রাতের নিস্তব্ধতা। শুধু টিকটিক শব্দ আর নিজেরই দ্রুত গতিতে ছুটে চলা চিন্তার ঘোড়দৌড়। বিছানায় এপাশ-ওপাশ। চোখের পাতা ভারী, কিন্তু মাথাটা যেন এক তরঙ্গায়িত সমুদ্র – অতীতের আক্ষেপ, ভবিষ্যতের দুশ্চিন্তা, আজকের অসম্পূর্ণ কাজের ঢেউয়ে আছড়ে পড়ছে অবিরাম। ঘুম আসছে না। শুধুই ক্লান্তি আর হতাশার গাঢ় অন্ধকারে ডুবে যাওয়ার অনুভূতি। এই পরিচিত দৃশ্য, এই যন্ত্রণা কি আপনারও প্রতিদিনের সঙ্গী? যদি হয়, তবে জেনে রাখুন, আপনি একা নন। কিন্তু আর নয়! ঘুমানোর আগে মস্তিষ্ক ঠান্ডা করার উপায় জানা থাকলে এই যুদ্ধে জয় আপনার হাতের মুঠোয়। শান্তিতে ঘুমানোর পথ খুলে যাবে সহজেই।
“ঘুমানোর আগে মস্তিষ্ক ঠান্ডা করার সেরা উপায়গুলি কী কী?” – বিজ্ঞান ও অভিজ্ঞতার আলোকে
“ঘুম আসে না” – এই সরল বাক্যটির পিছনে লুকিয়ে থাকে মস্তিষ্কের জটিল কার্যকলাপ। আমাদের মস্তিষ্ক সারাদিন ‘ফাইট অর ফ্লাইট’ মোডে কাজ করে। মানসিক চাপ, উদ্বেগ, অতিরিক্ত কাজের চাপ – এই সবকিছুই মস্তিষ্কে কর্টিসল নামক স্ট্রেস হরমোনের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। এই উত্তেজিত অবস্থায় ঘুমের জন্য প্রয়োজনীয় ‘রেস্ট অ্যান্ড ডাইজেস্ট’ মোডে প্রবেশ করা মস্তিষ্কের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ে। ঘুমানোর আগে মস্তিষ্ক ঠান্ডা করার মূল লক্ষ্যই হলো এই উত্তেজনা প্রশমিত করে মস্তিষ্ককে শান্ত, নিরাপদ ও ঘুমের জন্য প্রস্তুত অবস্থায় নিয়ে আসা। এটি কোনো বিলাসিতা নয়, বরং শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার জন্য অপরিহার্য।
সন্ধ্যা ৭টার পর ‘ডিজিটাল ডিটক্স’ বাধ্যতামূলক করুন: আমাদের সময়ের সবচেয়ে বড় ঘুমের শত্রু হলো নীল আলো (Blue Light)। স্মার্টফোন, ট্যাবলেট, ল্যাপটপ, টেলিভিশনের স্ক্রিন থেকে নির্গত এই নীল আলো সরাসরি আমাদের মস্তিষ্কের পিনিয়াল গ্রন্থিকে প্রভাবিত করে। এই গ্রন্থিই মেলাটোনিন নামক ‘ঘুমের হরমোন’ নিঃসরণ করে। নীল আলো মেলাটোনিন উৎপাদনকে উল্লেখযোগ্যভাবে (কিছু গবেষণা অনুযায়ী ৫০% পর্যন্ত!) কমিয়ে দেয়। জন হপকিন্স মেডিসিনের নিউরোলজি বিভাগের বিশেষজ্ঞ ডা. রাচেল সালাস বলেছেন, “বিছানায় যাওয়ার কমপক্ষে ১-২ ঘন্টা আগে সব ডিজিটাল ডিভাইস বন্ধ করা উচিত। স্ক্রিনের আলো মস্তিষ্ককে ধোঁকা দেয় যে এখনও দিন আছে, ফলে ঘুমের প্রাকৃতিক চক্র ব্যাহত হয়।” বিকল্প হিসেবে বই পড়ুন (কাগজের বই), হালকা গান শুনুন (বিনা স্ক্রিনে), পরিবারের সাথে আড্ডা দিন, বা ধ্যান করুন। এটিই ঘুমানোর আগে মস্তিষ্ক ঠান্ডা করার প্রথম ও গুরুত্বপূর্ণ ধাপ।
‘উইন্ড ডাউন রুটিন’ তৈরি করুন: মস্তিষ্ককে শান্তির সংকেত দিন: দিনের উত্তেজনাপূর্ণ কার্যকলাপ থেকে সরাসরি বিছানায় গেলে মস্তিষ্কের পক্ষে দ্রুত শান্ত হওয়া সম্ভব নয়। দরকার একটি শান্তিপূর্ণ রূপান্তর পর্ব, যাকে বলা হয় ‘স্লিপ রুটিন’ বা ‘উইন্ড ডাউন রুটিন’। এই রুটিনের লক্ষ্য মস্তিষ্ককে বারবার একই সংকেত দেওয়া যে এখন ঘুমের সময় আসছে। এটি মস্তিষ্ককে শর্তসাপেক্ষ করে তোলে (কন্ডিশনড রেসপন্স) এবং ধীরে ধীরে উত্তেজনা কমাতে সাহায্য করে। আপনার রুটিনে অন্তর্ভুক্ত করুন:
- হালকা গরম পানিতে গোসল (১০-১৫ মিনিট): শরীরের তাপমাত্রা সামান্য বাড়িয়ে তারপর ধীরে ধীরে নামার প্রক্রিয়া মেলাটোনিন নিঃসরণে সাহায্য করে এবং গভীর পেশী শিথিলকরণে ভূমিকা রাখে। গবেষণা (জার্নাল অফ স্লিপ রিসার্চ) দেখায়, ঘুমানোর ১-২ ঘন্টা আগে গোসল ঘুমের গুণগত মান বাড়াতে পারে।
- হালকা স্ট্রেচিং বা ইয়োগা (যেমন: চাইল্ড’স পোজ, লেগস আপ দ্য ওয়াল): কঠিন ব্যায়াম নয়, কেবলমাত্র এমন কিছু যা পেশীর জমাট ভাব দূর করবে এবং শ্বাস-প্রশ্বাসকে ধীর ও গভীর করবে। যোগব্যায়ামের সুনিদ্রা-সহায়ক ভূমিকা নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. তাহমিনা আক্তার উল্লেখ করেন, “সন্ধ্যায় মাত্র ১০-১৫ মিনিটের হালকা ইয়োগা, বিশেষ করে শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম (প্রাণায়াম), স্নায়ুতন্ত্রকে শান্ত করে উদ্বেগ কমাতে এবং ঘুমের প্রস্তুতিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে।”
- নির্দিষ্ট সময়ে বিছানায় যাওয়া: প্রতিদিন একই সময়ে (সাপ্তাহিক ছুটির দিনেও!) বিছানায় যাওয়ার চেষ্টা করুন। এটি আপনার শরীরের অভ্যন্তরীণ ঘড়ি (সার্কাডিয়ান রিদম) কে নিয়ন্ত্রণে রাখে।
- শান্ত পরিবেশ সৃষ্টি: আলো কমিয়ে দিন, আরামদায়ক তাপমাত্রা বজায় রাখুন (সাধারণত ১৮-২২°C আদর্শ), আরামদায়ক পোশাক পরুন।
চিন্তার বন্যা থামান: জার্নালিং ও মাইন্ডফুলনেস: সারাদিনের চিন্তা, আগামীকালের টেনশন, অসম্পূর্ণ কাজের তালিকা – এগুলোই ঘুমের পথে সবচেয়ে বড় বাধা। এই চিন্তার স্রোতকে থামানোর দুটি শক্তিশালী হাতিয়ার:
- ব্রেইন ডাম্প জার্নালিং: বিছানায় যাওয়ার ৩০ মিনিট থেকে ১ ঘন্টা আগে একটি নোটবুক বা ডায়েরি হাতে নিন। মাথায় যত চিন্তা, দুশ্চিন্তা, পরের দিনের টু-ডু লিস্ট, এমনকি যা যা ভালো লেগেছে তা-ও লিখে ফেলুন। উদ্দেশ্য হলো মস্তিষ্ক থেকে সেই সব চিন্তাকে বের করে কাগজে স্থানান্তর করা। লিখে ফেলার পর মানসিকভাবে নিজেকে বলুন, “এগুলো আমি লিখে রেখেছি, এখন এদের নিয়ে ভাবার দরকার নেই। আগামীকাল এগুলো দেখব।” আমেরিকান সাইকোলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন (APA) জার্নালিংকে স্ট্রেস ম্যানেজমেন্টের একটি কার্যকর টুল হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।
- মাইন্ডফুলনেস মেডিটেশন বা গাইডেড ইমেজারি: শান্ত হয়ে বসে বা শুয়ে চোখ বন্ধ করুন। শ্বাস-প্রশ্বাসের উপর ফোকাস করুন। শ্বাস নেওয়া আর ছাড়ার অনুভূতিকে লক্ষ্য করুন। যখনই মন অন্য কোথাও চলে যায় (যাবে বারবার!), সজ্ঞানে তাকে আবার শ্বাসের কাছে ফিরিয়ে আনুন। অথবা, শান্তিপূর্ণ কোনো স্থানের (সমুদ্র সৈকত, সবুজ বন, শৈশবের বাড়ির উঠোন) ছবি মনে করুন এবং সেই পরিবেশের শব্দ, গন্ধ, অনুভূতির কথা কল্পনা করুন। অ্যাপস যেমন ‘Headspace’, ‘Calm’ (ইংরেজি) বা ‘দেহ’ (বাংলা) এ ধরনের গাইডেড মেডিটেশনের সহায়তা করতে পারে। নিয়মিত অভ্যাস মস্তিষ্কের ‘ডিফল্ট মোড নেটওয়ার্ক’-কে শান্ত করে, যা অতিরিক্ত চিন্তার জন্য দায়ী।
শ্বাস-প্রশ্বাসের জাদু: শক্তিশালী কিন্তু সহজ কৌশল: শ্বাস-প্রশ্বাস আমাদের শরীরের এমন একটি কার্যক্রম যা স্বয়ংক্রিয়ও বটে, আবার ইচ্ছাকৃতভাবে নিয়ন্ত্রণও করা যায়। গভীর, ধীর শ্বাস-প্রশ্বাস সরাসরি ভেগাস নার্ভকে উদ্দীপিত করে, যা প্যারাসিম্প্যাথেটিক নার্ভাস সিস্টেমকে সক্রিয় করে – অর্থাৎ ‘রেস্ট অ্যান্ড ডাইজেস্ট’ মোড চালু হয়। হার্ট রেট ও ব্লাড প্রেসার কমে, মাংসপেশি শিথিল হয়। ঘুমানোর আগে মস্তিষ্ক ঠান্ডা করার জন্য চেষ্টা করুন:
- ৪-৭-৮ পদ্ধতি: জিভের ডগাকে উপরের দাঁতের পেছনের মাড়িতে স্পর্শ করিয়ে রাখুন। নাক দিয়ে ৪ সেকেন্ড ধরে গভীর শ্বাস নিন। শ্বাস ৭ সেকেন্ড ধরে রাখুন। মুখ দিয়ে ৮ সেকেন্ড ধরে ফুঁ দিয়ে শ্বাস ছাড়ুন। এই চক্রটি ৪ বার পুনরাবৃত্তি করুন।
- ডায়াফ্রাগমেটিক ব্রিদিং (বেলি ব্রিদিং): এক হাত বুকের উপর, অন্য হাত পেটের উপর রাখুন। নাক দিয়ে ধীরে ধীরে শ্বাস নিন, যাতে পেটের উপর রাখা হাতটি উপরের দিকে উঠে (বুকের হাতটি যথাসম্ভব স্থির থাকে)। মুখ দিয়ে ধীরে ধীরে শ্বাস ছাড়ুন, পেটের হাতটি নিচে নামবে। এটি পেট দিয়ে শ্বাস নেওয়ার অনুশীলন। প্রতিদিন মাত্র ৫-১০ মিনিট অভ্যাস করলেই উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসবে।
পরিবেশকে ঘুম-বান্ধব করুন: আপনার শান্তির আশ্রয় গড়ে তুলুন: আপনার শোবার ঘর শুধু ঘুম (ও ঘনিষ্ঠতা) এর জন্যই উৎসর্গীকৃত হওয়া উচিত। বিছানায় গিয়ে কাজ করা, ল্যাপটপ ব্যবহার করা, বা মুভি দেখা এড়িয়ে চলুন। এই জায়গাটিকে মস্তিষ্কের কাছে শুধুমাত্র ঘুম ও বিশ্রামের স্থান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করুন।
- আলো: সম্পূর্ণ অন্ধকার আদর্শ। যদি সম্ভব না হয়, খুব মৃদু, লাল বা কমলা বর্ণের (নীল আলো নয়) নাইট ল্যাম্প ব্যবহার করুন। ভারি পর্দা ব্যবহার করুন যাতে বাইরের আলো ঢুকতে না পারে।
- শব্দ: যতদূর সম্ভব নীরবতা বজায় রাখুন। যদি বাইরের শব্দ (যানবাহন, প্রতিবেশী) সমস্যা হয়, হোয়াইট নয়েজ মেশিন, ফ্যান চালানো, বা ইয়ারপ্লাগ ব্যবহার করুন। হোয়াইট নয়েজ অনাকাঙ্ক্ষিত শব্দকে ড্রাউন আউট করে ঘুমে সাহায্য করতে পারে।
- তাপমাত্রা ও বায়ু চলাচল: শীতল পরিবেশ ঘুমের জন্য সহায়ক। একটি পাখা বা এসি ব্যবহার করুন। ঘরে পর্যাপ্ত বায়ু চলাচলের ব্যবস্থা রাখুন।
- আরাম: একটি ভালো মানের গদি, বালিশ এবং নরম চাদর-তোশক জড়িয়ে থাকার অনুভূতি (যা নিরাপত্তাবোধ জাগায়) গুরুত্বপূর্ণ। বালিশের উচ্চতা ও ধরন আপনার ঘুমানোর ভঙ্গির (পিঠ, পেট বা কাত) সাথে মিলিয়ে নিন।
- দৈনন্দিন অভ্যাসের প্রভাব: যা সারাদিন করবেন, তাই রাতে ফিরে পাবেন: ঘুমানোর আগে মস্তিষ্ক ঠান্ডা করার চেষ্টা কেবল সন্ধ্যায় সীমাবদ্ধ রাখলে তা পুরোপুরি কার্যকর নাও হতে পারে। সারাদিনের কিছু অভ্যাস মস্তিষ্কের উত্তেজনার মাত্রাকে প্রভাবিত করে:
- ক্যাফেইন ও নিকোটিন সীমিত করুন: কফি, চা (বিশেষ করে ব্ল্যাক টি), কোলা, এনার্জি ড্রিংক এবং ধূমপান (সিগারেট, জর্দা) মস্তিষ্ককে উত্তেজিত করে। দুপুরের পর (বিকাল ২-৩টার পর) এসব গ্রহণ একেবারে বন্ধ করে দিন। ক্যাফেইনের প্রভাব ৬-৮ ঘন্টা পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে।
- দুপুরের ঘুমের সময়কাল ও সময়সীমা: দুপুরে ২০-৩০ মিনিটের হালকা ন্যাপ (পাওয়ার ন্যাপ) রিফ্রেশিং হতে পারে। কিন্তু দীর্ঘ সময় (৪৫ মিনিটের বেশি) ঘুমানো বা বিকাল ৩টার পর ঘুমানো রাতের ঘুমে ব্যাঘাত ঘটাতে পারে।
- নিয়মিত ব্যায়াম, তবে সময় দেখে: নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রম (সকাল বা বিকালে) গভীর ঘুমে সহায়তা করে। তবে ঘুমানোর ২-৩ ঘন্টা আগে কঠোর ব্যায়াম এড়িয়ে চলুন। এতে শরীরের তাপমাত্রা ও হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়, যা ঘুম আসতে বাধা দেয়। সন্ধ্যায় হালকা হাঁটা বা ইয়োগা ভালো বিকল্প।
- রাতের খাবার হালকা ও সময়মতো: ভারী, মশলাদার বা তৈলাক্ত খাবার এবং অতিরিক্ত চিনি রাতে এড়িয়ে চলুন। হজমের সমস্যা ও অম্বল ঘুমে ব্যাঘাত ঘটায়। ঘুমানোর কমপক্ষে ২-৩ ঘন্টা আগে রাতের খাবার সেরে ফেলার চেষ্টা করুন। তবে খালি পেটেও শোয়া ঠিক নয়; হালকা কিছু (এক গ্লাস উষ্ণ দুধ, ছোট একটি কলা) খেতে পারেন।
- তরল গ্রহণ সন্ধ্যা থেকে নিয়ন্ত্রণ করুন: ঘুমানোর ঠিক আগে প্রচুর পানি পান করলে রাতে টয়লেটে যাওয়ার জন্য ঘুম ভেঙে যেতে পারে। সন্ধ্যার পর তরল গ্রহণ পরিমিত করুন।
কখনও কখনও পেশাদার সাহায্য জরুরি
উপরের সবকিছু নিয়মিত চেষ্টা করার পরও যদি এক মাসের বেশি সময় ধরে সপ্তাহে তিন বা তার বেশি রাত ভালো ঘুম না হয়, দিনের বেলা ক্লান্তি, মনোযোগের অভাব, মেজাজ খিটখিটে হয়ে থাকা বা কাজে ভুল হওয়া ইত্যাদি সমস্যা দেখা দেয়, তাহলে এটি ইনসোমনিয়ার লক্ষণ হতে পারে। দীর্ঘস্থায়ী ইনসোমনিয়া শুধু ক্লান্তিই দেয় না, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, স্থূলতা, বিষণ্ণতা ও উদ্বেগের ঝুঁকিও বাড়ায়। এমন অবস্থায় একজন চিকিৎসক (জেনারেল ফিজিশিয়ান) বা একজন নিদ্রা বিশেষজ্ঞের (স্লিপ স্পেশালিস্ট) পরামর্শ নেওয়া আবশ্যক। তারা অন্তর্নিহিত শারীরিক বা মানসিক কারণ (যেমন: স্লিপ অ্যাপনিয়া, রেস্টলেস লেগ সিনড্রোম, হতাশা, দীর্ঘস্থায়ী ব্যথা, থাইরয়েড সমস্যা) চিহ্নিত করে উপযুক্ত চিকিৎসা পরিকল্পনা করতে পারবেন। জটিল ক্ষেত্রে কগনিটিভ বিহেভিওরাল থেরাপি ফর ইনসোমনিয়া (CBT-I) নামক একটি অত্যন্ত কার্যকর থেরাপি দেওয়া হয়, যা ঘুমের অভ্যাস ও ঘুম-সংক্রান্ত নেতিবাচক চিন্তা ধরণ পরিবর্তনে সাহায্য করে। ঢাকার জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল বা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (BSMMU) স্লিপ মেডিসিন ক্লিনিক এ ধরনের সেবা প্রদান করে।
জেনে রাখুন (FAQs)
প্রশ্ন: ঘুমানোর আগে কি গরম দুধ খাওয়া সত্যিই কাজ করে?
উত্তর: হ্যাঁ, কিছুটা সাহায্য করতে পারে। দুধে ট্রিপটোফ্যান নামক একটি অ্যামিনো অ্যাসিড থাকে, যা সেরোটোনিন এবং পরে মেলাটোনিন তৈরি করতে সহায়তা করে। তবে শুধু দুধের উপর ভরসা না করে একে আপনার সন্ধ্যার রুটিনের (যেমন: বই পড়ার সময়, ধ্যানের আগে) একটি অংশ হিসেবে নিন। উষ্ণতা শরীরকে শিথিল করতে এবং মনকে শান্ত করতে সাহায্য করে। চিনি পরিমিত রাখুন।প্রশ্ন: রাতে বারবার ঘুম ভেঙে যাওয়া ঠেকাতে ঘুমানোর আগে মস্তিষ্ক ঠান্ডা করার উপায় কী?
উত্তর: বারবার ঘুম ভাঙার পেছনে চাপ বা উদ্বেগ বড় কারণ হতে পারে। দিনের বেলায় নিয়মিত ব্যায়াম করুন। ঘুমানোর আগে স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট কৌশল (জার্নালিং, মাইন্ডফুলনেস, ৪-৭-৮ শ্বাস) খুব গুরুত্বপূর্ণ। ঘুম থেকে উঠে যদি আবার ঘুম না আসে, বিছানা ছেড়ে অন্য ঘরে গিয়ে হালকা আলোয় বই পড়ুন বা শান্ত কিছু করুন। ঘুম পেলে তবেই বিছানায় ফিরুন। বারবার ঘড়ি দেখবেন না, এতে উদ্বেগ বাড়ে।প্রশ্ন: কাজের চাপে রাতে মাথা ঠান্ডা রাখতে পারি না। দ্রুত সমাধান চাই?
উত্তর: দ্রুত ফলাফলের জন্য ‘শ্বাসের ব্যায়াম’ সবচেয়ে কার্যকর হাতিয়ার। ৪-৭-৮ পদ্ধতি বা বেলি ব্রিদিং দ্রুত প্যারাসিম্প্যাথেটিক সিস্টেমকে সক্রিয় করে। ৫-১০ মিনিটের একটি গাইডেড বডি স্ক্যান মেডিটেশন (ইউটিউবে পাওয়া যায়) দ্রুত শরীরের টান ভাঙতে সাহায্য করে। তবে দীর্ঘমেয়াদে নিয়মিত স্লিপ রুটিন, ডিজিটাল ডিটক্স এবং স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট কৌশল রপ্ত করাই স্থায়ী সমাধান।প্রশ্ন: ঘুমের ওষুধ (স্লিপিং পিল) নেওয়া কি নিরাপদ?
উত্তর: চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোনো ঘুমের ওষুধ, এমনকি হোমিওপ্যাথিক বা হার্বাল সাপ্লিমেন্টও দীর্ঘমেয়াদে নেওয়া বিপজ্জনক হতে পারে। এগুলো নির্ভরশীলতা তৈরি করতে পারে এবং প্রাকৃতিক ঘুমের চক্রকে বিঘ্নিত করে। এগুলো শুধুমাত্র অল্প সময়ের জন্য এবং চিকিৎসকের কঠোর তত্ত্বাবধানে নেওয়া উচিত। ঘুমানোর আগে মস্তিষ্ক ঠান্ডা করার প্রাকৃতিক উপায়গুলোই সবচেয়ে নিরাপদ ও স্থায়ী সমাধানের পথ।- প্রশ্ন: সারাদিন ঘুম পায়, কিন্তু রাতে শুয়ে চোখে ঘুম আসে না। কারণ কী?
উত্তর: এর পেছনে বেশ কিছু কারণ থাকতে পারে। সারাদিনের ক্লান্তি অতিরিক্ত চাপ বা মানসিক চাপের লক্ষণ হতে পারে। দিনের বেলা ঘুমানো (বিশেষ করে দীর্ঘক্ষণ বা বিকালে) রাতের ঘুম নষ্ট করতে পারে। অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস বা ক্যাফেইন/নিকোটিনের প্রভাবও থাকতে পারে। আরেকটি বড় কারণ হতে পারে ‘স্লিপ হাইজিন’ এর অভাব – অনিয়মিত ঘুমের সময়, বিছানায় কাজ করা ইত্যাদি। আপনার দৈনন্দিন অভ্যাস (ঘুম, খাওয়া, চা-কফি, স্ক্রিন টাইম) ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করুন এবং প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
আপনার ঘুম শুধু বিশ্রাম নয়, সেটি আপনার সারা দিনের শক্তি, মনোযোগ, সৃজনশীলতা এবং সামগ্রিক সুস্থতার ভিত্তি। ঘুমানোর আগে মস্তিষ্ক ঠান্ডা করার উপায় গুলোকে আয়ত্তে আনুন – ডিজিটাল ডিটক্স, উইন্ড ডাউন রুটিন, জার্নালিং, গভীর শ্বাস-প্রশ্বাস, মাইন্ডফুলনেস – এই সহজ কিন্তু শক্তিশালী কৌশলগুলোই পারে আপনার মস্তিষ্কের অশান্ত তরঙ্গকে শান্ত করে দিতে। আজ রাত থেকেই একটি উপায় বেছে নিয়ে শুরু করুন। একটানা চেষ্টা করুন। ধৈর্য্য ধরুন। মনে রাখবেন, সুস্থ ঘুম কোনও বিলাসিতা নয়, আপনার শরীর ও মনের মৌলিক অধিকার। আপনার মস্তিষ্ককে সেই শান্তির উপহার দিন, যা তাকে সারারাত ধরে পুনরুদ্ধার ও পুনর্গঠনের সুযোগ দেবে। শান্তিতে ঘুমান, সজীব হয়ে জাগুন। আপনার সুস্থ, সুন্দর জীবনের জন্য আজই ঘুমকে অগ্রাধিকার দিন।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।