ডা. মুশতাক হোসেন: প্রায় দেড় বছর পর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। কভিড-১৯ সংক্রান্ত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি শিক্ষাঙ্গন খুলে দেওয়ার পক্ষে মত দেওয়ায় সরকার এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কয়েক দিন ধরেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার ব্যাপারে সংশ্নিষ্ট মন্ত্রণালয়কে প্রস্তুতি নেওয়ার তাগিদ দিচ্ছিলেন। ২ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদে এক আলোচনায় অংশ নিয়ে পুনর্বার তিনি জানান, দ্রুত শিক্ষাঙ্গন খোলার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তিনি এও জানিয়েছেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা মেনে শিক্ষার্থীদের টিকা দেওয়ার ব্যবস্থাও হচ্ছে। বিভিন্ন সূত্র থেকে ইতোমধ্যে টিকা পাওয়া এবং আরও টিকা আসার সম্ভাবনার বিষয়টিও তিনি অবহিত করেন। আমরা বরাবরই সমগ্র জনগোষ্ঠীকে টিকার আওতায় আনার ব্যাপারে গুরুত্ব দিয়ে আসছি। কিন্তু এ কথাও মনে রাখতে হবে, টিকা দেওয়ার পরও কেউ কেউ করোনা আক্রান্ত হয়েছেন। তবে টিকা নেওয়ার কারণে জটিল পরিস্থিতিতে তারা পড়েননি।
দফায় দফায় ছুটি বাড়িয়ে শিক্ষাঙ্গন বন্ধ রাখার কারণ ছিল সংক্রমণ ঠেকানো। শিক্ষাঙ্গন অধিক জনঅধ্যুষিত ক্ষেত্র। দেশে করোনার সংক্রমণ ও মৃত্যুহার দুই-ই এখন নিম্নমুখী। তবে সংক্রমণ হার এখনও ১০ শতাংশের ওপরে থাকলেও গতিটা নিচের দিকে। আশা করা যায়, যথাযথভাবে স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ ও সচেতনতা-সতর্কতায় আমরা কাঙ্ক্ষিত ফল পাব। শিক্ষাঙ্গন ১২ সেপ্টেম্বর খোলার এখন পর্যন্ত সিদ্ধান্ত থাকলেও ক্লাস ও শিক্ষাঙ্গনের আনুষঙ্গিক কার্যক্রম হয়তো কিছুদিন সীমিত পরিসরেই চলবে। যেহেতু শিক্ষাঙ্গন ঘন জনঅধ্যুষিত ক্ষেত্র, সেহেতু সর্বাবস্থায় গুরুত্ব দিতে হবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলায়। আগেও বলেছি, মাস্ক ‘সামাজিক ভ্যাকিসন’।
কাজেই শিক্ষাঙ্গন তো বটেই, সর্বক্ষেত্রে মাস্কের ব্যবহার বাধ্যতামূলক থাকতে হবে। একই সঙ্গে প্রতিটা শিক্ষাঙ্গনের শ্রেণিকক্ষসহ সব জায়গায় সামাজিক দূরত্ব যাতে বজায় থাকে; গুরুত্ব দিতে হবে এর ওপরেও। পাশাপাশি সাবান দিয়ে হাত ধোয়া ও হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহারেও সজাগ থাকতে হবে। প্রত্যেক শিক্ষার্থীর সঙ্গে শ্রেণিকক্ষ, শিক্ষাঙ্গনের ফটকেও স্বাস্থ্যবিধির সব সূত্র অনুসরণের বিকল্প নেই।
আমরা জানি, করোনাভাইরাস বিশ্বব্যাপী যে তাণ্ডব ঘটিয়েছে, এর ফলে সৃষ্ট বহুবিধ ক্ষত উপশমের বিষয়টি সহজ নয়। আমরাও এর বাইরে নই। শিক্ষাক্ষেত্রে ক্ষতিও হয়েছে ব্যাপক। আমরা ক্রমেই যখন স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসছি, তখন শিক্ষাঙ্গনের দরজা বন্ধ রেখে ক্ষতির চিত্রটা আরও স্ম্ফীত করার পথ রুদ্ধ করতেই হবে। শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের ফেরানো জরুরি হয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় মূল রক্ষাকবচ হলো স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ। এ ক্ষেত্রে বিন্দুমাত্র ছাড় দিলে চলবে না। একই সঙ্গে আরও জরুরি কিছু করণীয় রয়েছে। সরকার নির্দেশিত পথে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ স্বাস্থ্য সুরক্ষার ব্যাপারে ইতোমধ্যে বেশকিছু ব্যবস্থা নিয়েছে।
তবে শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের একার পক্ষে স্বাস্থ্য সুরক্ষার সব ব্যবস্থা নিশ্চিত করা সম্ভব না। ধরা যাক রোগী শনাক্তকরণ বিষয়। শিক্ষার্থী, শিক্ষকসহ প্রতিষ্ঠান-সংশ্নিষ্ট সবাই যাতে সহজে পরীক্ষা করাতে পারেন, এ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা দরকার। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভেতরে এ জন্য বুথ থাকা উচিত। এই বুথ আশপাশের কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান একত্র হয়েও করতে পারে। যদি করোনা পজিটিভ কাউকে পাওয়া যায়, তাহলে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় আইসোলেশন ও কোয়ারেন্টাইন- এ দুয়েরই ব্যবস্থার কথা ভাবতে হবে। সবাই তো গুরুতর অসুস্থ হবে না। যারাই শনাক্ত হবে, প্রাথমিক পর্যায়ে থেকেই তাদের জন্য ব্যবস্থা নিশ্চিত করা জরুরি।
বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে এ ব্যাপারে বিশেষ নজর দিতে হবে। শনাক্তকরণ ও শনাক্ত রোগীর ব্যবস্থার বিষয়টি রাখতে হবে এক নম্বরে। এরই সঙ্গে স্বাস্থ্যবিধির প্রতি সার্বক্ষণিক গুরুত্বদান জরুরি। পর্যাপ্ত মাস্কের ব্যবস্থা রাখাও বাঞ্ছনীয়। সে ক্ষেত্রে সুতি কাপড়ের মাস্কই শ্রেয়, যা বারবার ধোয়া সহজ। শ্রেণিকক্ষে নির্দিষ্ট শারীরিক দূরত্বের পাশাপাশি এক শ্রেণিকক্ষের শিক্ষার্থীরা যাতে অন্য শ্রেণিকক্ষের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মেলামেশা না করে, এর ওপরেও গুরুত্ব দিতে হবে। যেসব শিক্ষার্থী বাসা থেকে যাওয়া-আসা করবে, তাদের পরিবারের সদস্যদেরও নিয়মকানুনের মধ্যে জীবনযাপন করতে হবে।
টিকার ব্যাপারে সরকার যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েছে। কিন্তু শুধু শিক্ষার্থীদের টিকা দিলেই হবে না, তাদের পরিবারের সদস্যদেরও টিকা দিতে হবে। তাহলে সুরক্ষার বিষয়টি অনেকাংশে নিশ্চিত করা সম্ভব। শিশুদের টিকার বিষয়টি আলোচনায় এসেছে। ইতোমধ্যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কোনো কোনো দেশে এর অনুমোদন দিয়েছে। আমরা যদি তা সংগ্রহের ব্যবস্থা জোরদার করি, তাহলে ভালো। স্বাস্থ্যবিধির ওপরেই জোর দিতে হবে সর্বাগ্রে। এরপর পর্যায়ক্রমে যাতে সবাই টিকা পান সে বিষয়ও আমলে রাখা গুরুত্বপূর্ণ।
তবে টিকা দেওয়া মানেই কিন্তু নিরাপদ হয়ে যাওয়া নয়। কাজেই স্বাস্থ্যবিধির ব্যত্যয় ঘটানো মানে নিজেকে ঝুঁকির মুখে ঠেলে দেওয়া। শিশুরাও যেন স্বাস্থ্যবিধি মেনে শিক্ষাঙ্গনে যাওয়া-আসা করে, এর দায় অভিভাবকদের। শিক্ষাঙ্গনে শিশুদের স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণের দায়িত্ব কর্তৃপক্ষের। কারণ শিশুরা অনেক কিছুই বোঝে না। তাই তাদের দিকে দায়িত্বশীলদেরই বাড়তি নজর রাখতে হবে। তবে এও মনে রাখা দরকার, শিশুদের মাধ্যমে সংক্রমণ খুবই কম ছড়ায়। তাদের সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকিও তুলনামূলক কম। যারা শিশুদের প্রতিষ্ঠানে দিয়ে ছুটি না হওয়া পর্যন্ত নিয়ে আসার জন্য অপেক্ষা করেন, সেই অভিভাবকদের সতর্কতার বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। একসঙ্গে বসে আড্ডা দেওয়া যাবে না। অর্থাৎ স্বাস্থ্যবিধির লঙ্ঘন ঘটে এমন কিছুই করা যাবে না।
শিক্ষাঙ্গনের কর্তৃপক্ষের জন্যও একই কথা প্রযোজ্য। শ্রেণিকক্ষসহ শিক্ষাঙ্গনের যেসব ক্ষেত্রে শিক্ষার্থী-শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগাযোগ নিবিড়, সেসব ক্ষেত্র যাতে জীবাণুমুক্ত ও পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন থাকে; নজর বাড়াতে হবে সেদিকেও। ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বেড়েছে। ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী এডিস মশার উৎস নির্মূলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে করণীয় সবকিছুই করতে হবে।
যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যত ছোট, সেখানে তৎপরতা জরুরি। কারণ তাদের সামর্থ্য কম। তাদের ক্ষেত্রে প্রশাসন, স্থানীয় জনগণ সবারই তুলনামূলক বেশি সহায়তা লাগবে। কমিউনিটি সাপোর্ট অবশ্যই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দীর্ঘদিন পর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুললে অনেক সমস্যাই দৃশ্যমান হবে। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনমাফিক বিনিয়োগ করতে হবে। এ ব্যাপারে কার্পণ্য দেখানো চলবে না। মনে রাখা দরকার, স্বাস্থ্য ও শিক্ষায় বিনিয়োগ আমাদের জাতীয়ভাবে সুফল দেবে। করোনা ও ডেঙ্গু- এ দুই বিপদ সঙ্গে রেখে শিক্ষাঙ্গন খুলছে। এ জন্য ব্যবস্থাপনায় খরচ বাড়বে। এই খরচ সংকুলান করা যাদের পক্ষে কঠিন হবে, তাদের দিকেই বাড়াতে হবে সহযোগিতার হাত। এক কথায়, সব হাত করতে হবে একত্রিত।
আমরা যে মহামারির মধ্য দিয়ে, ক্ষয়ের মধ্য দিয়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছি, সেখানে যূথবদ্ধ প্রয়াসের বিকল্প নেই। আমাদের বেদনাবিধুর অভিজ্ঞতা থেকেই আগামী দিনের সব ব্যবস্থা নিশ্চিত করার পথে হাঁটতে হবে। এও মনে রাখতে হবে, দুর্যোগ আবারও যাতে হানা দিতে না পারে, এ ব্যাপারে প্রতিরোধমূলক সবকিছু করতে হবে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে।
হাল ছেড়ে দেওয়া যাবে না। কীভাবে মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমণ বন্ধ করা যায়- এ পদ্ধতি ও বিজ্ঞান আমাদের জানা। শিক্ষাঙ্গন খোলার পর যদি সংক্রমণ বাড়ে তাহলে অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নেওয়া যাবে। কিন্তু এখন শিক্ষাঙ্গন খুলে দেওয়াটা খুবই জরুরি। তবে এলাকাভিত্তিক সংক্রমণের হার পর্যবেক্ষণে রাখা প্রয়োজন মনে করি। যদি দেখা যায়, কোনো এলাকায় সংক্রমণের হার বেশি বা বাড়ছে, তখন সে এলাকায় অবস্থিত শিক্ষাঙ্গনগুলো নিয়ে ভাবতে হবে। সব রকম প্রস্তুতিই রাখতে হবে। জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় ব্যক্তির দায়ও কম নয়- এটি ভুলে না গেলেই মঙ্গল।
লেখক: রোগতত্ত্ববিদ; সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর)
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।