পদার্থবিজ্ঞানের সূত্র বলে, দুটি বস্তু বিপরীত দিক থেকে একটা অন্যটাকে ধাক্কা দিলে তাদের মোট ভরবেগ সমান থাকে। অর্থাৎ সংঘর্ষের আগে ও পরে দুটি বস্তুর মোট ভরবেগ একই থাকে, পাল্টে যায় গতিপথ। একটু সরল করে বলা যায়, এ সময় একটি বস্তু অন্যটির কিছুটা বেগ নিয়ে চলতে শুরু করে।
পৃথিবীতে বাতাসের বাধার মতো নানা ঘর্ষণ বল কাজ করে, তাই বিষয়টি পুরোপুরি অনুভব করা যায় না। কিন্তু মহাকাশে ঘটনাটি সব সংঘর্ষের ক্ষেত্রেই নিখুঁতভাবে ঘটে। এজন্য খুব ছোট একটা গ্রহাণুও পৃথিবীর গতিপথ বা কক্ষপথের বিচ্যুতি ঘটাতে পারে। তবে যত সহজে বললাম, বিষয়টা এত সহজও নয়।
সাধারণত, বস্তু বড় হলে তার প্রভাবও অনেক বড় হয়। তবে সত্যিকার অর্থে বস্তুর প্রভাব আরও বেশ কিছু বিষয়ের ওপর নির্ভর করে। যেমন প্রভাবক বস্তুর ঘনত্ব ও স্থিতিস্থাপকতা, সংঘর্ষের স্থান, সংঘর্ষের কোণ ও গতিবেগ।
কথা হলো, গ্রহাণুর ভরবেগ পৃথিবীতে স্থানান্তরিত হওয়া বেশ কঠিন বিষয়। কারণ, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে গ্রহাণু ভূপৃষ্ট স্পর্শ করার আগেই বায়ুমণ্ডলে পুড়ে বাষ্পীভূত হয়ে যায়। ফলে গ্রহাণুর বেশির ভাগ গতিশক্তি রূপান্তরিত হয় তাপশক্তিতে। বায়ুমণ্ডলের কণাগুলোর সঙ্গে গ্রহাণুর ক্রমাগত সংঘর্ষের কারণে এ ঘটনা ঘটে।
ফলে গতিশক্তির খুব ক্ষুদ্র একটা অংশ যান্ত্রিক শক্তি হিসেবে ধাক্কা দেয় পৃথিবীকে। এ শক্তির পরিমাণ এত সামান্য যে এটা শুধু ভূপৃষ্টের ওপরে সামান্য ক্ষত সৃষ্টি ও গ্রহাণুটিকে ধ্বংস করতে সক্ষম। পৃথিবীর গতি বা গতিপথের ওপর এর কোনো প্রভাব পড়ে না বললেই চলে।
গ্রহাণু আঘাত করেছে, এমন অসংখ্য স্থান বিজ্ঞানীরা পর্যবেক্ষণ করেছেন। তথ্য সংগ্রহ করেছেন এসব জায়গা থেকে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় জায়গাটি হলো দক্ষিণ আফ্রিকার ভ্রেডেফোর্ট ক্রেটার বা খাদ। ধারণা করা হয়, প্রায় ২০ কিলোমিটার ব্যাসের একটি গ্রহাণু ঘন্টায় প্রায় ৯০ হাজার কিলোমিটার বেগে ছুটে এসে এখানে আঘাত করেছিল।
সেটা প্রায় ২০০ কোটি বছর আগের কথা। গ্রহাণুটির ভর ছিল সম্ভবত পৃথিবীর ১০ কোটি ভাগের এক ভাগ। দুটি বস্তুর ভরের বিশাল পার্থক্যের কারণে এরকম সংঘর্ষের পরেও পৃথিবীর কক্ষপথের ওপর কোনো উল্লেখযোগ্য প্রভাব পড়েনি। অন্তত পর্যবেক্ষণ তাই বলছে।
কক্ষপথে পরিবর্তন না ঘটলেও গ্রহাণুর আঘাতে পৃথিবীর ক্ষতি কিন্তু কম হয় না। ধারণা করা হয়, এ গ্রহের বেশিরভাগ গণবিলুপ্তির ঘটনা ঘটেছে গ্রহাণুর কারণে। বিশেষ করে ডাইনোসর বিলুপ্তির কারণ হিসেবে গ্রহাণুকে দায়ী করেন বিজ্ঞানীরা। কেউ কেউ দ্বিমত করেন বটে, তবে ফসিল ও অন্যান্য পর্যবেক্ষণের ফলে এটি মোটামুটি সর্বজনস্বীকৃত।
এ ঘটনার নাম চিক্সুলুব ইভেন্ট (Chicxulub event)। তবে গ্রহাণুর আঘাতে ভূপৃষ্টে গভীর ক্রেটার বা খাদ তৈরি, প্রলয়ংকারী সুনামী, ভূমিকম্প ও অগ্ন্যুৎপাতের মতো ঘটনা প্রায়ই ঘটে। তাই গ্রহাণুর কারণে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল ও জলবায়ুতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হয় বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
কিন্তু গ্রহাণুর আঘাতে পৃথিবীর কক্ষপথ পরিবর্তন হওয়ার আশঙ্কা প্রায় শূন্য। সৌরজগৎ গঠনের শুরু দিকে শিশুগ্রহগুলোর কক্ষপথ হয়তো এগুলো পরিবর্তন করতে পারত। শুধু তাই নয়, অনেক বিজ্ঞানীর ধারণা, চাঁদ তৈরি হয়েছিল পৃথিবীর সঙ্গে অন্য আরেকটি আদি গ্রহের সংঘর্ষের ফলে। বিজ্ঞানীরা এই গ্রহটির নাম দিয়েছেন থিয়া।
সৌরজগতের ৭ম গ্রহ ইউরোনাস অন্য গ্রহগুলোর চেয়ে একটু আলাদা। এটা নিজ অক্ষের ওপরে প্রায় ৯৭ দশমিক ৬ ডিগ্রি হেলে আছে। এমন হওয়ার কারণ হিসেবে মনে করা হয়, ৩০০ থেকে ৪০০ কোটি বছর আগে পৃথিবীর সমান আকারের কোনো বস্তু আঘাত করেছিল গ্রহটিকে। এ ধরনের আঘাত একটি গ্রহের কক্ষপথ পরিবর্তনের জন্য যথেষ্ট ছিল। তাই সৌরজগতের প্রতিটি গ্রহের কক্ষপথ পরিবর্তনের জন্য এসব সংঘর্ষের ভূমিকা থাকলেও থাকতে পারে। নিশ্চিত হওয়ার সুযোগ আপাতত নেই।
এখন অবশ্য গ্রহাণু নিয়ে তেমন দুশ্চিন্তার কিছু নেই আমাদের। গত বছর মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার পরিচালিত ডার্ট মিশনের মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা সফলভাবে গ্রহাণুর গতিপথ পরিবর্তন করেছেন। হঠাৎ কোনো গ্রহাণু পৃথিবীর দিকে ছুটে এলে বিজ্ঞানীরা হয়তো পৃথিবীতে পড়ার আগেই তার গতিপথ বদলে দিতে পারবেন। পৃথিবী থাকবে নিরাপদে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।