জুমবাংলা ডেস্ক : ইলিশ সম্পদ বৃদ্ধির সোনালি বছর ছিল ২০১৬ সাল– এমনটাই দাবি মৎস্য অদিপ্তরের। তাদের তথ্যমতে, আগের কয়েক বছরের সংকটের অবসান ঘটিয়ে ২০১৬-১৭ সালে শুধু দক্ষিণাঞ্চলের নদী-সাগরে ২ লাখ ৫৮ হাজার টন ইলিশ আহরণ করা হয়। এটা ছিল ১০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। মৎস্য অধিদপ্তরের দাবি, গত ১০ বছরের বৃদ্ধির ধারাবাহিকতায় দেশে ইলিশ উৎপাদন বেড়েছে ১১২ ভাগ বা দ্বিগুণের বেশি।
দৈনিক সমকাল পত্রিকার সুমন চৌধুরীর স্পেশাল রিপোর্ট থেকে জানা যায়, ইলিশ নিয়ে মৎস্য বিভাগের গত কয়েক বছরের এসব পরিসংখ্যান এ বছর সাধারণ মানুষের কাছে ফিকে হয়ে গেছে। কাগজে হাজার হাজার টন ইলিশ আহরণ দেখানো হচ্ছে। তবে তা সাধারণ মানুষের নাগালে বাইরে। সব রেকর্ড ভঙ্গ করে এ বছর এক কেজি সাইজের মাছ দুই হাজার টাকার নিচে মিলছে না। উৎপাদন দেড় গুণ বৃদ্ধির পর দাম কেন তিন গুণ হলো– এর সদুত্তর মিলছে না কোথাও। অনেকে বলছেন, মাছের রাজা ইলিশ এখন রাজাদের খাবারেই পরিণত হয়েছে।
দাম বৃদ্ধিতে ইলিশ-সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা দেখাচ্ছেন নানা অজুহাত। তাদের প্রধান অজুহাত তিনটি। প্রথমত, চলতি মৌসুমে সাগরে পাওয়া গেলেও নদীতে ইলিশ নেই। এ জন্য সাগরের মোহনায় নাব্য সংকটকে দুষছেন তারা। দ্বিতীয়ত, জ্বালানিসহ দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় সাগরের গভীরে গিয়ে ইলিশ আহরণে ব্যয় দ্বিগুণ হয়েছে। তৃতীয়ত, পদ্মা সেতুর কারণে পরিবহন সহজ হওয়ায় দেশের ইলিশ বাজার আরও সম্প্রসারিত হয়েছে। ফলে চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় দামও বেড়েছে।
ফাল্গুন-চৈত্র মাসে জাটকা বা ইলিশের বাচ্চার বেপরোয়া আহরণকেও দায়ী করেন অনেকে। এ কারণে চলতি মৌসুমে উৎপাদন কমেছে বলে দাবি করছেন জেলে ও ইলিশ ব্যবসায়ীরা। তবে মৎস্য অধিদপ্তরের দায়িত্বশীলরা এ অজুহাত মানতে নারাজ। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এসব অজুহাত ছাড়াও প্রধান মোকামগুলোতে অতি মুনাফালোভী আড়তদারদের কারণেও ইলিশের দাম সাধারণ মানুষের নাগালে নেই। স্থানীয়ভাবে বাজারজাত করার চেয়ে রাজধানীতে ইলিশ সরবরাহে বেশি আগ্রহী তারা।
দক্ষিণাঞ্চলে পাইকারি ইলিশের বড় তিনটি মোকাম বরিশাল নগরীর পোর্ট রোড, বরগুনার পাথরঘাটা ও পটুয়াখালীর আলীপুর-মহিপুরে ইলিশ-সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য মিলেছে। বঙ্গোপসাগরের তীরে পাথরঘাটা সরকারি মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মোকাম। সেখানকার বিপণন কর্মকর্তা বিপ্লব কুমার ২০১৯ সাল থেকে চাকরি করছেন।
এ বছর ইলিশের দাম নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করে বিপ্লব কুমার বলেন, পাথরঘাটা থেকে প্রতিদিন সাত-আট ট্রাক ইলিশ দেশের বিভিন্ন স্থানে যাচ্ছে। দুই হাজার টাকা কেজি দরে ইলিশ কারা কিনে খাচ্ছেন, এ নিয়ে তিনিও বিস্মিত।
বিপ্লব কুমার বলেন, দামের জন্য পাথরঘাটার স্থানীয়দের তিনি খুব একটা ইলিশ কিনতে দেখছেন না।
তিনি জানান, কেজি সাইজের ইলিশ পাইকারি বিক্রি হচ্ছে গড়ে প্রতি কেজি ১ হাজার ৮০০ টাকা। দুই-তিন হাত বদল হয়ে রাজধানীতে ওই মাছের দাম হয় আড়াই হাজার টাকা। গত বছর পুরো মৌসুমে একই সাইজের ইলিশের পাইকারি দাম ছিল ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২৫০ টাকার মধ্যে। বিপ্লবের মতে, এক বছরে দাম দ্বিগুণ হওয়ার যৌক্তিকতা নেই। মূলত পদ্মা সেতু চালুর পর দক্ষিণের প্রতিটি উপকূল থেকে রাজধানীর সরাসরি সড়ক যোগাযোগ হয়েছে। ফলে উপকূল থেকে ইলিশ রাজধানী হয়ে দেশের বিভিন্ন জেলায় ছড়িয়ে পড়ায় চাহিদা অনেক বেড়ে গেছে। তা ছাড়া আহরণ খরচও বেড়েছে। পাঁচ বছর আগেও ১০ দিনের জন্য সাগরে যাওয়া একটি ট্রলারের সব মিলিয়ে খরচ হতো ৫০ হাজার টাকা। এ বছর চার লাখ টাকার নিচে হচ্ছে না।
পাথরঘাটা মোকামের ইলিশ ক্রেতা আল আমিন জানান, ঘরের ছোট সন্তানদের এক দিনের জন্য সান্ত্বনা দিতে ইলিশ কিনতে এসেছেন। কেজি চাওয়া হচ্ছে ১ হাজার ৮০০ থেকে দুই হাজার টাকা। জাটকা (১০ ইঞ্চির কম) ৬০০ টাকা। এ বছর দ্বিতীয়বার ইলিশ কিনতে পারবেন না বলে তাঁর মনে সংশয়।
ইলিশ ধরার একটি ট্রলারের মালিক মোঃ আলী জানান, এ বছর মৌসুম শুরুর পর একটি ট্রলার আটবার সাগরে পঠিয়েছেন। প্রতিবার ট্রলারে ১০-১২ দিনের বাজার ও জ্বালানিসহ চার লাখ টাকা খরচ হয়। গত বছর খরচ হতো দুই লাখ টাকা। আয় বাড়েনি, শুধু ব্যয় বাড়ছে।
পাথরঘাটা পাইকার সমিতির সাধারণ সম্পাদক আব্বাছ উদ্দিন জানান, মাঝিমাল্লাদের বেতন বৃদ্ধি ও পরিবহন খরচ বেড়েছে। বরফ, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও নিত্যপণ্যের দামের কারণে ইলিশের দামও বেশি। ভবিষ্যতে নিত্যপণ্যের দাম বাড়লে ইলিশের দামও বাড়বে। গরিবের কপালে আর ইলিশ জুটবে না।
পটুয়াখালীর আলিপুর বন্দরের ভাই ভাই ফিশের পরিচালক মোঃ মিজান বলেন, চলতি মৌসুমে গত সপ্তাহে মাত্র চার দিন বেশি ইলিশ ধরা পড়েছে। যে পরিমাণ ইলিশ পাওয়া গেছে, চাহিদা ছিল তার কয়েক গুণ বেশি।
সবচেয়ে খারাপ অবস্থা দক্ষিণাঞ্চলের অন্যতম বড় মোকাম বরিশাল নগরীর পোর্ট রোডে। কয়েক বছর ধরে এ মোকামে ইলিশ আমদানি ক্রমে কমছে। এ কারণে অন্য মোকামের তুলনায় এখানে ইলিশের দামও বেশি। একাধিক ইলিশ ব্যবসায়ী জানান, পোর্ট রোড মোকাম সাত-আট বছর ধরে নিয়ন্ত্রণ করছেন মহানগর আওয়ামী লীগের শিল্পবিষয়ক সম্পাদক নিরব হোসেন টুটুল। ট্রলার আসার পর পাইকারি বিক্রির ডাকে তিনি দর বলার পর অন্য ব্যবসায়ীরা কিছু বলার সাহস দেখান না। ফলে বাজারদরের চেয়ে কম দামে বিক্রি করতে বাধ্য হওয়ায় জেলেরা এ মোকাম থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন।
বরিশালের মৎস্য সম্প্রসারণ কর্মকর্তা (ইলিশ) ড. বিমল চন্দ্র দাস বলেন, পাঁচ বছর আগেও এই সময়ে বরিশাল মোকামে এক দিনে দুই হাজার মণ ইলিশ আমদানির নজির রয়েছে। এ বছর এক দিনে সর্বোচ্চ ইলিশ এসেছে ৩০০ মণ।
বরিশালে ইলিশ সংকটের প্রমাণ মিলেছে মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্যে। চলতি মাসের প্রথম ১৫ দিনে বরিশালে মোট ইলিশ বেচাকেনা হয়েছে ৭১১ টন। গত বছর একই সময়ে এর পরিমাণ ছিল ২ হাজার ৯৩৭ টন।
পোর্ট রোড মোকামে ইলিশ কম আসার পেছনে ড. বিমলের যুক্তি হলো, সাগরতীরের মোকাম পাথরঘাটা ও আলীপুর-মহীপুর থেকে রাজধানীর সরাসরি সড়ক যোগাযোগ হয়েছে। সাগর থেকে ট্রলার পোর্ট রোড মোকামে পৌঁছাতে অতিরিক্ত ২০০ লিটার জ্বালানি ব্যয় হয়। তাই জেলেরা কাছাকাছি থাকা পাথরঘাটা এবং আলীপুর-মহীপুরে যাচ্ছেন। ড. বিমল জানান, নদীতে ইলিশ আসতে শুরু করেছে। কয়েক দিনের মধ্যেই অবস্থার উন্নতি হবে বলে তিনি আশাবাদী।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।