রঞ্জু খন্দকার, গাইবান্ধা থেকে : কেউ পুকুরের কাঁদা ঘেঁটে ধরে আনছেন টাকিমাছ। কেউবা অল্প পানিতে ধরছেন পুঁটি। কেউ সোল্লাসে চিৎকার দিয়ে উঠছেন বড় আকারের শোলমাছ পেয়ে। কেউবা নিরবে বালতি-খলুই ভরছেন কৈ, শিং দিয়ে।
শীতের শেষে পানি কমে যাওয়ায় গাইবান্ধার বিভিন্ন উপজেলার গ্রামে-গ্রামে এখন চলছে পুকুর সেচার উৎসব। এসব পুকুরে মিলছে দেশি মাছের সমাহার।
পলাশবাড়ী উপজেলার কুমারগাড়ী গ্রামে পুকুর সেচে মাছ ধরছিলেন শামসুল আলম। তিনি বলেন, তাঁর নিজের অনেকগুলো পুকুর। শীতে পানি কমে যাওয়ায় সেগুলো সেচে মাছ ধরছেন। এসব পুকুরে কার্পজাতীয় ছাড়াও দেশীয় প্রজাতির নানা মাছ পাওয়া যাচ্ছে।
দেশের বেশির ভাগ জায়গায় মাঘে শীত ফুরিয়ে গেলেও উত্তরাঞ্চলে তা ফুরোতে ফুরোতে এবার মধ্য চৈত্র। ফলে শীতে শেষেই পুকুরের পানি কমার কথা থাকলেও এবার তখন তেমন কমেনি। পানি নামতে দেরি হওয়ায় তা চলে এসেছে এই মধ্য চৈত্র পর্যন্ত।
কুমারগাড়ী গ্রামটি গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার ডুমুরগাছা ও পাটোয়া গ্রামের লাগোয়া। এর পাশেই বালাবামুনিয়া গ্রামও। এসব গ্রামে আজ এক পাড়ায় তো পরশু অন্য পাড়ায় প্রায়ই চলছে পুকুর সেচা। প্রায় মাসজুড়েই চলছে এমন উৎসব।
কয়েকটি গ্রামের কয়েকজন জানান, অন্যান্য বার শীত শেষ হতে না হতেই বিলের পানি নামতে শুরু করে। তখন বাউত উৎসব করে বিলের মাছ ধরা হয়। এরপর বিলের মাঝে থাকা ডোবাগুলোয় পানি গিয়ে জমা হয়। স্থানীয়ভাবে এগুলো চুয়া নামে পরিচিত। পানির সঙ্গে মাছও গিয়ে জমা হয় চুয়াগুলোয়। শীতের শেষে চুয়ার মাছ ধরা হয়। এরও পরে পুকুরের পানি কমতে থাকে সাধারণত ফাল্গুনের মধ্যে এসব পুকুরের মাছ ধরা শুরু হলেও চলে চৈত্র পর্যন্ত। এবারও তা এখনো চলছে।
কুমারগাড়ী গ্রামে একই দিন পুকুর সেচে মাছ ধরছিলেন হেলাল শেখ। তিনি বলেন, পুকুরটি তাঁর নয়। এটি তিনি ‘আধি’ হিসেবে নিয়েছেন। অর্থাৎ মাছ ধরবেন তিনি। এরপর পুকুরের মালিককে অর্ধেক দেবেন, নিজে নেবেন বাকিটা। আধা-আধি ভাগ করার এই পদ্ধতির স্থানীয় নামই আধি।
একই দিন দুটি পুকুরে মাছ ধরা শুরু হওয়ায় তা অনেকটা উৎসবে রূপ নেয়। ছেলে-বুড়ো থেকে শুরু করে তরুণ-তরুণী, বউ-ঝিয়েরাও কোমরে আঁচল বেঁধে নেমে পড়েন মাছ শিকারে। তাঁদের বেশির ভাগই স্বল্প আয়ের।
মাছ ধরার উৎসবে নেমে ছিলেন কছিমন বেওয়া। হাতের পাত্রে বেশ কিছু মাছ ধরে রেখেছেন। তিনি বললেন, পুকুর তাঁর নয়। তিনি আধিও নেননি। তবু মাছ ধরতে নেমেছেন।
বিষয়টি ব্যাখ্যা করে কছিমন জানান, পুকুর সেচার পর প্রথমে যাঁর পুকুর অথবা যাঁরা আধি নেন, তাঁরা মাছ ধরেন। এরপর যে অংশে মাছ ধরা শেষ হয়, সে অংশে মাছ ধরতে পারেন যে কেউ। প্রথমে যাঁরা মাছ ধরেন, তাঁদের অনেক মাছ ছাড়া পড়ে যায়। এই ছাড়া পড়া মাছ ধরেন তাঁরা। এসব মাছ যে আগে ধরবে, তাঁরই। এর ভাগ কাউকে দিতে হয় না। এভাবে এ মাসজুড়েই মাছ ধরছেন তিনি।
স্থানীয় কয়েকজন বলেন, গ্রামে এখনো গরিব মানুষের কথা ভাবা হয়। পুকুর যাঁর মালিকানায়ই হোক, একবার ধরার পড় সে অংশে মাছ ধরতে পারেন যে কেউ। এটাকে আসলে গরিব মানুষের ‘হক’ হিসেবে দেখা দেয়। এতে পুকুর যাঁদের নেই, তাঁরাও মাছ খাওয়ার স্বাদ পাচ্ছেন।
গাইবান্ধার আসাদুজ্জামান গার্লস হাইস্কুল এন্ড কলেজের সহকারী শিক্ষক জাহাঙ্গীর কবির বলেন, বছর দশেক আগে গ্রামের পুকুর, খালবিলে দেশীয় মাছ অনেক কমে গিয়েছিল। এর ঘাটতি পূরণ করেছে চাষের মাছ। এখন চাষের পাশাপাশি খালবিল, পুকুরে আবার দেশি মাছ ফিরে এসেছে। ফলে মানুষ আবার দেশীয় মাছ খেতে পারছেন।
কুমারগাড়ী গ্রামের বাসিন্দা এই শিক্ষক আরও বলেন, শীত শেষে এই সময় প্রতিবারই পুকুর সেচা যেন উৎসবে পরিণত হয়। এতে শুধু পুকুর মালিকই নয়, গ্রামের অনেকেই অংশগ্রহণ করেন। এতে গরিব-ধনী সকলেরই আমিষের ঘাটতিও অনেকটা পূরণ হয়।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।