নিজস্ব প্রতিবেদক, গাজীপুর: নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে ২০ ধারায় সংরক্ষিত বনের বুক চিরে সড়ক নির্মাণকাজ শুরু করেছে গাজীপুর স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ (এলজিইডি)। পরিবেশ বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় থেকে অনুমতি না নিয়ে, গাজীপুর জেলা প্রশাসনের সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে এবং বন বিভাগকে না জানিয়ে ‘নতুন সড়ক’ নির্মাণকাজ অব্যাহত রেখেছে এলজিইডি।
সড়কটি নির্মাণ করতে গিয়ে কাটা হয়েছে কয়েক হাজার গজারি গাছ (শালকপিচ)। সুরক্ষিত বনে এস্কেভেটর দিয়ে মাটি কাটা হয়েছে। এর আগেই নির্মাণাধীন সড়কটির দুই পাশে বনে আগুন জ্বালিয়ে দিয়ে দুষ্কৃতকারীরা ধ্বংস করেছে বিভিন্ন প্রজাতির চারাগাছ। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অগণিত শাল বৃক্ষ। বাস্তুচ্যুত হয়েছে বন্যপ্রাণী। হুমকির মুখে পড়েছে প্রাকৃতিক জীববৈচিত্র্য।
নির্মাণাধীন সড়কটির এক কিলোমিটারে মধ্যে আশপাশে কোনো বসতি লক্ষ্য করা যায়নি। এরপরও এই সড়ক নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০২২–২৩ অর্থবছরে আইআরআইডিপি–৩–এর আওতায় গাজীপুর শ্রীপুর বীর মুক্তিযোদ্ধা রহমত আলী সরকারি কলেজের পেছন থেকে পেলাইদ পর্যন্ত দেড় কিলোমিটার ২০ ধারায় সংরক্ষিত বনের ভেতর দিয়ে আড়াই কিলোমিটার পাকা সড়ক নির্মাণের জন্য দরপত্র আহ্বান করা হয়। দুই কোটি টাকার বেশি ব্যয়ে সড়কটি নির্মাণের কাজ পায় মেসার্স পূর্ণতা এন্টারপ্রাইজ। গত বছরের ১৯ নভেম্বর গাজীপুর জেলা উন্নয়ন কমিটির সভায় ‘নতুন রাস্তা নির্মাণের আগে যাচাই–বাছাই ও বনের ক্ষতিসাধন করে কোনো রাস্তা নির্মাণ করা যাবে না’ বলে সিদ্ধান্ত হয়। পরে ওই সিদ্ধান্ত জেলা উন্নয়ন সমন্বয় কমিটির মাসিক সভার কার্যবিবরণীতে (ক্রমিক নম্বর ৭, খ) অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন গাজীপুর জেলা প্রশাসক আবুল ফাতে মোহাম্মদ সফিকুল ইসলাম।
শ্রীপুর রেঞ্জ কর্মকর্তার কার্যালয়ের তথ্য বলছে, গত ১২ মার্চ পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের অনাপত্তি ছাড়াই কাঁচা রাস্তা পিচ ঢালাই করতে এস্কেভেটর দিয়ে মাটি কাটার কাজ শুরু করা হয়। অথচ নির্মাণাধীন আড়াই কিলোমিটার সড়কটির মধ্যে দেড় কিলোমিটার সংরক্ষিত বনভূমি কাদিম গাজিয়ারন, গাড়ারন ও পটকা মৌজার ৯৪২,১০৬৪ এবং ৪৪৩ সিএস দাগের। ওই তিনটি সিএস দাগ থেকে সৃষ্ট আরএস দাগগুলো হলো, ৪১৯৪, ৪১৯৫,৪১৯৮, ৪৩৬৪,৪২৮৭, ৪৩০৭,৪২৯৭, ৪৩৫৯,৪৩৫৪, ৪৩৫৯ এবং ৪৩৪৭। পরবর্তীতে স্থানীয় রেঞ্জ অফিসের পক্ষ থেকে সড়কটির কাজ বন্ধ রাখতে শ্রীপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার মাধ্যমে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটিকে জানানো হয়। সে অনুযায়ী, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মালিক সোহেল মৃধা বনের মধ্যে রাস্তা নির্মাণ করবেন না—মর্মে শ্রীপুর ফরেস্ট রেঞ্জ কর্মকর্তার কাছে লিখিত দেন। এরপরও গত ১৯ মার্চ শালবন বিনষ্ট করে সড়কটির নির্মাণকাজ অব্যাহত রাখে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি।
ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স পূর্ণতা এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী সোহেল মৃধা বলেন, সড়কটি নির্মাণের জন্য বিগত দিনে চারবার দরপত্র আহ্বান করলেও কেউ সাড়া দেয়নি। তিনি আগে থেকে জানতেন না সড়কটি বনভূমির ওপর দিয়ে গেছে। বন বিভাগের সঙ্গে বিরোধে জড়াতে চান না। তিনি বলেন, ‘মন্ত্রী–এমপি এলজিইডিকে নতুন সড়ক নির্মাণের কথা বললে এলজিইডির হুঁশ থাকে না! অথচ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ঠিকাদারেরা।’
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে গাজীপুর এলজিইডি নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ কামরুজ্জামান বলেন, ‘পরবর্তীতে নতুন করে বনে রাস্তা নির্মাণ করতে গেলে বন বিভাগকে আগে থেকে জানানো হবে। বিষয়টি সমাধানের জন্য স্থানীয় সংসদ সদস্য ও মন্ত্রীকে জানানো হয়েছে।’
ঢাকা বিভাগীয় বন কর্মকর্তা এস, এম সাজ্জাদ হোসেন বলেন, ‘বনভূমিতে বনায়ন ব্যতীত অন্য কোনো কিছু করার সুযোগ নেই। জাতীয় স্বার্থে প্রয়োজন হলে যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিতে হবে। অনুমতি না নিয়ে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ সড়কটি নির্মাণ চেষ্টা চালাচ্ছে। আমরা প্রতিটি দপ্তরে চিঠি দিয়ে অবহিত করেছি। অথচ জাতীয় স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে কার স্বার্থে বনের ভেতর দিয়ে রাস্তা নির্মাণের চেষ্টা চলছে সেটা আমাদের বোধগম্য নয়। বনের মধ্যে রাস্তা তৈরি হলে তা বনাঞ্চলের জন্য হুমকি।’
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।