আপনার ভেতরে একটি প্রাণ বেড়ে উঠছে। ক্ষুদ্র হৃদস্পন্দন, নড়াচড়ার প্রথম টোকা – এই অনুভূতির তুলনা হয় না। কিন্তু এই সূক্ষ্ম জীবনটির সুরক্ষা ও বিকাশ পুরোপুরি নির্ভর করে আপনার পুষ্টির ওপর। গর্ভাবস্থা শুধু আনন্দের নয়, এক গভীর দায়িত্বেরও সময়। প্রতিটি গ্রাম পুষ্টি, প্রতিটি ভিটামিন আপনার শিশুর ভবিষ্যৎ গড়ে তোলে। তাই, গর্ভকালীন পুষ্টি চার্ট শুধু একটি তালিকা নয়; এটি মা ও অনাগত সন্তানের সুস্থতার জন্য অপরিহার্য রোডম্যাপ, একটি জীবন্ত দলিল। এর সঠিক অনুসরণই পারে গর্ভাবস্থাকে করে তুলতে নিরাপদ ও আনন্দময়।
গর্ভকালীন পুষ্টি চার্ট: কেন এই অপরিহার্যতা?
গর্ভাবস্থা মানেই শরীরে আমূল পরিবর্তন। নতুন জীবনকে ধারণ করতে, তার বৃদ্ধি ও বিকাশ নিশ্চিত করতে শরীরের চাহিদা বেড়ে যায় দ্বিগুণ, তিনগুণ, এমনকি কিছু পুষ্টির ক্ষেত্রে তারও বেশি। গর্ভকালীন পুষ্টি চার্ট এই বাড়তি চাহিদাকে বিজ্ঞানভিত্তিকভাবে চিহ্নিত করে এবং পূরণের পথ দেখায়। এটি শুধু শিশুর শারীরিক বিকাশই নয়, মায়ের স্বাস্থ্য রক্ষা, গর্ভকালীন জটিলতা (যেমন রক্তাল্পতা, প্রিক্ল্যাম্পসিয়া, গর্ভকালীন ডায়াবেটিস) প্রতিরোধ এবং প্রসবোত্তর সুস্থতাকেও নিশ্চিত করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) জোর দিয়ে বলে, গর্ভাবস্থায় পর্যাপ্ত পুষ্টি মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যুহার কমানোর অন্যতম প্রধান হাতিয়ার। বাংলাদেশের মতো দেশে, যেখানে অপুষ্টির হার উল্লেখযোগ্য, সেখানে গর্ভকালীন পুষ্টি চার্ট অনুসরণের গুরুত্ব আরও অনেক বেশি।
ট্রাইমেস্টারভিত্তিক পুষ্টির চাহিদা: প্রতিটি ধাপের আলাদা গুরুত্ব
গর্ভাবস্থাকে তিনটি ট্রাইমেস্টারে ভাগ করা হয়, প্রতিটির জন্য পুষ্টি চাহিদা ভিন্ন। গর্ভকালীন পুষ্টি চার্ট এই পার্থক্যগুলো স্পষ্টভাবে তুলে ধরে।
প্রথম ট্রাইমেস্টার (১-১২ সপ্তাহ): ভিত্তি স্থাপনের সময়
- চ্যালেঞ্জ: বমি বমি ভাব, খাবারে অরুচি, ক্লান্তি। এই সময়ে ওজন বাড়ার চাপ কম।
- প্রধান পুষ্টি:
- ফলিক অ্যাসিড (ফোলেট): অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ! নিউরাল টিউব ত্রুটি (যেমন স্পাইনা বিফিডা) প্রতিরোধ করে। প্রতিদিন ৪০০-৮০০ মাইক্রোগ্রাম অত্যাবশ্যক। ঢাকার বারডেম হাসপাতালের গাইনি বিশেষজ্ঞ ডা. তাহমিনা হকের মতে, “গর্ভধারণের পরিকল্পনা করলেই ফলিক অ্যাসিড সাপ্লিমেন্ট শুরু করা উচিত। প্রথম ট্রাইমেস্টারে এর ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।” (সূত্র: বারডেম হাসপাতাল, প্রেগন্যান্সি কেয়ার গাইডলাইন)। সবুজ শাকসবজি (পালং, মেথি), ডাল, বাদাম, শস্যদানা (ফর্টিফায়েড) ভালো উৎস।
- ভিটামিন বি৬: বমি বমি ভাব কমাতে সাহায্য করে। কলা, আলু, মুরগির মাংস, বাদামে পাওয়া যায়।
- আয়রন: রক্তের পরিমাণ বাড়তে শুরু করে। শাকসবজি, ডাল, লাল মাংসে থাকে। তবে ডাক্তারের পরামর্শে সাপ্লিমেন্ট নেওয়া প্রয়োজন হতে পারে।
- কী খাবেন: ছোট ছোট কিন্তু ঘন ঘন খাবার। শুকনো টোস্ট, বিস্কুট, আদা চা (বমি কমাতে), ফল, দই, প্রচুর পানি। চর্বিযুক্ত বা অতিরিক্ত মসলাদার খাবার এড়িয়ে চলুন।
দ্বিতীয় ট্রাইমেস্টার (১৩-২৬ সপ্তাহ): দ্রুত বৃদ্ধির পর্যায়
- চ্যালেঞ্জ: বমিভাব কমে, শক্তি ফিরে আসে। শিশুর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দ্রুত বিকাশ লাভ করে। মায়ের ওজন নিয়মিত বাড়তে শুরু করে (সপ্তাহে প্রায় ০.৫ কেজি)।
- প্রধান পুষ্টি:
- প্রোটিন: শিশুর পেশি, ত্বক, অঙ্গ বিকাশের মূল উপাদান। প্রতিদিন ৭০-৮০ গ্রাম প্রোটিন দরকার। ডিম, দুধ, দই, পনির, মাছ (সামুদ্রিক মাছ ওমেগা-৩ এর জন্য ভালো), মুরগি, ডাল, বাদাম, সয়াবিন নিত্যদিনের খাদ্যতালিকায় রাখুন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্য বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. নাজমা শাহীন বলেন, “গর্ভবতী মায়েদের খাবারে প্রাণিজ ও উদ্ভিজ উভয় প্রোটিনের সমন্বয় থাকা চাই। শুধু ডাল বা শাকের ওপর ভরসা করলে চাহিদা পূরণ হয় না।”
- ক্যালসিয়াম: শিশুর হাড় ও দাঁত গঠনের জন্য এবং মায়ের হাড়ের ঘনত্ব রক্ষার জন্য অপরিহার্য। প্রতিদিন ১০০০ মিলিগ্রাম। দুধ, দই, পনির, ছোট মাছ (কাঁটাসহ), টফু, সবুজ শাকসবজি (ব্রোকলি, কলমি শাক)।
- ভিটামিন ডি: ক্যালসিয়াম শোষণের জন্য জরুরি। সূর্যালোক প্রধান উৎস। ডিমের কুসুম, ফর্টিফায়েড দুধও দেয়। প্রায়ই সাপ্লিমেন্টের প্রয়োজন হয়।
- আয়রন: রক্তাল্পতা প্রতিরোধে আরও গুরুত্বপূর্ণ। ডাক্তারের পরামর্শে সাপ্লিমেন্ট চালিয়ে যেতে হবে।
- ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড (DHA): শিশুর মস্তিষ্ক ও চোখের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ। ফ্যাটি ফিশ (স্যালমন, সার্ডিন, ইলিশ), আখরোট, ফ্ল্যাক্সসিড।
- কী খাবেন: সুষম খাদ্যাভ্যাস জোরদার করুন। প্রতিবেলার খাবারে প্রোটিন, শর্করা ও স্বাস্থ্যকর চর্বির সমন্বয় রাখুন। প্রচুর ফল ও শাকসবজি। পর্যাপ্ত পানি পান চালিয়ে যান।
- তৃতীয় ট্রাইমেস্টার (২৭-৪০ সপ্তাহ): চূড়ান্ত প্রস্তুতি ও শক্তি সঞ্চয়ের সময়
- চ্যালেঞ্জ: পেটের চাপে হজমের সমস্যা (অ্যাসিডিটি, বদহজম), পায়ে ব্যথা, ক্লান্তি বাড়তে পারে। শিশুর ওজন দ্রুত বাড়ে।
- প্রধান পুষ্টি:
- আয়রন: প্রসবের সময় রক্তক্ষরণের জন্য শরীরে পর্যাপ্ত রক্ত মজুদ রাখতে হয়। সাপ্লিমেন্ট অত্যাবশ্যক।
- ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ডি: চাহিদা আগের মতোই উচ্চ। হাড়ের বিকাশ চূড়ান্ত পর্যায়ে।
- প্রোটিন: শিশুর পেশি ভর ও মায়ের টিস্যু মেরামতের জন্য প্রয়োজনীয়।
- ফাইবার: কোষ্ঠকাঠিন্য প্রতিরোধে সাহায্য করে। শাকসবজি, ফল, গোটা শস্য, ওটস।
- ভিটামিন কে: রক্ত জমাট বাঁধার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। সবুজ শাকসবজিতে প্রচুর থাকে।
- কী খাবেন: ছোট ছোট অথচ পুষ্টিকর খাবার বার বার খান। ভারী, ভাজাপোড়া খাবার এড়িয়ে চলুন। ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার বাড়ান। প্রচুর পানি পান করুন। শেষ দিকে অতিরিক্ত ক্যালোরির প্রয়োজন বাড়ে, তবে তা যেন স্বাস্থ্যকর উৎস (ফল, দুধ, বাদাম) থেকে আসে।
গর্ভকালীন পুষ্টি চার্টের মৌলিক উপাদানসমূহ: প্রতিদিনের প্লেটে যা থাকতেই হবে
একটি আদর্শ গর্ভকালীন পুষ্টি চার্ট নিচের পুষ্টি উপাদানগুলোকে প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার উপর জোর দেয়:
- প্রোটিন (Protein): কোষ গঠনের মূল উপাদান। প্রতিদিন ৩-৪ পরিবেশন (ডিম, মাছ/মাংস ১ তালি, ডাল ১ বাটি, দুধ/দই ১ গ্লাস/বাটি)।
- ক্যালসিয়াম (Calcium): হাড় ও দাঁতের গঠন, মাংসপেশির কাজ। প্রতিদিন ৪-৫ পরিবেশন (দুধ ২ গ্লাস, দই ১ কাপ, পনির ১ টুকরা, ছোট মাছ ১ তালি, শাক ১ বাটি)।
- আয়রন (Iron): রক্তে হিমোগ্লোবিন তৈরি, অক্সিজেন পরিবহন। প্রতিদিন লাল মাংস, ডাল, সবুজ শাক, ড্রাই ফ্রুট। সাপ্লিমেন্ট ডাক্তারের পরামর্শে বাধ্যতামূলক।
- ফলিক অ্যাসিড (Folic Acid): প্রথম দিকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শাক, ডাল, বাদাম, ফর্টিফায়েড সিরিয়াল। সাপ্লিমেন্ট শুরু থেকেই প্রয়োজন।
- ভিটামিন ডি (Vitamin D): ক্যালসিয়াম শোষণে সাহায্য করে। সূর্যের আলো, ডিমের কুসুম, ফর্টিফায়েড দুধ। প্রায়ই সাপ্লিমেন্ট দেওয়া হয়।
- ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড (Omega-3 Fatty Acids – DHA): শিশুর মস্তিষ্ক ও চোখের উন্নয়ন। ফ্যাটি ফিশ, আখরোট, ফ্ল্যাক্সসিড। ডাক্তারের পরামর্শে সাপ্লিমেন্ট নেওয়া যেতে পারে।
- ফাইবার (Fiber): হজমশক্তি ঠিক রাখে, কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে। ফল, শাকসবজি, গোটা শস্য, ডাল।
- পানি (Water): শরীরের সমস্ত কাজকর্ম, রক্তের পরিমাণ বাড়ানো, ডিহাইড্রেশন ও ইউটিআই প্রতিরোধের জন্য প্রতিদিন ৮-১২ গ্লাস বিশুদ্ধ পানি পান অপরিহার্য।
বাংলাদেশি প্রেক্ষাপটে গর্ভকালীন পুষ্টি: সহজলভ্য ও পুষ্টিকর খাবারের তালিকা
আমাদের দেশে সহজলভ্য ও সুলভ মূল্যের অনেক খাবারই গর্ভকালীন পুষ্টি চার্ট-এর চাহিদা পূরণ করতে পারে:
- প্রোটিনের জন্য: ডিম, ছোট মাছ (মলা, ঢেলা, পুঁটি – কাঁটাসহ খাওয়া যায়), কাচকি, ইলিশ (মৌসুমে), মুরগি, ডাল (মসুর, মুগ, মটর), সয়াবিন, বাদাম, দুধ-দই (স্থানীয়ভাবে তৈরি টক দইও ভালো)।
- ক্যালসিয়ামের জন্য: দুধ, দই, পনির, ছোট মাছ (কাঁটাসহ), কচু শাক, ডাঁটা শাক, কলমি শাক, ওরাইও শাক, বোথুয়া শাক, ঢেঁকি ছাটা চালের ভাতের মাড়।
- আয়রনের জন্য: কলিজা (গরু/মুরগি), লাল মাংস (পরিমিত), ডাল, কচু শাক, পালং শাক, লালশাক, বীট, খেজুর, ডুমুর, গুড়। খেয়াল রাখুন: ভিটামিন সি (লেবু, আমলকী, পেয়ারা, কাঁচা মরিচ) আয়রনের শোষণ বাড়ায়। তাই ডাল বা শাকের সাথে লেবু খান, চায়ের সাথে নয় (চা আয়রন শোষণে বাধা দেয়)।
- ফলিক অ্যাসিডের জন্য: ঢেঁকি ছাটা চাল, ডাল (বিশেষ করে মুগ ডাল), সবুজ শাক (পালং, মেথি), বাদাম, কলা, কমলা।
- ফাইবারের জন্য: সব ধরনের দেশি ফল (পেয়ারা, আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু, পেপে – পাকা), শাকসবজি (ঝিঙে, চালকুমড়া, পটল, লাউ, বরবটি), গোটা শস্য (ঢেঁকিছাটা চাল, ওটস), ডাল।
গর্ভকালীন পুষ্টি চার্ট বাস্তবায়নে প্রতিদিনের পরিকল্পনা (নমুনা)
- সকালের নাস্তা (৮:০০ টা): ১-২টি ডিমের ওমলেট/সিদ্ধ ডিম + ১ কাপ দুধ/১ বাটি দই + ১ টুকরা রুটি/২ টুকরা টোস্ট। বা, ওটস সুজি/দলিয়া রান্না করে তাতে দুধ ও ফল মিশিয়ে নিন।
- মধ্য সকাল (১১:০০ টা): ১টি ফল (আপেল/পেয়ারা/কলা) + এক মুঠো বাদাম (চিনাবাদাম/কাঠবাদাম)। বা, ছোলা ভেজানো সিদ্ধ।
- দুপুরের খাবার (২:০০ টা): ঢেঁকিছাটা চালের ভাত + মাছ/মুরগির তরকারি (১ টুকরা) + ডাল (১ বাটি) + সবজি তরকারি (১ বাটি) + শাক ভাজি/সবজি ভর্তা + সালাদ (শসা, টমেটো, গাজর) + লেবু। মনে রাখুন: শাক-সবজি যেন প্রতিবেলায় থাকে।
- বিকালের নাস্তা (৫:০০ টা): ১ গ্লাস দুধ/লাচ্ছি/স্মুদি (ফল দিয়ে) + মুড়ি/চিড়া/২ টুকরা বিস্কুট। বা, ছোলার ছাতু/সাগু পায়েস।
- রাতের খাবার (৮:৩০-৯:০০ টা): দুপুরের খাবারের মতো, তবে একটু হালকা। ভাত/রুটি + সবজি তরকারি/ডাল + দই/ছানা। মাছ বা মাংস দুপুরেই খাওয়া ভালো। রাতে ভারী প্রোটিন কম খান।
- শোবার আগে (প্রয়োজনে): ১ গ্লাস গরম দুধ (হালকা মিষ্টি/মধু দিয়ে)।
সতর্কতা ও বিশেষ নির্দেশনা: কী এড়িয়ে চলবেন
- অপাস্তুরিত দুধ ও পনির: টক্সোপ্লাজমোসিস, লিস্টেরিয়োসিসের ঝুঁকি। দুধ ভালো করে ফুটিয়ে খান।
- কাঁচা বা আধা সিদ্ধ ডিম/মাছ/মাংস: সালমোনেলা বা অন্যান্য ব্যাকটেরিয়ার ঝুঁকি।
- কিছু সামুদ্রিক মাছ: হাঙর, সোর্ডফিশ, টাইলফিশ ইত্যাদিতে পারদ (মার্কারি) বেশি থাকে, যা শিশুর স্নায়ুতন্ত্রের ক্ষতি করতে পারে। টুনা মাছ সীমিত পরিমাণে খান।
- অতিরিক্ত ক্যাফেইন: কফি, চা, কোলা সীমিত করুন (দিনে ১-২ কাপের বেশি নয়)। অতিরিক্ত ক্যাফেইন গর্ভপাত বা কম ওজনের শিশু জন্মের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
- অ্যালকোহল ও ধূমপান: একেবারেই নিষিদ্ধ। গর্ভপাত, জন্মগত ত্রুটি, বিকলাঙ্গতা, প্রিম্যাচিউর বার্থের সরাসরি কারণ।
- অতিরিক্ত ভাজাপোড়া ও জাঙ্ক ফুড: পুষ্টিহীনতা, ওজন অতিরিক্ত বাড়া, হজমের গোলযোগ ঘটায়।
- কাঁচা পেঁপে ও আনারস: কিছু উপাদান জরায়ু সংকোচনে ভূমিকা রাখতে পারে, বিশেষ করে প্রথম দিকে এড়ানো ভালো।
- স্ব-প্রণোদিত ভিটামিন/মিনারেল সাপ্লিমেন্ট: ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া কোন সাপ্লিমেন্ট নয়। কিছু ভিটামিন (যেমন ভিটামিন এ) অতিরিক্ত মাত্রায় ক্ষতিকর হতে পারে।
গর্ভকালীন পুষ্টি চার্ট সফল বাস্তবায়নের টিপস
- ডাক্তার ও পুষ্টিবিদের পরামর্শ নিন: আপনার শারীরিক অবস্থা, ওজন, রক্ত পরীক্ষার ফলাফল অনুযায়ী ব্যক্তিগতকৃত গর্ভকালীন পুষ্টি চার্ট তৈরি করুন। বাংলাদেশে সরকারি হাসপাতাল, কমিউনিটি ক্লিনিক বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে রেজিস্টার্ড পুষ্টিবিদ রয়েছেন।
- বিভিন্নতা আনুন: একঘেয়েমি দূর করতে রঙিন শাকসবজি, বিভিন্ন ধরনের ফল, বিভিন্ন ডাল ও প্রোটিন সোর্স রোটেট করুন।
- ছোট কিন্তু ঘন ঘন খান: একবারে বেশি খাওয়ার চেয়ে দিনে ৫-৬ বার অল্প অল্প করে খান। হজমে সুবিধা হয়, বমিভাব ও অ্যাসিডিটি কমে।
- হাইড্রেটেড থাকুন: পানি, ডাবের পানি, তাজা ফলের রস (চিনি কম), স্যুপ পান করুন। প্রস্রাবের রং হালকা হলুদ রাখার চেষ্টা করুন।
- বাড়িতে তৈরি খাবার: যতটা সম্ভব বাড়িতে তৈরি তাজা খাবার খান। বাইরের খাবারে সংরক্ষক, অতিরিক্ত লবণ, চিনি ও অস্বাস্থ্যকর তেল থাকে।
- লেবেল পড়ুন: প্যাকেটজাত খাবার কিনলে পুষ্টি তথ্য (Nutrition Facts) দেখে ক্যালোরি, চিনি, সোডিয়াম, ফ্যাটের পরিমাণ জেনে নিন।
- নিরাপদ খাদ্য চর্চা: ফল-সবজি ভালোভাবে ধুয়ে নিন, মাছ-মাংস ভালোভাবে রান্না করুন, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখুন।
- শরীরের সংকেত শুনুন: ক্ষুধা ও তৃপ্তির অনুভূতিকে সম্মান করুন। জোর করে খাবেন না, আবার ক্ষুধার্তও থাকবেন না।
- সাপ্লিমেন্ট নিয়মিত নিন: ডাক্তারের দেওয়া আয়রন, ক্যালসিয়াম, ফলিক অ্যাসিড, ভিটামিন ডি বা মাল্টিভিটামিন ট্যাবলেট নিয়মিত ও নির্দিষ্ট সময়ে (যেমন আয়রন ট্যাবলেট খালি পেটে ভিটামিন সি যুক্ত ফলের রসের সাথে) সেবন করুন।
- সহায়ক গোষ্ঠীর সাথে যুক্ত হন: অন্যান্য গর্ভবতী মা, পরিবারের সদস্য, বন্ধুদের সাথে পুষ্টি বিষয়ে আলোচনা করুন। সমর্থন জরুরি।
জেনে রাখুন (FAQs)
প্রশ্ন: গর্ভাবস্থায় প্রতিদিন কত ক্যালোরি প্রয়োজন?
উত্তর: প্রথম ট্রাইমেস্টারে সাধারণত বাড়তি ক্যালোরির প্রয়োজন হয় না (শুধু সুষম খাবার জোর দিতে হবে)। দ্বিতীয় টাইমেস্টারে দিনে প্রায় ৩৪০ অতিরিক্ত ক্যালোরি, এবং তৃতীয় ট্রাইমেস্টারে প্রায় ৪৫০ অতিরিক্ত ক্যালোরি প্রয়োজন হয়। তবে এটি মায়ের প্রাক-গর্ভাবস্থার ওজন, বয়স ও কার্যকলাপের উপর নির্ভর করে। ডাক্তার বা পুষ্টিবিদের কাছ থেকে ব্যক্তিগত পরামর্শ নিন।প্রশ্ন: নিরামিষাশী মায়েরা গর্ভাবস্থায় কীভাবে প্রোটিনের চাহিদা মেটাবেন?
উত্তর: নিরামিষাশী মায়েরা প্রোটিনের চাহিদা মেটাতে পারেন ডাল, বিনস, ছোলা, সোয়াবিন ও সয়াপণ্য (টফু, সয়া দুধ), বাদাম, বীজ (তিল, ফ্ল্যাক্সসিড), দুধ, দই, পনির, ডিম (যদি ওভো-ল্যাক্টো নিরামিষাশী হন) দিয়ে। বিভিন্ন প্রোটিন সোর্স একসাথে খেলে (যেমন ডাল-ভাত, দুধ-ওটস) প্রোটিনের মান উন্নত হয়। আয়রন, ভিটামিন বি১২, ক্যালসিয়াম ও ডিএইচএ সাপ্লিমেন্টের দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে এবং পুষ্টিবিদের পরামর্শ নিতে হবে।প্রশ্ন: গর্ভাবস্থায় বমি বমি ভাব হলে কী করব?
উত্তর: প্রথম দিকে বমিভাব সাধারণ। সাহায্য করতে পারে:- সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর বিছানায় বসেই শুকনো টোস্ট বা বিস্কুট খাওয়া।
- অল্প অল্প করে, ঘন ঘন খাওয়া।
- তীব্র গন্ধ এড়ানো।
- আদা চা, আদার টুকরা চিবানো বা আদার ক্যান্ডি খাওয়া।
- ঠাণ্ডা খাবার (ফল, দই) খাওয়া, গরম খাবারের গন্ধ কম লাগে।
- পর্যাপ্ত পানি পান (ছোট চুমুকে)। তীব্র হলে ডাক্তারের শরণাপন্ন হন।
প্রশ্ন: গর্ভাবস্থায় কতটা ওজন বাড়া স্বাভাবিক?
উত্তর: ওজন বাড়ার পরিমাণ মায়ের প্রাক-গর্ভাবস্থার BMI (Body Mass Index) এর উপর নির্ভর করে:- BMI < 18.5 (ওজন কম): ১২.৫ – ১৮ কেজি
- BMI 18.5 – 24.9 (স্বাভাবিক ওজন): ১১.৫ – ১৬ কেজি
- BMI 25.0 – 29.9 (ওজন বেশি): ৭ – ১১.৫ কেজি
- BMI ≥ 30 (স্থূলতা): ৫ – ৯ কেজি
ডাক্তার নিয়মিত ওজন মাপবেন এবং গাইড করবেন।
প্রশ্ন: গর্ভাবস্থায় কোন কোন খাবার একদম খাওয়া যাবে না?
উত্তর: কাঁচা বা আধা সিদ্ধ মাছ/মাংস/ডিম, অপাস্তুরিত দুধ ও পনির, কাঁচা স্প্রাউট, অতিরিক্ত ক্যাফেইনযুক্ত পানীয় (দিনে ২০০ মিগ্রার বেশি নয়, অর্থাৎ ১-২ কাপের বেশি কফি নয়), অ্যালকোহল, ধূমপান, অতিরিক্ত ভাজাপোড়া ও জাঙ্ক ফুড। কিছু মাছ (যেমন হাঙর, সোর্ডফিশ) এড়িয়ে চলুন। কাঁচা পেঁপে ও আনারসও প্রথম দিকে সীমিত করুন।- প্রশ্ন: গর্ভাবস্থায় ভিটামিন সাপ্লিমেন্ট কতটা জরুরি?
উত্তর: ফলিক অ্যাসিড শুরু থেকেই (এমনকি গর্ভধারণের আগে থেকেই) ডাক্তারের পরামর্শে বাধ্যতামূলক। আয়রন সাপ্লিমেন্ট প্রায় সব মায়েদেরই দ্বিতীয় ও তৃতীয় ট্রাইমেস্টারে দরকার হয়। ভিটামিন ডি ও ক্যালসিয়াম সাপ্লিমেন্টও অনেক সময় প্রয়োজন হয়। কোন সাপ্লিমেন্টই ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া শুরু করা উচিত নয়। একটি প্রিসক্রিপশন প্রেগন্যান্সি মাল্টিভিটামিনে প্রয়োজনীয় ভিটামিন-মিনারেলের সমন্বয় থাকতে পারে।
এই নয় মাস আপনার হাতে গড়ে উঠছে ভবিষ্যতের একটি প্রাণ। গর্ভকালীন পুষ্টি চার্ট শুধু একটি নির্দেশিকা নয়, এটি আপনার ভালোবাসা ও দায়িত্ববোধেরই প্রকাশ। প্রতিটি পুষ্টিকর বাইট আপনার শিশুর কোষ গঠন করছে, তার মস্তিষ্কের নিউরনগুলোকে সংযুক্ত করছে, তার হৃদস্পন্দনকে শক্তিশালী করছে। এটি শুধু খাওয়ার বিষয় নয়, এটি প্রজন্মের জন্য বিনিয়োগ। তাই, ডাক্তার ও পুষ্টিবিদের পরামর্শ মেনে আপনার জন্য প্রণীত গর্ভকালীন পুষ্টি চার্টকে আন্তরিকভাবে অনুসরণ করুন। সঠিক পুষ্টিই পারে আপনার গর্ভকালীন যাত্রাকে করতেই পারে নিরাপদ, স্বাস্থ্যকর এবং অপেক্ষার এই সময়টিকে করে তুলতে আনন্দময়। আপনার সুস্থতাই আপনার শিশুর উজ্জ্বল ভবিষ্যতের ভিত্তি। আজই শুরু করুন সচেতন পথচলা।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।