নিজস্ব প্রতিবেদক: রাজধানীর অনেক বাজার ও দোকানে গরুর মাংস প্রতি কেজি ৬০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বিক্রি হচ্ছে ৫৯৫ টাকা কেজিতেও। তবে কম দাম দিয়ে এই মাংস কিনে ভয়াবহ প্রতারণার শিকার হচ্ছেন ক্রেতারা।
ক্রেতারা জানিয়েছেন, ৫৯৫ টাকা অথবা ৬০০ টাকা কেজিতে তারা যে মাংস কিনছেন তার প্রায় অর্ধেকেই চর্বি, হার ও ছাটাছুটা-যেগুলো খাওয়ার অযোগ্য। ফলে কম দামে মাংস কিনে ঠকছেন তারা।
রাজধানীর দক্ষিণ বনশ্রীর বাসিন্দা লাকি খান। তিনি জুমবাংলাকে বলেন, ‘মতিঝিলের অফিস থেকে বাসায় ফেরার সময় কয়েকদিন থেকে দেখি শাহজাহানপুরের খলিল গোস্ত বিতানের সামনে ৫৯৫ টাকা কেজিতে মাংস কেনার জন্য লম্বা লাইন। সোমবার আমিও সেখান থেকে চার কেজি মাংস কিনি। কিন্তু বাসায় এসে মাংস ফ্রিজে রাখার জন্য বাছাই করতে গিয়ে আমার চক্ষু চড়কগাছ! চার কেজি মাংসের অর্ধেকেরও বেশি চর্বি ও হার। মাংস কিনে জীবনেও এমন ঠকা ঠকিনি।’
লাকি খান আরও বলেন, ‘খলিল গোস্ত বিতানে ৫৯৫ টাকায় গরুর মাংস বিক্রি একটি ভয়াবহ ‘প্রতারণার ফাঁদ’। কম দামে মাংস কিনতে গিয়ে আমার মতো অন্য ক্রেতারাও ঠকছেন।’
খলিল গোস্ত বিতান থেকে মাংস কিনে ঠকেছে খিলগাঁওয়ের বাসিন্দা ব্যাংকার মহিউদ্দীন আহমেদ। তিনি জুমবাংলাকে বলেন, ‘খলিল গোস্ত বিতান থেকে দুই কেজি মাংস কিনে এক কেজির মতো চর্বি ও হাড় পেয়েছি। একেই বলে সস্তার বারো অবস্থা। এটা ক্রেতাদের সঙ্গে এক ধরণের প্রতারণা।’
মালিবাগে খোরশেদ গোশত বিপণি থেকে ৬০০ টাকা কেজিতে মাংস কিনে ঠকে ফেসবুক পোস্টে বিস্তারিত লিখেছেন সাহাদাত উদরাজী নামে একজন ক্রেতা।
তিনি লিখেছেন, ‘সন্ধ্যায় বাসায় ফেরার পথে মহল্লার গোশত বিক্রেতা খোরশেদের দোকানে দেখি বিশাল ভীড়, সে ৬০০ টাকা কেজিতে গত কয়েকদিন ধরে মাইক লাগিয়ে গরুর গোশত বিক্রি করছে। অনেকদিন গরুর গোশত কিনি নাই, ফলে ইচ্ছা হলো, আজ দুই কেজি কিনি, দুই দিন চলে যাবে এবং আজ যেহেতু জলদি বাসায় ফিরছি, ফলে আমি নিজেই আজ রাতের খাবারের জন্য গরুর গোশত রান্না করবো।
লাইন ধরে দোকানের কাছে গিয়ে যা দেখলাম, কোরবানীর গোশতের মত করে কেটে টাল করে রাখা, একদাম ৬০০, একদাম ৬০০ করে বলছে এবং যে যত কেজি চাইছে সেখান থেকে মেপে দিয়ে দিচ্ছে। গোশতের টাল দেখেই আমার সন্দেহ হয়েছিল এবং বেশ চর্বি, হাড্ডি মেশানো আমি বুঝতে পারছিলাম, যেহেতু গোশত কেনা ও রান্না থেকেই এইসব অভিজ্ঞতা লাভ হয়েছে! যাই হোক, যেহেতু এসেছি এবং বাসায় কথা দিয়েছি, ফলে ১২০০ টাকায় দুই কেজি কিনেই ফেললাম!
বাসায় এসে স্ত্রীকে গোশত সাফ ও ধুয়ে দিতে অনুরোধ করলাম, তিনি আরো মহা অভিজ্ঞ, গোশত দেখেই জানালেন, এখান থেকে কিনলে কেন, এরা তো চর্বি আর হাড্ডি ছাড়া গোশত তেমন দেয়ই না, আর ৬০০ টাকায় কি করে গোশত বিক্রি করছে। তিনি আরো জানালেন, ছোট ছেলেকে স্কুলে দিয়ে আসতে তিনিও কেনার কথা ভাবছিলেন, দেখে কেনেন নাই!
যাই হোক, দুই কেজি গোশতে রাখার মত পরিস্কার করে তিনি আমার সামনে দিলেন, আমি দেখে চুপ করে গেলাম, নিজে ঘেটে দেখলাম, তিনি অনেক বিশ্রী চর্বি হাড্ডি ফেলার পরেও অনেক চর্বি হাড্ডি রেখেছেন, যা আমার কাছে মিলিয়ে মনে হল ১৩০০/১৪০০ গ্রাম হতে পারে, মানে দুই কেজিতে ৬০০/৭০০ গ্রাম নেই!
যাই হোক ভেবেছিলাম, দুই কেজিতে দুই দিন পার হবে, মনে হল না, এর এতটূকু গোশতের আবার কি করে দুই ভাগ করি! পুরোটাই রান্নায় বসালাম। রান্নার মাঝ পথে একটা ছবি দিলাম দেখেন, হাড্ডি আর চর্বিই, স্থুল গোশত দুই কেজিতে ৫০০/৬০০ গ্রাম হতে পারে মাত্র (আমার চোখের অনুমান), পাতিলের তলায় স্থুল গোশত তেমন নেই। রান্নার এই মাঝ পথে হাড্ডি ও চর্বি উপরে উঠে আসছে, যা দেখে আমি বার বার দুঃখ পাচ্ছি।
এখন আসেন খোরশেদ গোশত বিতান কি করে ৬০০ টাকায় কেজিতে গোশত বিক্রি করছে। আমার ধারনা সে যা করেছে, পুরা গরু কেটে প্রথমে ভালো ভালো গোশতের জায়গাগুলো থেকে ভাল গোশত সরিয়ে নিয়েছে এবং তা অধিক দামে তেহারি দোকান গুলোতে বিক্রি করেছে বা বড় বড় হোটেলে সাপ্লাই বা বিক্রি করেছে বা করবে! এর পরে যা হাড্ডি চর্বি দূর্বল জায়গার গোশত ফফশা, কলিজা গুর্দা মাথা বড় হাড্ডি সব মিলিয়ে কেটে স্তূপ করে ৬০০ টাকা কেজিতে বিক্রি করছে। স্তূপের উপরে সামান্য কিছু ভাল গোশত রাখছে আর তলা থেকে টেনে টেনে হাড্ডি চর্বি মিশিয়ে ক্রেতাদের ২/৪/৬ কেজি করে বিক্রি করে ফেলছে!
বিষয়টা আশা করি বুঝতে পারছেন, মানে ক্রেতাদের প্রতারিত করছে এই খোরশেদ। আপনি আগে ৮০০ টাকার কেজিতে ঝুলে থাকা গোশত থেকে পছন্দ সই এক টূকরা নিয়ে তাতে পরিমান মত চর্বি ও হাড্ডি পেতেন, এখন ৬০০ টাকার কেজি কিন্তু তা না, সে তার মত করে সব কিছু সাজিয়ে বিক্রি করছে এবং এখানেই তার মুল প্রতারণা!
আমি অনেক ভেবেই কথাটা বলছি, ৬০০ টাকার কথা বলে মুলত প্রতারণা করেই খোরশেদ আমাদের হাতিয়ে নিচ্ছে এবং তার ভান্ডার ভরে ফেলছে। আমরা বুঝেও দাম কম দেখে কিনে নিচ্ছি, অন্তত একবারের জন্য হলেও, এতে সে মুল কামাইটা করে নিচ্ছে!’
কারওয়ান বাজারের মাংস বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে প্রতারণার বিষয়টি আরও পরিস্কার হয়।
মো. হাফিজ নামে একজন মাংস বিক্রেতা জানান, ‘আগে ৭০০ টাকা কেজিতে গরুর মাংস বিক্রি করেও লাভ হচ্ছিল না। আর এখন ৬০০ টাকা কেজিতে বিক্রি করেও লাভ করছি।’
লাভ কীভাবে হচ্ছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘গতকাল ১৬ কেজি গরুর মাংস কিনেছিলাম ৬৮০ টাকা কেজি দরে।। এর বাইরে আলাদা করে ৪ কেজি চর্বি কিনেছি ২০০ টাকা দিয়ে। চর্বি আর মাংস মিশিয়ে ২০ কেজি হলো। তারপর প্রতি কেজি ৬০০ টাকা করে বিক্রি করলাম। লাভ হলো ৯২০ টাকা।’
একই কথা জানিয়েছেন আরও কয়েকজন বিক্রেতা। তারা জানান, আগে ৭০০ টাকায় ১ কেজি গরু বিক্রি করলে তাতে ১০০ গ্রাম হাড় ও ১০০ গ্রাম চর্বি থাকত। এখন ৬০০ টাকা কেজির গরুর মাংসে ২০০ গ্রাম চর্বি, ২৫০ গ্রাম হাড় থাকে।
পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন বিক্রেতা বলেন, আগে মাংসে ১০০ গ্রাম চর্বি, ১০০ গ্রাম হাড্ডি থাকত। এখন ৩০০ গ্রাম হাড্ডি, ২০০ গ্রাম চর্বি আর ৫০০ গ্রাম মাংস মিলিয়ে ৬০০ টাকা কেজি বিক্রি করি। আগে খুলির সাইডের মাংস-হাড্ডি এগুলো ফেলে দেওয়া হতো। এখন আর কোনো ফেলানি নাই। গরুর কোনো কিছুই এখন ফেলে না। আগে পায়ের হাঁটুর অংশ, মাথার অংশ, রগ, বট, নলি-পায়া আলাদা বেচত এখন মিশিয়ে দেই। ছাটাছুটা মিশিয়ে ৬০০ টাকা কেজিতে মাংশ বিক্রি করছি।
বিশিষ্ট সাংবাদিক জাহিদ রেজা নূর এক ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, ‘কাল অফিস থেকে ফিরে ইচ্ছে হলো গরুর মাংসের দাম কত দেখে আসি। আমাদের টাউন হল বাজার অভিজাত বাজার। এখানে দরদাম সবসময় উচ্চাঙ্গের। যখন খিলগাঁও বাসাবো এলাকায় ৬০০ টাকা কেজি গরুর মাংসের কথা শোনা যাচ্ছিল, তখনো এখানে আটশ টাকা লিখে সাড়ে ৭০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছিল গরুর মাংস। কাল যখন আমার প্রিয় দোকানটায় গেলাম, দেখলাম, দোকানীর মন ভার। ম্যাজিস্ট্রেট এসেছিলেন। জরিমানা করেছেন। গতকাল মাংস বিক্রি করছিলেন তিনি ৭০০ টাকায়। এবং বলছিলেন এই মাংসটুকু বিক্রি হয়ে গেলে তিনি দোকান বন্ধ রাখবেন। ৬০০ টাকায় মাংস বিক্রি করা অসম্ভব।’
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।