছিলেন। এমনকি সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধ নির্মাণ এবং কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার পুনর্নির্মাণ কাজও তার আমলে পরিত্যক্ত হয়েছিল।
১১. জিয়া ঘাতক-দালালদের বিচার সংক্রান্ত সব আইন বাতিল করে দেওয়ায় জেলে আটক প্রায় ১১ হাজার স্বাধীনতাবিরোধীকে আর বিচারের সম্মুখীন করা যায়নি।
ওই লেখায় ড. মইনুল ইসলাম উল্লেখ করেছেন, জিয়াউর রহমান তার এহেন পাকিস্তানপ্রেমী রাজনীতিকে ব্যালেন্স করার জন্য মশিউর রহমান যাদু মিয়ার মাধ্যমে ক্রয় করা বামপন্থি রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের বিরাট সমাবেশ ঘটিয়েছিলেন বিএনপিতে। তার তথাকথিত ‘সমন্বয়ের রাজনীতি’র নামে ‘কেনাবেচার রাজনীতি’তে ক্রয়-বিক্রয়ের মাধ্যমে জড়ো হওয়া ভাসানী-অনুসারী বিরাট সংখ্যক ‘বামপন্থি বিপ্লবী’ নেতাকর্মীদের কারণে জিয়াউর রহমানের এই মুক্তিযুদ্ধবিরোধী, চরম দক্ষিণপন্থি রাজনৈতিক চরিত্র আড়াল করায় বেশ সুবিধা হয়ে গিয়েছিল। এই ‘একদা-বামপন্থি’ নেতাকর্মীরা এখনও বিএনপির রাজনীতিতে একেবারে অপাঙ্ক্তেয় হয়ে গেছেন, বলা যাবে না। এ ধরনের বেশ কয়েক নেতা খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের আস্থাভাজন হয়ে এখন বিএনপির নীতিনির্ধারণী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় উত্তীর্ণ হয়েছেন।
বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ারও চিন্তা-চেতনা ও মননে যে ‘পাকিস্তান প্রীতি’ রয়েছে সেটা বিভিন্নভাবে প্রমাণিত হয়েছে। ‘পাকিস্তান প্রেম’ তিনি কখনই ভুলতে পারেননি! ভুলতে পারেননি বলেই ব্রিগেডিয়ার জানজুয়া যখন মারা যায়, তার মৃত্যুতে শোক বিহ্বল হয়ে প্রধানমন্ত্রীর প্রটোকল ভেঙ্গে ‘বন্ধুর জন্য’ শোক বার্তা পাঠিয়েছিলেন খালেদা জিয়া। প্রধানমন্ত্রীর কী অবমাননা! দেশবাসী ও রাষ্ট্র সেদিন নিমজ্জিত হয়েছিল লজ্জায়। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানীদের সঙ্গে থেকে যাওয়ার স্মৃতি তিনি মন থেকে মুছে ফেলতে পারেননি।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।