ঢাকার উত্তপ্ত দুপুর। গুলশানের একটি ফ্ল্যাটে সায়মা আক্তার জানালার পাশে বসে তাকিয়ে আছেন বাইরের কংক্রিট জঙ্গলের দিকে। ভেতরে অত্যাধুনিক ফার্নিচার, দামি পেইন্টিং, ঝলমলে লাইটিং – সবই আছে। তবুও? একটা অস্থিরতা। একটা শূন্যতা। যেন ঘরটা শুধু দেয়াল আর সাজসজ্জা, প্রাণহীন। হঠাৎ তার চোখ আটকে যায় বুক শেলফে রাখা কুরআন শরীফের উপর। আয়াতুল কুরসির মর্মবাণী মনে পড়ে যায় – আল্লাহই শান্তি। কীভাবে এই শান্তি নামবে আমার নিজের চারদেয়ালের ভেতরে? এই প্রশ্নই তাকে নিয়ে যায় এক অভিনব খোঁজে: ঘর সাজানোর ইসলামিক নিয়ম। শুধু সৌন্দর্য নয়, বরং আধ্যাত্মিক প্রশান্তি ও বরকতের জন্য ঘর গোছানোর সেই সুন্নাহসম্মত পথ। শান্তির সন্ধানে লাখো সায়মার মতো মানুষ আজ ফিরছে ইসলামের সেই মৌলিক ও সহজ নির্দেশনাগুলোর দিকে, যেখানে ঘর শুধু বাসস্থান নয়, হয়ে ওঠে ইবাদত ও প্রশান্তির নীড়।
Table of Contents
ঘর সাজানোর ইসলামিক নিয়ম: শান্তির স্থাপত্যের মূল ভিত্তি
ইসলাম শুধু ইবাদত-বন্দেগির ধর্ম নয়, এটি একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা। প্রতিটি নিঃশ্বাস, প্রতিটি পদক্ষেপ, এমনকি আমরা যেভাবে আমাদের বাসস্থান সাজাই তাও এর অন্তর্ভুক্ত। ঘর সাজানোর ইসলামিক নিয়ম এর কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে তাওহীদ (একত্ববাদের স্বীকৃতি), তাজকিয়া (আত্মশুদ্ধি) এবং বরকত (ঐশ্বরিক অনুগ্রহ লাভ) অর্জনের চেতনা। এটি কেবলমাত্র আসবাবপত্র সাজানোর নিয়মকানুন নয়; এটি একটি মানসিকতা, একটি জীবনদৃষ্টি।
প্রিয় নবী মুহাম্মাদ (সা.) এর জীবনচরিত (সীরাহ) ও সহীহ হাদীস থেকে আমরা পাই ঘর-গৃহস্থালি সংক্রান্ত অসংখ্য মূল্যবান নির্দেশনা। তিনি নিজের ঘরকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে, প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখতে এবং এমন পরিবেশ সৃষ্টি করতে উৎসাহিত করতেন যা ইবাদত ও চিন্তার জন্য অনুকূল। একটি হাদীসে বর্ণিত আছে, নবীজি (সা.) বলেছেন: “নিশ্চয়ই আল্লাহ সুন্দর, তিনি সৌন্দর্যকে ভালোবাসেন।” (সহীহ মুসলিম)। এই ‘সৌন্দর্য’ শুধু বাহ্যিক নয়, তা পরিপূর্ণতা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা এবং ভারসাম্যেরও প্রতীক। ইসলামিক ডেকোরেশনের মূল উদ্দেশ্যই হলো এই আধ্যাত্মিক ও শারীরিক সৌন্দর্যের সমন্বয় ঘটানো, যেখানে দৃষ্টিনন্দনতার পাশাপাশি থাকে আল্লাহর স্মরণ ও আনুগত্যের সুযোগ।
কিছু মৌলিক নীতিমালা যা আপনার ঘর সাজানোর ভিত্তি গড়ে দেবে:
- আল্লাহর একত্বের প্রতিফলন: ঘরের সাজসজ্জায় এমন কিছু রাখা যাবে না যা শির্কের (আল্লাহর সাথে অংশীদারিত্ব) দিকে নিয়ে যায়। যেমন – মূর্তি, প্রাণীর প্রতিকৃতি (মানুষ ছাড়া, তবে তা-ও সতর্কতার সাথে), কিংবা অলৌকিক শক্তি আছে বলে বিশ্বাস করা কোনো বস্তু।
- পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ঈমানের অঙ্গ: হাদীসে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতাকে ঈমানের অঙ্গ বলা হয়েছে। ঘর সাজানোর প্রথম শর্তই হলো নিয়মিত পরিষ্কার করা, জঞ্জাল ও অপ্রয়োজনীয় জিনিস দূর করা। এটি শারীরিক সুস্থতা ও মানসিক স্বস্তির জন্যও অপরিহার্য।
- সাদাসিধে জীবন ও অপচয় রোধ: ইসলাম বাহুল্য ও অপচয়কে (ইসরাফ) নিরুৎসাহিত করে। ঘর সাজানোর ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয়তা, গুণগত মান এবং দীর্ঘস্থায়িত্বকে প্রাধান্য দেয়া উচিত। অতি বিলাসিতা বা শো-অফের মনোভাব পরিহার করুন। কুরআনে বলা হয়েছে, “নিশ্চয়ই অপচয়কারীরা শয়তানের ভাই।” (সূরা আল-ইসরা, ১৭:২৭)।
- গোপনীয়তা ও হিজাবের প্রতি সম্মান: ঘরের ডিজাইনে পরিবারের সদস্যদের গোপনীয়তা (খুসূসিয়াত) রক্ষার দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। জানালায় পর্যাপ্ত পর্দার ব্যবস্থা, রুমের লেআউট এমনভাবে করা যাতে বাইরের দৃষ্টি আটকায় – এগুলো শুধু ইসলামিক বিধানই নয়, পারিবারিক শান্তিরও নিশ্চয়তা দেয়।
- ইবাদতের জন্য নির্দিষ্ট স্থান: ঘরে এমন একটি শান্তিপূর্ণ, পরিষ্কার ও মনোযোগ নিবদ্ধ করার উপযোগী কোণ (মুকাম) রাখা উচিত, যেখানে নামাজ পড়া, কুরআন তিলাওয়াত বা জিকির করা যায়। এই স্থানটিকে বিশেষভাবে সুন্দর ও পবিত্র রাখার চেষ্টা করুন।
এই নীতিগুলোই ইসলামিক হোম ডেকোরেশন-এর মূল কাঠামো গড়ে তোলে, যার লক্ষ্য বাহ্যিক সৌন্দর্যের সাথে আভ্যন্তরীণ প্রশান্তি ও আল্লাহর নৈকট্য অর্জন।
প্রতিদিনের জীবনে ইসলামিক নিয়মে ঘর সাজানো: বাস্তব প্রয়োগ ও টিপস
ঘর সাজানোর ইসলামিক নিয়ম শুধু তত্ত্ব নয়, এটি অতি সহজে দৈনন্দিন জীবনে বাস্তবায়নযোগ্য। ঢাকার ডিজাইনার তাসনিমা হক, যিনি ‘সিরাজ ডিজাইন স্টুডিও’ পরিচালনা করেন, বলছিলেন তার অভিজ্ঞতা: “গত দুই বছরে ঢাকা, চট্টগ্রাম, এমনকি সিলেটের গ্রামাঞ্চল থেকেও অনেকে ইসলামিক থিমে ঘর সাজাতে চান। শুধু মসজিদের মতো ডোম-মিনার নয়, তারা চান এমন একটা স্পেস যেখানে ঢুকলেই শান্তি পাওয়া যায়, ইসলামের মৌলিক নীতিগুলো ফুটে ওঠে সূক্ষ্মভাবে – রং-এর ব্যবহারে, ফার্নিচারের নির্বাচনে, ডিটেইলিং-এ। একজন ক্লায়েন্ট বলেছিলেন, ‘আমার লিভিং রুম যেন আমাকে আল্লাহর জিকিরে উৎসাহিত করে’।
চলুন দেখে নিই কিভাবে ঘরের প্রতিটি কক্ষে ও উপাদানে এই নিয়মগুলো প্রয়োগ করা যায়:
১. রং-এর ভাষা: শান্তি ও প্রাকৃতিকতার প্রতীক (H3)
ইসলামিক ডেকোরেশনে রং নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। উজ্জ্বল, চোখ ধাঁধানো রংয়ের বদলে প্রাকৃতিক, নরম ও শান্তিদায়ক রংকে প্রাধান্য দেয়া হয়।
- সাদা: পবিত্রতা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও শান্তির প্রতীক। দেয়াল, ছাদ বা মূল কাঠামোর জন্য আদর্শ।
- আকাশী নীল ও সবুজ: ইসলামে এই দুই রঙের বিশেষ মর্যাদা আছে। আকাশী নীল প্রশান্তি ও নিস্তব্ধতা আনে। সবুজ (যা বেহেশতের রং) জীবন, তাজা ভাব ও শান্তির প্রতীক। বিছানার চাদর, পর্দা, ছোট আসবাবে ব্যবহার করুন।
- মাটির রং (Beige, Brown, Terracotta): প্রাকৃতিক, উষ্ণ ও স্থিতিশীলতার অনুভূতি দেয়। মেঝে, সোফা, কাঠের ফার্নিচারে চমৎকার মানায়।
- সোনালি বা গোল্ড একসেন্ট: পরিমিতভাবে ব্যবহার করলে বিলাসিতা নয়, বরং উষ্ণতা ও আলোকিত ভাব আনে। ফ্রেম, ল্যাম্প বেস বা ছোটখাটো জিনিসে ব্যবহার করুন।
লাল, কালো বা অতি উজ্জ্বল রং পরিহার করুন বা অতি সীমিতভাবে একসেন্ট হিসেবে ব্যবহার করুন। এগুলো উত্তেজনা বা বিষণ্ণতা তৈরি করতে পারে।
২. আসবাবপত্র: সরলতা, কার্যকারিতা ও গুণগত মান (H3)
আসবাব নির্বাচনে ইসলামিক দর্শন হলো – সাদাসিধে, টেকসই এবং কার্যকরী।
- অতিরিক্ত বাহুল্য বর্জন: শুধুমাত্র প্রয়োজনীয় আসবাব রাখুন। অপ্রয়োজনীয় ড্রয়ার, শোকেস বা সোফা শুধু জায়গা দখলই করে না, পরিষ্কার রাখাও কঠিন করে তোলে।
- প্রাকৃতিক উপাদান: কাঠ, বেত, বাঁশ, পাথর, সুতি কাপড় ইত্যাদি প্রাকৃতিক উপাদানকে প্রাধান্য দিন। এগুলো পরিবেশবান্ধব, টেকসই এবং একটি শান্ত, উষ্ণ আবহ তৈরি করে। প্লাস্টিক বা সিন্থেটিকের বদলে কাঠের টেবিল-চেয়ার, সুতি কাপড়ের সোফা কভার, পাট বা বেতের ঝুড়ি বেছে নিন।
- নিচু আসন: সুন্নাহ অনুযায়ী, নিচে বসা (যেমন মাটিতে বা কার্পেটে) বিনয় ও সহজলভ্যতার প্রতীক। একটি সুন্দর কার্পেট বা দারি (নামাজের চাটাই) এবং কিছু নরম কুশন ব্যবহার করে একটি কোজি এরিয়া তৈরি করা যেতে পারে নামাজ, চা-পান বা আড্ডার জন্য।
- গোপনীয়তার সম্মান: বেডরুমের দরজা-জানালায় ভালো মানের পর্দা ব্যবহার নিশ্চিত করুন। শোবার ঘর ও বাথরুমের লেআউট এমন হওয়া উচিত যাতে গোপনীয়তা রক্ষা পায়।
৩. দেয়াল সজ্জা: আল্লাহর স্মরণ ও ইসলামী শিল্পকলা (H3)
দেয়াল শূন্য রাখা বা শুধু ছবি টাঙানোর বদলে ইসলামী শিল্পকলার সমৃদ্ধ ঐতিহ্যকে কাজে লাগান।
- কালিগ্রাফি (খাত্তাত): আল্লাহর নাম, কুরআনের বাণী বা সুন্দর দু’আর কালিগ্রাফি দেয়ালের শ্রেষ্ঠ সজ্জা। এটি শুধু দৃষ্টিনন্দন নয়, প্রতিদিন আল্লাহর স্মরণের উৎসও বটে। ঢাকার শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন সংগ্রহশালায় প্রাচীন কুরআনিক পাণ্ডুলিপির নিদর্শন দেখা যায়, যা অনুপ্রেরণার উৎস হতে পারে। বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর এর ওয়েবসাইটে ইসলামিক আর্ট বিভাগে কিছু নমুনা পাওয়া যেতে পারে।
- জ্যামিতিক নকশা ও আরবেস্ক: ইসলামিক আর্টে প্রাণীর প্রতিকৃতি নিষিদ্ধ না হলেও সাধারণত জ্যামিতিক নকশা (Geometric Patterns), ফুলেল নকশা (Arabesque) এবং ক্যালিগ্রাফিকেই প্রাধান্য দেয়া হয়। এগুলো অসীমতার ধারণা দেয় এবং আল্লাহর সৃষ্টির জটিলতা ও সৌন্দর্যের প্রতীক। ওয়ালপেপার, টাইলস বা ফ্রেম করা আর্ট পিস হিসেবে ব্যবহার করুন।
- আয়না ব্যবহারে সতর্কতা: আয়না প্রয়োজনীয়, তবে ইসলামিক দৃষ্টিকোণ থেকে অতিরিক্ত আয়না বা এমনভাবে স্থাপন করা যাতে গোপনীয়তা নষ্ট হয় বা অহংবোধ বৃদ্ধি পায়, তা পরিহারযোগ্য।
- প্রাণী বা মানুষের প্রতিকৃতি: স্পষ্টভাবে হারাম হলো কোনো মূর্তি বা পূজার উদ্দেশ্যে তৈরি প্রতিকৃতি রাখা। মানুষের বা প্রাণীর (যার ছায়া আছে) পূর্ণ প্রতিকৃতি রাখা অনেক আলেমের মতে মাকরূহ (অপছন্দনীয়) বা হারামের কাছাকাছি, কারণ তা শির্কের পথ উন্মুক্ত করতে পারে বা অহংকার সৃষ্টি করতে পারে। ছবি রাখতে হলে তা পরিমিতভাবে, প্রয়োজন সাপেক্ষে (যেমন পরিবারের ছবি, তবে শোবার ঘরে নয়), এবং সম্ভব হলে এমনভাবে যেখানে তা সবসময় দৃষ্টিগোচর না হয় বা অত্যাধিক গুরুত্ব না পায়। শিশুদের খেলনা নিয়ে আলাদা আলোচনা আছে (FAQs-এ দেখুন)।
৪. আলোর ব্যবস্থা: প্রাকৃতিক আলো ও কোমল আলোকসজ্জা (H3)
আলো শুধু দৃষ্টিশক্তি নয়, আবহ ও অনুভূতিরও বাহক।
- প্রাকৃতিক আলোর সর্বোচ্চ ব্যবহার: দিনের বেলা জানালা দিয়ে পর্যাপ্ত আলো-বাতাস আসতে দিন। এটি শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য অপরিহার্য এবং বিদ্যুতের অপচয়ও রোধ করে।
- নরম, উষ্ণ কৃত্রিম আলো: রাতে তীব্র সাদা বা নীল আলোর বদলে উষ্ণ সাদা বা হলুদ আভা (Warm White/Yellow) যুক্ত বাল্ব বা ল্যাম্প ব্যবহার করুন। ফ্লোর ল্যাম্প, টেবিল ল্যাম্প বা ওয়াল সকনেস কোমল ও শান্ত পরিবেশ তৈরি করে।
- আলোকসজ্জায় ভারসাম্য: অতিরিক্ত আলো বা জ্বলজ্বলে নিওন লাইট এড়িয়ে চলুন। এগুলো চোখের ক্লান্তি ও মানসিক অস্থিরতা তৈরি করতে পারে।
৫. প্রাকৃতিক উপাদান ও সুগন্ধি: সৃষ্টির সান্নিধ্য (H3)
প্রকৃতির সাথে সংযোগ শান্তি আনে।
- গাছপালা: ছোট-বড় গাছপালা (যেমন – মনি প্ল্যান্ট, স্নেক প্ল্যান্ট, বাসিল, পুদিনা) ঘরে অক্সিজেন বৃদ্ধি করে, সৌন্দর্য বাড়ায় এবং একটি প্রাণবন্ত পরিবেশ তৈরি করে। তবে অতিরিক্ত গাদাগাদি করে রাখবেন না এবং গাছের যত্ন নিন।
- প্রাকৃতিক সুগন্ধি: কৃত্রিম এয়ার ফ্রেশনার বা তীব্র পারফিউমের বদলে প্রাকৃতিক সুগন্ধি ব্যবহার করুন। উড (আগর, চন্দন), বকহুর (মিষ্টি সুগন্ধিযুক্ত কাঠের গুঁড়া), গোলাপ জল, বা লেবু-লবঙ্গ সিদ্ধ করে ঘরে সুবাস ছড়ানো যায়। এগুলো মনকে সতেজ করে এবং ইতিবাচক শক্তি আনে।
- পানি (ফোয়ারা): ছোট ইনডোর ফোয়ারা (যদি জায়গা ও রক্ষণাবেক্ষণ সম্ভব হয়) বা পরিষ্কার পানির পাত্র রাখলে ঘরের শুষ্কতা দূর হয় এবং একটি শান্তির ধ্বনি সৃষ্টি হয়।
পরিশেষে মনে রাখুন: ইসলামিক নিয়মে ঘর সাজানো কোনো কঠোর বিধি-নিষেধের গণ্ডি নয়। এটি একটি দর্শন, যার লক্ষ্য আপনার ব্যক্তিগত নিভৃত কোণটিকে আল্লাহর স্মরণ, পারিবারিক বন্ধন এবং ব্যক্তিগত প্রশান্তির জন্য একটি পবিত্র ও অনুকূল স্থানে পরিণত করা। প্রতিটি পছন্দ – একটি রং, একটি টুকরো ফার্নিচার, দেয়ালে ঝোলানো একটি আয়াত – আপনার বিশ্বাস ও আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন হোক।
মাক্কাহ-মদিনার আলোকে: ঐতিহ্য থেকে আধুনিকতার সেতুবন্ধ
ঘর সাজানোর ইসলামিক নিয়ম এর শিকড় প্রোথিত আছে ইসলামের সূচনালগ্নে, রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নিজের সহজ-সরল জীবনযাপন ও সাহাবায়ে কেরামের আদর্শে। মদীনায় নবীজি (সা.)-এর ঘর ছিল মাটির দেয়াল, খেজুর গাছের ডালের ছাউনি, মেঝেতে বিছানো কার্পেট। সেখানে অত্যাধুনিক আসবাবের ছিটেফোঁটাও ছিল না, কিন্তু ছিল অপরিসীম শান্তি, বরকত ও আল্লাহর রহমতের অনুভূতি। সেই আদর্শের সারমর্মই হলো – সাদাসিধে জীবন, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পরিবেশ, আল্লাহর স্মরণের ব্যবস্থা এবং বিলাসিতা বর্জন।
সময়ের সাথে সাথে ইসলামী সভ্যতা বিকশিত হয়েছে, স্থাপত্য ও শিল্পকলায় অসামান্য নিদর্শন রেখেছে – গ্রানাডার আলহামব্রা, দিল্লির তাজমহল, ইস্তাম্বুলের নীল মসজিদ (সুলতান আহমেদ মসজিদ)। এই স্থাপত্যে জ্যামিতিক নকশা, খাত্তাত (কালিগ্রাফি), আরবেস্ক ফ্লোরাল প্যাটার্ন, অভ্যন্তরীণ উদ্যান (Courtyard), পানি ও আলোর কারুকাজ ব্যবহারের মাধ্যমে এক অনন্য আধ্যাত্মিক ও নান্দনিক আবহ তৈরি করা হয়েছে। এই ঐতিহ্য থেকেই আধুনিক ইসলামিক হোম ডেকোরেশন ধারণাটি শক্তি সঞ্চার করে। এটি অতীতের অনুকরণ নয়, বরং অতীতের মূলনীতিগুলোকে বর্তমানের প্রেক্ষাপটে উপস্থাপন করা।
ঢাকার আঙ্গিনায়: ইসলামিক নকশার সমকালীন ছোঁয়া
বাংলাদেশে, বিশেষ করে ঢাকায়, ধর্মীয় চেতনার সাথে আধুনিকতার মেলবন্ধন ঘটাতে চাওয়া পরিবারের সংখ্যা বাড়ছে। স্থাপত্যবিদ ও অভ্যন্তরীণ নকশাবিদ (Interior Designer) রফিকুল ইসলাম তার ‘আল-নূর ডিজাইন হাব’-এ বলছিলেন, “আজকাল অনেকেই চান তাদের বাসার পরিবেশ যেন তাদের ঈমানী চেতনাকে জাগ্রত রাখে। শুধু মধ্যপ্রাচ্যের স্টাইল কপি করাই নয়, তারা চান বাংলার নিজস্ব সংস্কৃতি ও উপকরণের সমন্বয়ে ইসলামের মূল নীতিগুলো ফুটে উঠুক। যেমন – মাটির হাঁড়ি, পাটের শিকা, নকশিকাঁথার মোটিফ, সাথে কুরআনের আয়াতের সুন্দর ক্যালিগ্রাফি। এটা একটা গর্বের বিষয় যে ইসলামিক হোম ডেকোর ধারণা এখানে শেকড় গাড়ছে।”
গুলশান, বারিধারা বা উত্তরা থেকে শুরু করে ধানমন্ডি বা পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী বাড়িগুলোতেও এই ট্রেন্ড লক্ষ্য করা যায়। অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলোতে ‘ইসলামিক ডেকোরেশন আইডিয়া’ বা ‘হালাল হোম ডিজাইন’ এর সার্চও বেড়েছে। এটি শুধু একটি নান্দনিক পছন্দ নয়, বরং আধ্যাত্মিক শান্তি ও পারিবারিক বরকতের আকাঙ্ক্ষারই বহিঃপ্রকাশ।
জেনে রাখুন (FAQs)
১. ইসলামে ঘরে প্রাণীর ছবি বা মূর্তি রাখা কি সম্পূর্ণ হারাম?
উত্তর: মূর্তি বা পূজার উদ্দেশ্যে তৈরি কোনো প্রতিকৃতি রাখা ইসলামে সম্পূর্ণ হারাম (নিষিদ্ধ), কারণ তা শির্কের (আল্লাহর সাথে অংশীদারিত্ব) দিকে নিয়ে যায়। সাধারণ প্রাণী বা মানুষের পূর্ণ প্রতিকৃতি (যার ছায়া আছে) রাখা অধিকাংশ ইসলামিক স্কলারের মতে মাকরূহ (অপছন্দনীয়) বা নিষিদ্ধের কাছাকাছি। কারণ এগুলো অহংকার সৃষ্টি করতে পারে বা শির্কের পথ প্রশস্ত করতে পারে। তবে, প্রয়োজন সাপেক্ষে (যেমন শিক্ষামূলক, স্মৃতিচারণ বা শিশুদের জন্য), অপ্রয়োজনীয় গুরুত্ব না দিয়ে এবং সম্ভব হলে মাথাবিহীন বা অসম্পূর্ণ রূপে (যেমন ছবি কেটে ফেলা) রাখা যায়, তবে সর্বোত্তম হলো তা পরিহার করা। ল্যান্ডস্কেপ, ফুল বা জ্যামিতিক নকশা নিরাপদ ও সুন্দর বিকল্প। শিশুদের খেলনা নিয়ে আলেমদের মধ্যে কিছুটা ভিন্ন মত থাকলেও শিক্ষামূলক ও কল্পনাশক্তির বিকাশের জন্য সাধারণত অনুমতি রয়েছে, তবে পূজার মূর্তি বা জীবন্ত প্রাণীর আদলে তৈরি খুব রিয়েলিস্টিক ডল এড়ানো উচিত।
২. ঘর সাজানোর জন্য ইসলামে বিশেষ কোন দোয়া বা আমল কি আছে?
উত্তর: হ্যাঁ, কিছু গুরুত্বপূর্ণ আমল ও দু’আ রয়েছে:
- নতুন ঘরে প্রবেশের সময় বা সাধারণভাবে ঘরকে শয়তানের অনিষ্ট থেকে রক্ষার জন্য সূরা বাকারার শেষ দুটি আয়াত (আয়াতুল কুরসি সহ) এবং সূরা বাকারা, আলে ইমরান, সূরা নাস ও সূরা ফালাক পড়া সুন্নাহ।
- ঘর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা নিজেই একটি ইবাদত ও দু’আ কবুলের শর্ত।
- ঘরে নিয়মিত কুরআন তিলাওয়াত করা, জিকির করা, নামাজ প্রতিষ্ঠা করা – এগুলোই ঘরকে আলোকিত করে এবং বরকত আনে।
- ঘরে প্রবেশ ও বের হওয়ার সময় সালাম দেওয়া এবং দু’আ পড়া (বিসমিল্লাহি তাওয়াক্কালতু আলাল্লাহ… ইত্যাদি)।
৩. ইসলামিক নিয়মে ঘর সাজাতে গেলে কি খুব বেশি খরচ হয়? বাজেটে কি সম্ভব?
উত্তর: একেবারেই না। ঘর সাজানোর ইসলামিক নিয়ম এর মূলে আছে সাদাসিধে জীবন ও অপচয় রোধ (ইসরাফ)। এটি বরং খরচ কমাতে সাহায্য করে:
- শুধু প্রয়োজনীয় জিনিস কেনা। অপ্রয়োজনীয় ডেকোরেটিভ আইটেমে টাকা নষ্ট না করা।
- প্রাকৃতিক ও স্থানীয় উপকরণ (কাঠ, বাঁশ, বেত, পাট, মাটির পাত্র) ব্যবহারে খরচ কমে এবং স্থায়িত্ব বাড়ে।
- পুরানো জিনিস রিসাইকেল বা রিফার্বিশ করে নতুনভাবে ব্যবহার করা যায় (সুন্নাহতে পুরানো জিনিসের কদর আছে)।
- মূল্যবান কালিগ্রাফি বা আর্টওয়ার্ক না কিনে, নিজেরা সৃজনশীল হতে পারেন বা স্থানীয় শিল্পীদের সহজ ডিজাইন দিয়ে তৈরি করাতে পারেন।
লক্ষ্য হওয়া উচিত গুণগত মান ও দীর্ঘস্থায়িত্ব, পরিমাণ নয়।
৪. ইসলামিক ডেকোরেশনে পোষা প্রাণী রাখা যাবে কি?
উত্তর: ইসলামে সাধারণত শিকারের কুকুর, ফসল বা পশুরক্ষার কুকুর ছাড়া ঘরের ভেতর কুকুর রাখা নিরouraged করা হয় না, কারণ ফেরেশতা (রহমতের ফেরেশতা) তাদের থাকা ঘরে প্রবেশ করেন না বলে হাদীসে উল্লেখ আছে (সহীহ বুখারী ও মুসলিম)। বিড়াল সম্পর্কে কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই; বরং বিড়াল পোষা সুন্নাহ। রাসূলুল্লাহ (সা.) এর প্রিয় বিড়াল ছিল মuezযা। তবে পোষা প্রাণী যেখানেই রাখুন, তার পরিচ্ছন্নতা ও যত্নের দায়িত্ব নিতে হবে এবং ঘরের পবিত্রতা (বিশেষ করে নামাজের স্থান) বজায় রাখতে হবে।
৫. ইসলামে “বাস্তু দোষ” বা জ্যোতিষশাস্ত্রের ভিত্তিতে ঘর সাজানোর কী বিধান?
উত্তর: ইসলামে ভাগ্য বা শুভ-অশুভ নির্ধারণের জন্য জ্যোতিষশাস্ত্র, বাস্তু, ফেং শুই বা এ ধরনের বিশ্বাসে আস্থা রাখা শির্ক (আল্লাহর সাথে অংশীদারিত্ব) এবং সম্পূর্ণ হারাম। আল্লাহই একমাত্র মালিক ও সকল কল্যাণ-অকল্যাণের নিয়ন্ত্রক। ঘর সাজানোর ক্ষেত্রে এসব কুসংস্কার ও ভিত্তিহীন ধারণা পরিত্যাগ করতে হবে। শান্তি ও বরকত কামনা করতে হবে একমাত্র আল্লাহর কাছে, নির্দিষ্ট দিকে মাথা রেখে ঘুমানো বা বিশেষ রঙের ব্যবহার ইত্যাদির মাধ্যমে নয়। ঘরের সুব্যবস্থা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা এবং আল্লাহর জিকিরই প্রকৃত কল্যাণ ও শান্তির উৎস।
৬. শিশুদের ঘর বা প্লে এরিয়া কিভাবে ইসলামিক নিয়মে সাজাবো?
উত্তর: শিশুদের ঘরও ইসলামিক মূল্যবোধ শেখানোর সুযোগ।
- রং-এর ব্যবহার উজ্জ্বল ও প্রাণবন্ত হতে পারে, তবে প্রাকৃতিক টোনই ভালো (সবুজ, নীল, হলুদ)।
- দেয়ালে ইসলামিক শিক্ষামূলক পোস্টার, সহজ ক্যালিগ্রাফি (আল্লাহ, বিসমিল্লাহ), নবী-রাসূলদের গল্পের ছবি (প্রতিকৃতি নয়, বরং প্রতীকী বা ল্যান্ডস্কেপ সহ) রাখতে পারেন।
- খেলনা নির্বাচনে শিক্ষামূলক জিনিস (ব্লক, পাজল, ইসলামিক স্টোরি বুক), সাধারণ ডল, সফট টয়, ক্রাফট সামগ্রীকে প্রাধান্য দিন। খুব রিয়েলিস্টিক প্রাণী বা মানুষের ডল এড়িয়ে চলুন।
- একটি ছোট্ট নামাজের চাটাই বা কার্পেট এবং সহজ দু’আ/সুরার চার্ট রাখুন।
- সর্বোপরি, ঘরটি রাখুন পরিষ্কার, নিরাপদ এবং খেলার জন্য পর্যাপ্ত খালি জায়গা রেখে।
(Final Paragraph – No Heading)
ঘর সাজানোর ইসলামিক নিয়ম, তাই কেবল নান্দনিকতার সীমানা ছাড়িয়ে, আমাদের টেনে নিয়ে যায় এক গভীরতর জীবনবোধের দিকে – যেখানে চারদেয়ালের মধ্যে লুকিয়ে থাকে আল্লাহর রহমতের ছায়া, প্রতিটি কোণ মুখরিত হয় শান্তির ধ্বনিতে, আর প্রতিদিনের জীবন হয়ে ওঠে ইবাদতের এক সুন্দর ধারাবাহিকতা। এটি কোনো স্টাইল স্টেটমেন্ট নয়; এটি একান্তই হৃদয়ের অন্বেষণ, সেই নিভৃত আশ্রয়ের, যেখানে আত্মা পায় সত্যিকারের প্রশান্তি। সায়মার মতো আপনার ঘরও যখন ইসলামের আলোকে সাজবে, তখন সেখানে শুধু আসবাবপত্র নয়, বরং বিরাজ করবে এক অনির্বচনীয় শান্তি ও বরকতের পরশ। আপনার ঘরকে শুধু বাসস্থান নয়, বানিয়ে তুলুন আধ্যাত্মিক শান্তি ও পারিবারিক বন্ধনের পবিত্র নীড়। আজই শুরু করুন – ছোট্ট একটি পরিবর্তন, একটি আয়াতের ফ্রেম, একটি গাছের টব, অপ্রয়োজনীয় জিনিস সরানো – আপনার ঘরে ইসলামের সুশীতল ছায়া বুলিয়ে দিতে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।